একের পর এক বিচিত্র সব কাহিনীর জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন বিসিবিকর্তারা। আজব এক উজানের ঢেউয়ে যেন ভাসছেন সবাই। নতুন করে আলোচনায় টি-২০’র দল।
টি-২০তে পা রাখার আগে একটু আলোকপাত করবো সদস্য সমাপ্ত ঢাকা টেস্টের দিকে। এ ম্যাচে চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ সাব্বির রহমানের দলভুক্তি নিয়ে মিনহাজুল আবেদীন যে মন্তব্যটি করেছেন তা বেশ কৌতূহল জাগানিয়া। টি-২০ সামনে রেখে প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্যই নাকি সাব্বিরকে দলে নেয়া! ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন কিছু কেউ শুনেছেন বলে মনে হয় না। ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয় টেস্টে। এটা আর যাই হোক, প্র্যাকটিসের জায়গা নয়। টেস্ট আঙিনায় প্রায় ১৮ বছর পথ চলার পর এই অনুধাবনেও যদি আমরা আসতে না পারি তাহলে বিগত দিনগুলোয় আমাদের টেস্ট স্টেটাস নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছিল সেটিই কবুল করা হবে। র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থানীয় দলগুলোও টেস্টটিকে নেয় সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে। সেখানে তলানিতে থাকা আমরা যদি টেস্ট ফরম্যাটটি টি-২০’র প্রস্তুতি ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলি সামনে আরো কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হওয়াটা অস্বাভাবিক হবে না।
টি-২০তে পাঁচ নতুন মুখের ব্যাপারে প্রধান নির্বাচক যেটি বলেছেন তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। টেস্টে উন্নতির জন্য বহু বছর ধরেই বাংলাদেশ এফটিপি-তে টেস্ট বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে। সুযোগ চাইছে নিয়মিত বড় দলগুলোর বিপক্ষে টেস্ট খেলার। অথচ মিনহাজুল আবেদীনের কথা মেনে নিলে ওই দাবি হারাবে যৌক্তিকতা, হয়ে পড়বে অসাড়। তিনি বলেছেন, ঢাকা টেস্টে খেলোয়াড়দের ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তাই তাদের বিশ্রাম দিতেই পাঁচ নতুন মুখের আগমন। অন্তর্ভুক্ত পাঁচজনকে নিয়ে প্রশ্ন নেই। বয়সে তরুণ হলেও ঘরোয়া আসরগুলোয়, বিশেষ করে বিপিএল-এ নিজেদের প্রমাণ করেই দলে জায়গা পেয়েছেন তারা। প্রশ্ন উঠছে প্রধান নির্বাচকের যুক্তি নিয়ে। মাত্র দুই টেস্টের সিরিজ যার একটি শেষ হয়েছে আড়াই দিনেই। এটি খেলেই যদি খেলোয়াড়রা ক্লান্ত হয়ে পড়েন তাহলে ম্যাচ বাড়ানোর দাবিটিই তো প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়! টেস্ট দলে থাকা মুমিনুল, লিটন, তাইজুল, রাজ্জাকরা তো ওয়ানডে-তেও ছিলেন না। এ কারণে টানা ম্যাচ খেলার ক্লান্তির কথাটি ধোপে টিকছে না। মিনহাজুল আবেদীন যা বলেছেন এতে একই সঙ্গে প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় খেলোয়াড়দের ফিটনেসের ঘাটতিও। এটি কি আসলেই বাস্তব? এমনটি অন্তত কেউ বিশ্বাস করবেন বলে মনে হয় না। পারফরম্যান্সের গ্রাফ হয়তো ওঠা-নামা করছে। তাই বলে খেলোয়াড়রা ওই ক’দিনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বলে প্রধান নির্বাচকের বয়ানটি বিব্রত করবে খেলোয়াড়দেরই।
খেলোয়াড়দের নিয়ে যেহেতু কথা হচ্ছে সেহেতু আরো একটি বিষয় যোগ করতে চাই। ব্যাটসম্যানদের শট খেলার বিলাসিতা নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ বলেছেন, দলেরই প্ল্যান ছিল ইতিবাচক ক্রিকেট খেলার। তাই দ্রুত রান তোলার চেষ্টায় শট খেলার প্রবণতা দেখা গেছে। একই সঙ্গে তিনি এও বলেন, ইতিবাচক খেলার অর্থ শুধুই আক্রমণ করা নয়, বল বুঝে শট খেলা। এখানে কিছু প্রশ্ন আসবেই। ইতিবাচক খেলার মানে যে বল বুঝে শট খেলা এ বুঝটা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা বুঝেছেন কি না? হ্যাঁ, এটি সত্য, এমন পিচে চরম রক্ষণাত্মক খেলাটাও বিপজ্জনক। কিন্তু প্রতিপক্ষের বোলাররা যখন টানা ভালো লাইেলেন্থে বোলিং করে যাচ্ছিলেন তখন চাপমুক্ত হওয়ার জন্য এমন পিচে শট খেলা প্রতিআক্রমণ করা, নাকি একটু ধৈর্য ধরে বাজে বলের জন্য অপেক্ষা করা- কোনটা বেশি কার্যকর হতো এ প্রশ্নটি তুলে দিয়েছে রোশান সিলভার ব্যাটিং। দু’ইনিংসেই টেস্ট মেজাজে খেলেই পেয়েছেন দুটি অর্ধশতক। ভালো বলগুলো এড়িয়ে গিয়ে বাজে বলগুলোই তিনি বাছাই করেছেন মারার জন্য। বার বারই বলা হয়, স্কিলের সর্বোচ্চ পরীক্ষা নেয়া হয় টেস্ট ক্রিকেটে। ধৈর্য ধরে পরিস্থিত অনুযায়ী খেলতে পারা এর মধ্যে অন্যতম। সেটির ঘাটতি শুধুই খেলোয়াড়দের, নাকি ম্যানেজমেন্টেরও? কারণ কয়েক বছরে বাংলাদেশের খেলা দেখার পর এটি বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য, বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই বেসিক ওই জিনিসটি জানেন না। মাঠে যেহেতু খেলোয়াড়রা খেলেন সেহেতু দায় তাদেরই বেশি। তবে একদম দায়মুক্তি পাবেন না ওই পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ম্যানেজমেন্টের বাকিরা।
ওই হতাশার মধ্যে আলোর ঝলকানি যা পাওয়া গেছে তা বোর্ড পরিচালক নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের কথাতেই। তিনি বলেছেন, প্রতিটি ফরমাটেরই নিজস্ব ঢঙ আছে। সফল হতে হলে ওই অনুযায়ীই খেলতে হবে। টি২০’র মতো করে টেস্ট খেললে ফল আশা করা যায় না।
অনুধাবনের যে কথাটি শুরুতে এসেছিল এ ব্যাপারে নতুন করে ভাবনার খোরাক যেন নাঈমুর রহমানের বক্তব্য। বোর্ডেরই দু’জন দু’রকমভাবে ভাবছেন। একজন পুরোটাই কল্পনা থেকে, অন্যজন বাস্তবের জামিনে পা রেখে। তাই অনুধাবনে সমস্যাটি সবার না। এ জন্য এটি মনে করা বরং যৌক্তিক, বোর্ড ঠিক জায়গায় সঠিক মুখটি বসাতে পারছে না। এ বিষয়ে আরো একজনের নামও যোগ করতে পারেন- খালেদ মাহমুদ সুজন। তিনি একাধারে বোর্ডের পরিচালক, জাতীয় দলের ম্যানেজার ও টেকনিকাল ডিরেক্টর। বাংলাদেশ ক্রিকেটে কি যোগ্য ব্যক্তির এতই অভাব যে, একজনকে তিন-তিনটা পদের দায়িত্ব সামাল দেয়া লাগে? টেকনিকাল ডিরেক্টরের কাজটি আসলে কী তা স্পষ্ট নয়। এটি স্পষ্ট, তিনি টিম ম্যানেজমেন্টের একটি অংশ। ফলে এমন গেইম প্ল্যানের দায় তার ওপরও বর্তায়।
একটা খচখচানি অবশ্য থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা নাম হলো মিনহাজুল আবেদীন। বহু বছরের অভিজ্ঞতা তার। এ রকম কেউ নিজ থেকেই এমন সব অদ্ভুত যুক্তি দিচ্ছেন, নাকি আসলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন? কারণ যার বদলে সাব্বিরের দলে আগমন সেই মোসাদ্দেক বোর্ডের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা যে ক্লাবটির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ওই আবাহনীতে খেলছেন এবার। মূল একাদশ থেকে বাদ পড়ার পরই ঢাকা লিগে মাঠ মাতাতে দেখা গেছে তাকে। করেছেন ৪০ রান। এটিকে নেহাত কাকতালীয় বলতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আবাহনীকে শিরোপা জেতাতে ব্যর্থ হওয়র ফলে সাকিবের সঙ্গে তৎকালীন বোর্ডপ্রধানের আচরণ। এ দেশে চেয়ারে বসা মানুষের চেহারা বদললালেও স্বভাব বদলায় না- ইঙ্গিতটিই বোধহয় যথেষ্ট পুরো বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য।