এই আধুনিক যুগে এসেও নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য এক সুদীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে কাশ্মিরকে। সাম্প্রতিক কালে দ্বিতীয় নজির হিসেবে তাদের সামনে আছে ফিলিস্তিন। এই জন্য কাশ্মিরকে এশিয়ার ফিলিস্তিন হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
কাশ্মিরের নাম আমরা দুটি কারণে সবচেয়ে বেশি শুনে থাকি। প্রথমত কাশ্মির তার অতুলনীয় নৈঃসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে বিখ্যাত জগৎ জুড়ে।
কাশ্মিরের রুপ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরের ওপর ভারত সরকারের যুগ যুগ ধরে চালানো রাষ্ট্রীয় নির্যাতন এবং এ থেকে মুক্তির জন্য কাশ্মিরীদের সুদীর্ঘ সংগ্রাম। ফলে মানবতা ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে কাশ্মীরের জন্য সহানুভূতির জায়গাটি সবমসময়ই থাকে।
কাশ্মিরে এটা ছিল আমার দ্বিতীয় সফর। প্রথমবার এসেছিলাম মাস তিনেক আগে, সেপ্টেম্বরে। তখন ছিল শরৎকাল। তারপর জানুয়ারির মাঝামাঝিতে তীব্র শীতে দ্বিতীয়বারের মতো সেখানে উপস্থিত হলাম। একা, নিঃসঙ্গ পরিব্রাজকের মতো! পৃথিবীর আশ্চর্য এই মায়াময় ভূমিতে হৃদয়ের টানে একবার নয়, বারবার আসতে ইচ্ছে হয়।
এই দুই সফরে আমি কাশ্মিরের নৈঃসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি কাশ্মির এবং কাশ্মিরীদেরকে কিছুটা গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। কাশ্মির ক্রাইসিসের সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং হতাশাজনক বর্তমানের বিস্তারিত বয়ান তাদের জবানিতে শোনার সুযোগ পেয়েছি। আমার চোখের সামনে একই সাথে ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর যেমন তার লাস্যময় রূপ-সৌন্দর্য্য নিয়ে ফুটে উঠেছে, স্বর্গোদ্যানের মতো উপত্যকাগুলোর দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছি কখনো, তুষারাবৃত পাহাড়গুলো অতিক্রম করে যেতে যেতে আনন্দে উচ্ছল হয়েছি। অপরদিকে যুগ যুগ ধরে চলমান দখলদারদের শোষণ ও নির্যাতনের চলমান বিভৎস রূপটিও স্বচক্ষে দেখে এসেছি। একজন অনুসন্ধিৎসু পরিব্রাজকের মতো, কাশ্মিরের গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছি, প্রত্যন্ত উপত্যকাগুলোতে, সেখানকার মানুষদের আন্তরিক অাতিথেয়তা পেয়েছি। একান্তভাবে তাদের সাথে মিশতে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের কথা জানতে চেয়েছি। তারা আগ্রহভরে শুনিয়েছেন। আমার নিজেরও অতুলনীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে! অন্য সাধারণ ট্যুরিস্টদের মতো কেবল বিখ্যাত স্পটগুলোতে না থেকে,আমার বিচরণ ছিল আরও বিস্তৃত, ফলে এমন অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা অন্য পর্যটকদের হতে হয়না সাধারণত। ইতিহাসের দিকে না গিয়ে, আজ সংক্ষেপে শুধু সেসব অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধির বয়ান তুলে ধরতে চাই।
কিন্তু সমস্যা হলো, আপনি কাশ্মির প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করলেই, একদল লোক, যারা বিপরীত প্রশ্নের ডালি সাজিয়ে বসে আছেন, তারা হামলে পড়ার জন্য প্রস্তুত! নির্বাসিত কাশ্মিরী পন্ডিতদের ব্যাপারে কী বলেন? পাকিস্তান যদি কাশ্মির দখল করে নেয়, যদি ইসলামী মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কাশ্মীরে, যদি কাশ্মীরের দেখাদেখি অন্যান্য সংযুক্ত প্রদেশগুলো স্বাধীনতার দাবি তোলে?
আমাদের দেশে কাশ্মির বিষয়ক আলোচনা ও সচেতনতা তেমন না থাকলেও ভারতীয়দের মাঝে কাশ্মির প্রসঙ্গে এসব প্রশ্ন বেশ চর্চিত। মূলত এসব প্রশ্নের মাধ্যমে একদিকে রাষ্ট্রীয় জুলুমের বৈধতা দান, অপরদিকে সুন্দর ও সুষ্ঠ সমাধাণের পথগুলোকে রুদ্ধ করে দেয়া হয়। কাশ্মির বিগত কয়েক দশক ধরে ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অকল্পনীয় নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন জনসাধারণ।
ভারত-পাকিস্তানের চিরায়ত শত্রুতার রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী কাশ্মির। মিডিয়া আমাদের সামনে কী উপস্থাপন করবে এবং কিভাবে উপস্থাপন করবে এর সবটাই নিয়ন্ত্রিত হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে, বিশেষ করে কাশ্মিরের ব্যাপারে ভারতীয় মিডিয়া সরকারের সবচেয়ে বড় সহযোগী। যে কারণে কাশ্মীরে কী ঘটছে না ঘটছে – এর বাস্তব চিত্র ও সঠিক বিবরণ মিডিয়ার কাছ থেকে আশা করাটা বোকামি হবে।
নিপীড়িত এইসব মানুষের আর্তনাদ কখনোই পৃথিবীর মানবতাবাদী লোকদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না এবং আজ পর্যন্ত কাশ্মির ইস্যু জোরালো ভাবে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসার্ন’ হয়ে উঠতে পারেনি। ইন্ডিয়া সবসময়ই এটাকে অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্যা হিসেবে ব্যাখ্যা করে আসছে। জাতিসংঘ কতৃক আন্তর্জাতিকভাবে কাশ্মিরকে বিতর্কিত এবং অমিমাংসিত ইস্যু হিসেবে ঘোষণা করা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এখানে প্রয়োগ হয় না। কাশ্মির পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন সেনা-বসতিপূর্ণ এলাকা। প্রায় দশ থেক বারো লক্ষ সৈনিক মোতায়েন করা হয়েছে কাশ্মির উপত্যকায়। আমি অনন্তনাগে ঘুরে দেখেছি, সকাল বেলা, সেনাদের ভীড় ঠেলে, রাইফেল বন্দুকের গুঁতো খেয়ে খেয়ে বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে! লোকজন শাক-সবজি নিয়ে রাস্তায় বসেছে, সৈনিকদের পা লেগে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে! এই দৃশ্য আমার মনে এক গভীর প্রভাব ফেলেছে! সেখানে সবসময়ই যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান থাকে। কেউ জানে না, কখন কার বাড়িতে ফৌজি ঢুকে সব তছনছ করে দেবে। কে কখন গুম হয়ে যাবে, কিংবা গুপ্ত-হত্যার শিকার হবে,তারও কোন নিশ্চয়তা নেই।
আমি কুপওয়ারা এলাকার একটি উপত্যকায় দুইদিন অবস্থান করেছিলাম। আমাদের গন্তব্য আরও দূরের, লুলাব ভ্যালী। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে দুইদিন থাকতে হয়েছিল। যার বাড়িতে ছিলাম তিনি একজন বয়স্ক এবং উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। আমাদের দুইজনের খুব খাতির জমে গিয়েছিল। টানা দুইদিন আমরা কাশ্মির ইস্যু নিয়ে কথা বলেছি। তিনি আমাকে কাশ্মিরের ইতিহাস শুনিয়েছেন। নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন। কাশ্মিরের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন, রাজনৈতিক বাস্তবতা কী, সব বিষয়েই সবিস্তারে আলাপ করেছি আমরা। তার আন্তরিক সঙ্গ আমাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে!
আমি তাকে বললাম, দেখেন আপনাদের সমস্যা তো বহুমুখী! ভারত তার সর্বশক্তি দিয়ে দখলদারিত্ব বজায়ে রাখতে চেষ্টা করছে, জাতিসংঘ আপনাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবছে না, এক পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোন সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রের সাহায্য সমর্থনও নাই আপনাদের সাথে। তথাপি আপনারা যেভাবে আযাদীর আন্দোলন করে যাচ্ছেন, অস্ত্রও হাতে তুলে নিচ্ছেন, এর কি কোন ভবিষ্যৎ আছে? আদৌ কি এমনটা ঘটার সম্ভাবনা আছে?
তিনি বললেন, তোমাকে সহজ একটা উদাহরণ দেই, দেখো, এদেশে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় যখন; তখনও কিন্তু বৃটিশকে মহাপরাক্রমশালী, শক্তিমান মনে হচ্ছিল। তাদেরকে পরাজিত করে একদল অশিক্ষিত মানুষ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে, এমনটা প্রথম প্রথম কল্পনাও করা যেত না। উপরন্তু কার্যকরী কোন বিদেশি সাহায্যও কিন্তু ছিলনা তাদের সাথে। এসব সত্ত্বেও এদেশে মুক্তির আওয়াজ উঠেছে, এবং দীর্ঘ সংগ্রামের পর তারা তা অর্জনও করেছে। আমরা আমাদের বর্তমান অবস্থান ভালভাবে জানি, এও জানি, যদি কাঙ্খিত বস্তু পেতে হয় তাহলে আরও অনেক আত্মত্যাগের প্রয়োজন হবে। এই কয়েক যুগের সংগ্রামে আমরা বহু রক্ত ঝরিয়েছি, বহু প্রাণের কোরবানি হয়েছে। আমরা জানি এই আত্মত্যাগ সামনের সময়গুলোতে আরও প্রয়োজন হবে,তবে আমরা এর জন্য প্রস্তুত আছি! এখন কাশ্মিরে দশ লাখেরও বেশি সামরিক সেনা মোতায়েন করা আছে, ভারত যদি আরও সত্তর লাখ সেনা এখানে মোতায়েন করে তবুও তার কাঙ্খিত উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না। কাশ্মির আযাদ হওয়া প্রচেষ্টা থামাতে পারবে না। কাশ্মিরীরা ভারতকে শত্রু মনে করে ঘৃণা করেই যাবে।
আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম তার আবেগ-মথিত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের কথাগুলো। তিনি আরও বলেন, একটা সময় আমরা শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে ছিলাম, শিক্ষার অভাবে আমাদের সচেতনতা কম ছিলো। কিন্তু বর্তমান যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, তারা শিক্ষিত হচ্ছে, অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে। তারা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন।
পৃথিবীর কেউ তো এটা অস্বীকার করতে পারবেনা যে, এখানে জুলুম হচ্ছে না! জুলুম হলে জুলুমের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠবেই, আজ না হোক কাল এর অবসানও হবেই! আমি বললাম,আচ্ছা আপনারা যে মিছিলে মিছিলে শ্লোগান দেন, কাশ্মির বনেগা পাকিস্তান! পাকিস্তানের উপর কি আপনাদের এই আস্থা আছে যে, তারাও ভারতের মতো আচরণ করবেনা আপনাদের সাথে?
তিনি বললেন, দেখো এখানে কয়েকটা বিষয় আছে। প্রথমত আমরা আটানব্বই ভাগ মানুষ মুসলিম।পাকিস্তানও অনুরূপ।যে কারণে পাকিস্তানের রাজনীতির উপর অবিশ্বাস থাকলেও জনগণের সাথে আমাদের হৃদ্যতা আছে।
দ্বিতীয় কথা হলো, আমরা এখানে শত্রুবেষ্টিত হয়ে আছি। পৃথিবীর কেউ আমাদের কথা ভাবে না। পাকিস্তান তার স্বার্থের জন্য হলেও আমাদেরকে সাহায্য করে। এখন আমরা যদি পাকিস্তানের নামে স্তুতি না গাই, তাহলে তাদের কী এমন ঠেকা পড়েছে আমাদেরকে সাহায্য করার!
নব্বইয়ের শুরু থেকে ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার আলোকে যে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তা এখন পর্যন্ত চলমান। নিজেদের দাবি থেকে একচুল পরিমাণও সরে আসেনি কেউ। এই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় আন্দোলনের গতিপথ পাল্টেছে। বিভিন্ন অবস্থার ভেতর দিয়ে গিয়েছে তারা। কখনো আন্দোলন স্তিমিত হয়েছিল, কখনও প্রচণ্ড উত্তাল তরঙ্গের মতো ফুঁসে উঠেছে। ২০১৬ সালের ৮ জুলাই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বুরহান মুজাফফর ওয়ানির শাহাদাতের পর এই আন্দোলন এতোটাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল যে,তখন মনে হচ্ছিল এবার হয়তো কিছু একটা হয়েই যাবে! পুরো কাশ্মির উপত্যকা একই শ্লোগানের পতাকা তলে সমবেত হয়ে একই দাবি নিয়ে নেমে এসেছিল। বুরহানের জানাযায় উপস্থিত হয়েছিল প্রায় তিন লক্ষ কাশ্মিরী! দীর্ঘ চার মাস পর্যন্ত সবকিছু বন্ধ। ব্যবসা বাণিজ্য, দোকানপাট, স্কুল সবকিছু অচল ছিল। এতে যদিও তারা অপরিমেয় ক্ষতির শিকার হয়েছিল, কিন্তু এই ক্ষতিকে তারা স্বাগতই জানিয়েছে। এখন পর্যন্ত কাশ্মিরের প্রতিটি দেয়ালে বুরহানের জয়ধ্বনি লেখা! ৭০ লক্ষ মানুষ, যারা প্রতিনিয়ত তিন মাস বা তারও বেশিদিনের কার্ফিউ এর মাঝে বসবাস করে তাদের হার মানানো খুবই কঠিন। কাশ্মিরিরা যত্নের সাথে, দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এমন এক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে যার সাথে পৃথিবীর খুব অল্প দেশের সাথে তুলনা করা যায়। কাশ্মিরিরা তাদের শুধু একটি উদ্দেশ্যের জন্য তাদের স্বাভাবিক জীবনকে বিসর্জন দিয়েছে। একটি দীর্ঘ মেয়াদী সংগ্রাম পরিচালনার জন্য এই ধরণের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকল্প অবশ্যই জরুরি। যেভাবে কাশ্মিরী জনগণ তাদের জনসম্পদ ও বস্তুগত উপকরণ গুলোকে ব্যাবহারের মাধ্যমে আহত, ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার ব্যাবস্থা করেছে তা অতুলনীয়।
আমাকে আমার বন্ধু বলছিলেন, এমন কোন কাশ্মিরী নেই যার গালে ফৌজিদের থাপ্পর পড়ে নাই! এমন কোন ঘর নেই, যে ঘর তল্লাশির শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি! যখন ইচ্ছা, ঘরে ঘরে ঢুকে তল্লাশি করার অধিকার তাদের দিয়েছে ভারতীয় দখলদার সরকার।
তোমার কথা পছন্দ না হলে লাত্থি দেবে না হয় থাপ্পড় দেবে, নাকি গুম করে ফেলবে সেটাও তার ইচ্ছা এবং অধিকার। যতভাবে হয়রানি সম্ভব, তার সবটাই করবে।
রাষ্ট্রের এই অমানবিক আচরণের কারণ হল, জনগণের দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি করা, যাতে তারা প্রতিরোধের পথ থেকে অবসর নিতে বাধ্য হয়। জাতিগত মুসলিম বিদ্বেষও একটি কারণ। একটা কথা প্রচলিত আছে, কাশ্মিরে পর্যটকরা নিরাপদ, কাশ্মিরীরা নয়!
নারী এবং শিশুদের অবস্থা আরও বিপন্ন। শিশুরা একটি অস্বাভাবিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠছে। আতঙ্ক ও ভয়ের ভেতর কাটছে জীবন। নারীরা ধর্ষণ ও অন্যান্য হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমরা যখন কুপওয়ারা থেকে লুলাব ভ্যালীর দিকে যাচ্ছিলাম,তখন পথিমধ্যে কুনান নামক একটি গ্রাম অতিক্রম করে যাচ্ছিলাম। তখন ভেতরে এক চাপা কান্না নিয়ে দেখছিলাম এই ছবির মতো সুন্দর এই উপত্যকার ঘর বাড়িগুলোকে। গতকালই শুনেছি এই কুনান এবং তার পার্শ্ববর্তী গ্রাম পুশপুরার কাহিনী। ইতিহাসের বর্বরতম এক নিষ্ঠুরতার শিকার এই দুই গ্রামের অনেক নারী! নব্বইয়ের শুরুর দিকে ভারতীয় সৈনিকরা তল্লাশির নামে দুই গ্রামের সকল পুরুষকে একত্রিত করে আটকে রাখে। অপরদিকে আরেকদল সৈনিক ঘরে ঘরে গিয়ে নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। মানবাধিকার সংস্থার প্রাথমিক ইনভেস্টিগেশনে আড়াইশো ধর্ষিতা নারীর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এর প্রকৃত সংখ্যা এর তিনগুণের বেশি হবে। এসবের কোন বিচার হয়নি। সরকার সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এধরণের কোন ঘটনাই ঘটেনি কোথাও। নব্বই থেকে এখন পর্যন্ত মোট ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ১১,০৪২ জন।
ধর্ষণের ঘটনাগুলো সেনাদের মাঝে ইনডিসিপ্লিনিটি বা বিশৃঙ্খলার কারণে ঘটছে, এমন না। বরং এটাকে তারা পরিকল্পিত যুদ্ধকৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে!
কাশ্মিরে বর্তমানে বিধবা নারীর সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। যাদের স্বামী সন্ত্রাসের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, অথবা বছরের পর বছর ধরে গুম হয়ে আছেন। সেইসব নারীরা তাদের শিশু সন্তানসহ চরম দারিদ্রের সঙ্গে একাকি সংগ্রাম করে জীবন যাপন করছেন। পিতৃহারা এতিম শিশুর সংখ্যা একলাখেরও বেশি! মিলিট্যান্ট এনকাউন্টার-এটাকের নামে যেকোন সময় যেকোন বাড়িতে হামলা হতে পারে, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮ হাজার ৬৫৮টি স্থাপনা ধ্বংসের শিকার হয়েছে। গুম করা হয়েছে হাজারো মানুষকে। যাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ এবং নির্দোষ। আরও শতশত অজ্ঞাত মানুষের লাশ দাফন করা হচ্ছে শ্রীনগরের শহীদ কবরস্থানে। কাশ্মির সীমান্তের লাইন অব কন্ট্রোলে সবসময়ই খামখেয়ালি যুদ্ধে মেতে ওঠে ভারত পাকিস্তানের সৈনিকেরা, আর এই যুদ্ধের চড়া মূল্য পরিশোধ করে সীমান্তবর্তী নিরীহ মানুষেরা -তাদের জীবনের বিনিময়ে!
রাষ্ট্রীয় জুলুমের ফিরিস্তি আরও বহু দীর্ঘ! এক লেখাতে বলে শেষ করা যাবে না। তবে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই নিপীড়নের অবসান চায় মানুষ। আতঙ্ক আর শঙ্কার ভেতর জীবন যাপন করে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ফলে নিষ্পেষিত মানুষ তাই বারবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় তরুণেরা হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। মনে রাখা দরকার, এখন যে আন্দোলন চলছে সেখানে, সেটা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘণের প্রতিবাদ হিসেবে নয়, এটা আযাদীর আন্দোলন। তাদের এই দাবি কতটুকু যৌক্তিক এবং অপরিহার্য সেটা তারা প্রতিদিন শহীদদের জানাযায় সমবেত হয়ে প্রমাণ করে যাচ্ছে। বুরহান, শবজার এবং ফারদিনের মতো অসংখ্য তরুণেরা স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নিয়ে বলে দিচ্ছে তারা কী চায়, এবং এর জন্য তারা সর্বোচ্চ কী করতে প্রস্তুত! রাইফেলের সামনে পাথর নিয়ে দাঁড়াচ্ছে যে নারী সেও এক মহান সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে। কেননা নিপীড়িত মানুষের ঘুরে দাঁড়ানো, এবং জুলুমের অবসান ঘটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
লেখা শেষ করছি প্রিয় কবি সুকান্তের একটি কবিতা দিয়ে-
”কাশ্মীরের সুন্দর মুখ কঠোর হল
প্রচণ্ড সূর্যের উত্তাপে।
গলে গলে পড়ছে বরফ—
ঝরে ঝরে পড়ছে জীবনের স্পন্দন:
শ্যামল আর সমতল মাটির
স্পর্শ লেগেছে ওর মুখে,
দক্ষিণ সমুদ্রের হাওয়ায় উড়ছে ওর চুল:
আন্দোলিত শাল, পাইন আর দেবদারুর বনে
ঝড়ের পক্ষে আজ সুস্পষ্ট সম্মতি।
কাশ্মীর আজ আর জমাট-বাঁধা বরফ নয়:
সূর্য-করোত্তাপে জাগা কঠোর গ্রীষ্মে
হাজার হাজার চঞ্চল স্রোত।
তাই আজ কাল-বৈশাখীর পতাকা উড়ছে
ক্ষুব্ধ কাশ্মীরের উদ্দাম হাওয়ায় হাওয়ায়;
দুলে দুলে উঠছে,
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ
বিরাট ব্যাপ্ত হিমালয়ের অসহিষ্ণু বুক।।
(কাশ্মীর / সুকান্ত ভট্রাচার্য)