ব্যাটিং ধ্বসে লজ্জাজনক হার বাংলাদেশের

ব্যাটিং ধ্বসে লজ্জাজনক হার বাংলাদেশের

আড়াই দিনেই শেষ মিরপুর টেস্ট।

  • ‎২১৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হারলো বাংলাদেশ।
  • দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট ১২৩ রানে ‎১-০তে সিরিজ জিতলো শ্রীলংকা।
  • ‎ম্যান অফ দি ম্যাচ ও সিরিজ রোশান সিলভা।

দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে জয়ের তামান্না তাড়া করার কথা শুনিয়েছিলেন মেহেদী মিরাজ। তার ওই বুলি ম্যাচ শেষে পরিণত হয়েছে ফাঁকা বুলিতে। মাত্র আড়াই দিনেই সমাপ্ত ঢাকা টেস্ট। ললাটে জুটলো ২১৫ রানের বিশাল পরাজয়।

 

  • এ ম্যাচের কথা বললে প্রথম যে প্রসঙ্গটি অবধারিতভাবে আসবে সেটি হচ্ছে পিচ। চট্টগ্রাম টেস্ট ড্র হওয়ার পরও ক্রিকেট বিশ্লেষকরা সমস্বরে বলেছিলেন, লংকানদের বিরুদ্ধে স্পিনিং পিচের কৌশল বুমেরাং হতে পারে। বাস্তবেও সেটি দেখা গেল। এ ম্যাচে বোলারদের দায় খোঁজার চেষ্টা করা উচিত হবে না। নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন বোলাররা। কিন্তু আমাদের ব্যাটসম্যানদের লংকানদের স্পিনের জবাব দেয়ার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এবং উঠছেও। বাস্তবতা হচ্ছে, খেলোয়াড়দের ওপর দায় চাপানোটাও পুরোপুরি সঠিক হবে না। এর আগে তামিম বলেছিলেন, শুধু টেস্টেই তারা এমন উইকেট পান। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজ্জাকের কাছেও এমন পিচ একদমই নতুন। তাই যে হোম অ্যাডভান্টেজের সুবিধা নেয়ার জন্য এ পিচ তা আসলেই কতটা হোমলি তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।

 

  • একাদশ নির্বাচনে অস্থিরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ছোট্ট কিন্তু কার্যকর ইনিংস খেলার পরও পববর্তী টেস্টেই বাদ মোসাদ্দেক। এখানে যে অভিযোগটি উঠছে সেটি বেশ গুরতর। ক্লাবের স্বার্থটিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নাকি তাকে বাদ দেয়া হয়েছে ঢাকা টেস্ট থেকে। এমনটি হলে নির্বাক চেয়ে থাকা ছাড়া সমর্থকদের ভিন্ন কোনো গতি নেই। এ অভিযোগটি জোরালো ভিত্তি পাচ্ছে দুটি কারণে। প্রথমত. ঢাকা টেস্টের স্কোয়াডে থাকলেও মোসাদ্দেকসহ আরো দুই ক্রিকেটারকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ঢাকা লিগের জন্য। দ্বিতীয়ত. চট্টগ্রাম টেস্টের পর সাব্বির এমন কিছু করেননি যার কারণে ঠিক পরের টেস্টেই তাকে দলে ফেরাতে হবে। প্রসঙ্গত. মোসাদ্দেক এবার খেলছেন ঢাকা আবাহনীর হয়ে। বোর্ডপ্রধান, দলের টেকনিকাল ডিরেক্টরসহ অনেকেই সরাসরি ঢাকা আবাহনীর সঙ্গে যুক্ত। জাতীয় দল থেকে ছাড়া পেয়েই মোসাদ্দেক আবাহনীর জার্সি গায়ে করেছেন ৪০ রান, নিয়েছেন এক উইকেট।

 

  • বহুদিন ধরেই ফরমাট অনুযায়ী দল গঠনের কথা বলা হলেও তা বাস্তবে আলোর মুখ দেখছে না। সাব্বির রহমান টেস্ট খেলার জন্য আসলেই উপযুক্ত কি না এ প্রশ্নটি আরো জোড়েশোরেই উচ্চারিত হচ্ছে এখন। ব্যাট হাতে দুই ইনিংসে তার সংগ্রহ ০ এবং ১ রান। খেলেছেন সাকুল্যে ৬ বল। স্লিপ ফিল্ডারের অভাব পূরণের কথা বলে তাকে দলে নেয়া হলেও স্লিপে তার ফিল্ডিং হতাশা বাড়িয়েছে মোস্তাফিজের। একাধিক ক্যাচ তিনি ছেড়েছেন এই ম্যাচে। একটা ম্যাচ খারাপ খেললেই তা কাঠগড়ায় তোলা সঠিক নয় সত্য। তবে সাব্বিরের ক্ষেত্রে বিষয়টি এক ম্যাচেই সীমাবদ্ধ নয়। শেষ কয়েক ম্যাচে তার স্কোরই বলে দিচ্ছে যা বলার। দৃষ্টিকটু লেগেছে আউট হওয়ার ধরনগুলোও। টেস্টে তার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকার পরও যেখানে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন সেখানে ঘরোয়া লিগের বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচগুলোয় নিয়মিত রান করলেও নির্বাচকদের নেক নজর থেকে বঞ্চিত তুষার ইমরান।

 

  • স্পিনাররা ওই ম্যাচে তাদের নিয়ে সমালোচনা করার সুযোগ রাখেননি। একমাত্র পেসার মোস্তাফিজকে নিয়েই একটু কথা বলা যাক। পুরোটা ম্যাচে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন তিনি। তার কাটার, স্লোয়ারে যেভাবে নিয়ম করে বিট খাচ্ছিলেন ব্যাটসম্যানরা তা এক আফসোসের জন্মই দিয়েছে। স্পিন অ্যাটাকে লংকানদের হাতে হেরাথ-এর মতাে অস্ত্র থাকলেও পেস ডিপার্টমেন্টে তেমন কেউ ছিলেন না। তাই ওই স্পিনিং পিচ বানিয়ে নিজেরাই কুয়োয় পড়ার বদলে স্পোর্টিং উইকেটে দুই পেসার নিয়ে খেললে ফল অন্য রকমও হতে পারতাে বলে বিশ্বাস বিশ্লেষকদের।ওেই বিশ্বাসে জোড়ালো ভিত্তি দিয়েছে মোস্তাফিজের অসাধারণ বোলিং।

 

  • পুরো সিরিজটিই কোনো কোচ ছাড়া পার করলো বাংলাদেশ। স্বল্প সময়ে হাই প্রফাইল কোচ পাওয়া কষ্টসাধ্য- এটি সত্য। কিন্তু আপৎকালীন কাজ চালিয়ে নেয়র মতো যথেষ্ট যোগ্য মুখ এই বাংলাদেশে আছে। মোহাম্মদ সালাউদ্দিন কিংবা সরোয়ার ইমরানরা এটুকু সময় সামাল দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। বাইরে থেকে কাউকে না এনে দলের স্টাফদের মধ্য থেকেই একজনকে বাছাই করাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এখানেও ধোঁয়াশা ছিল। কোনো জায়গায় খালেদ মাহমুদকে কোচ বলে উল্লেখ করা হয়েছে আবার কোথাও হ্যালসেল-কে। বিসিবি থেকে জানানো হয়েছিল সাকিব-মাশরাফিও বাড়তি দায়িত্ব পালন করবেন ওই সময়টায়। মাশরাফি যে টেস্টে থাকবেন না এটি তো জানা কথা। ফাইনালের দিন ইনজুরিতে পড়ে সাকিবও ছিটকে গিয়েছিলেন দল থেকে। মাহমুদুল্লাহকে আসামি বানানোরও সুযোগ নেই। আচমকাই অধিনায়কত্ব পেয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে নেই দলের সেরা পারফরমার সাকিব। এই অবস্থায় সীমিত রসদ নিয়ে সমশক্তির প্রতিপক্ষের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব ততটুকু তিনি করেছেন। কৌশল নির্ধারর্ণের দায়িত্ব তার একার নয়। সেটি করার মতাে যোগ্য ব্যক্তির অভাব বেশ স্পষ্ট। এ ম্যাচটিতে ভালো কোনো ফল এলে র‌্যাংকিংয়ে নিজেদের সেরা জায়গায় পৌঁছে যেত বাংলাদেশ। সুযোগটি যেন হেলায় হাতছাড়া করলো সবাই।

 

  • ক্যাচিংয়ে বাংলাদেশের নৈপুণ্য নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে আমাদের খেলোয়াড়দের হাত পিচ্ছিলতার দিক দিয়ে শীর্ষস্থানীয়। বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের ফিল্ডিং বিভাগের দায়িত্বে বিদেশিরা। বেশ ভালো অঙ্কের বেতন দেয়ার পরও কেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে না তা ভেবে দেখা দরকার। এটি আমাদের সামর্থ্যের অভাব, নাকি যে শেখাচ্ছেন তার যোগ্যতার অভাব- বিষয়টি স্পষ্ট করা আবশ্যক। বাংলাদেশ বড় ব্যবধানে হেরে যাওয়ার কারণে হয়তো বিষয়টি আড়ালে চলে যাবে। তবে একটু খেয়াল করলেই এটি পরিষ্কার হয়ে যাবে, লংকানরা বোর্ডে যে রান জমা করেছেন এর চেয়ে বেশ কমেই তারা অলআউট হয়ে যেতেন যদি না আমাদের ফিল্ডাররা এমন উদারতার হাত বাড়িয়ে দিতেন ব্যাটসম্যানদের দিকে।

 

  • ওই ম্যাচ শেষে খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বা খামখেয়ালি নিয়ে কথা বললে দোষ দেয়ার সুযোগ নেই। আপনি প্রথম ইনিংসের আউটগুলো খেয়াল করুন, কয় ব্যাটসম্যান ভালো বলে আউট হয়েছেন? ওই ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার তাগিদও দেখা গেল কই? দ্বিতীয় ইনিংসেও যেন তাসের ঘরের মতাে ভেঙে পড়লো ব্যাটিং লাইনআপ। গত ম্যাচেই ইমরুলের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এ ম্যাচেও খেয়াল করুন। হেরাথ-কে বেড় হয়ে এসে ছয় মেরে পরের বলেই আউট! এটি টেস্ট ম্যাচ। ৬ নয়, টপ অর্ডারের কাছে দায়িত্বশীল ও বড় ইনিংস আশা করে সবাই। ওই অনুধাবনটিও যেন আশা করা এখন পাপ। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, রান না এলে ধৈর্য ধরে টিকে থাকার যে একটি বিষয় আছে এটি খেলোয়াড়দের দেখে বোঝা যায়নি। এমন পিচে অহেতুক শট খেলার প্রবণতা আত্মহত্যার শামিল। আর এ কাজটিই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা করেছেন সানন্দে।

 

বছরের শুরুটি হলো হতাশা দিয়ে। ক্রিকেটে জয়-পরাজয় স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু বছরের শুরু দিকের ত্রিদেশীয় সিরিজ বলুন কিংবা ওই টেস্ট সিরিজ- দুটিই শেষ হলো বিতর্কিত অনেক উপাদান নিয়ে। এক ধরনের খামখেয়ালি, আত্মশ্লাঘা চেপে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।আগের লংকান দলের বিপক্ষে ওই ফলটিকে যথেষ্ট ভালো বলা গেলেও বর্তমান বিবেচনায় এটিকে বলতে হচ্ছে অ্যালার্ম বেল। শক্তি বিচারে দু’দলই এখন প্রায় সমশক্তির। এরপরও দুটি সিরিজেই শেষ হাসিটা লংকানদের। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে না দেখলে বছরজুড়েই যে এ হতাশার গল্প লিখতে হবে তা বলে দেয়াই যায়।