যথাযথ প্রমাণ ও বিচারের সব আইনি সংস্কৃতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আফজাল গুরুকে ফাঁসিমঞ্চের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। রায়ে বলা হয়, ‘ভারতের জনতার সামগ্রিক ইচ্ছা’র প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। অথচ কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বিচার করার সংস্কৃতির প্রতিবাদে ভারতসহ সারা বিশ্বের সচেতন নাগরিক সমাজ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। তাই ‘জবান’ এমন কয়েক ব্যক্তিত্বের মন্তব্য তুলে এনেছে যারা নিঃসংকোচে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তুলেছিলেন উঁচুস্বর। এখানে দেয়া মন্তব্যগুলো অরুন্ধতী রায় সম্পাদিত বই ‘দি হ্যাংগিং অফ আফজাল গুরু অ্যান্ড দি স্ট্রেঞ্জ কেইস অফ দি অ্যাটাক অন দি ইন্ডিয়ান পার্লামেন্ট’ থেকে নেয়া।
♦ ♦ ♦
একটি ফাঁসি কার্যকরে সর্বোচ্চ সময় ব্যয় হয় ১০ মিনিট। এ ধরনের যেনতেন রায়ের ফল হয় ধ্বংসাত্বক ও ক্ষতিকর। তাই আফজালের রক্তপিপাসু ‘জনতা’ এ দেশের শত্রু।
—অশোক মিত্র, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসভা সদস্য ও অর্থমন্ত্রী; সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার বিজয়ী
আফজালের ঘটনাই আমাদের জানান দেয়, কাশ্মীরের জীবন কেমন চলছে। আমরা পত্রিকায় কেবল দেখি চরমপন্থীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর লড়াই। সাধারণ নাগরিকদের প্রাণহানি দেখি। আসলে সত্য বলাটাও এখন কাশ্মীরে বেশি বিপজ্জজনক। আপনি কাশ্মীর বিষয়ে যত ভেতরে যাবেন ততই ডুবতে থাকবেন।
—অরুন্ধতী রায়, বুকারজয়ী সাহিত্যিক ও প্রখ্যাত সমাজকর্মী
কেউ কখনো শুনেছেন এমন ফাসির আদেশ যে আদেশে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনাে সুযোগই দেয়া হয়নি! এই ভয়নাক ভ্রষ্ট রায়ের পুনরায় বিচার হোক।
—এ জি নুরানি, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
এই বিচারের মাধ্যমে উন্মোচিত হলাে কীভাবে দেশপ্রেমের ঘাড়ে পা দিয়ে তারা এই দেশে ফ্যাসিবাদের চর্চা করে। আমার দেশে কীভাবে ফ্যাসিবাদ বিজয় উল্লাস করে। আফজাল গুরুর হালহকিকত পর্যন্ত জানার সুযোগ হয়নি আমাদের। মোহাম্মাদ আফজাল-কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আমাদের গণতন্ত্রে কলঙ্ক লেপন ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হবে না।
—নন্দিতা হাস্কর, আফজাল গুরুর পক্ষে আইনি সহায়তাকারী দলের অন্যতম সদস্য
ওই চক্রান্তের মঞ্চে আফজাল এক অভিনেতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি সন্ত্রাসবাদের চক্রে একটা অংশ মাত্র। ওইদিন আফজাল বন্দুক তোলেননি, গুলিও ছােড়েননি, কাউকে খুন করেননি। তার অপরাধ ছিল একটাই, নিহত হামলাকারীদের একজনের মোবাইলে তার ফোন নম্বর ছিল।
—শুদ্ধব্রত সেনগুপ্ত, লেখক ও গবেষক; সেন্টার ফর দি স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিস-এর একটি প্রকল্পের উদ্যোক্তা
আফজালের ফাঁসি বিচার ব্যবস্থার ব্যাপক ব্যর্থতা ও সুশীল সমাজের বিবেকের কাছে বিশাল ধাক্কাস্বরূপ।
—প্রফুল্ল বিদওয়াই, প্রবীণ সাংবাদিক ও সাবেক সিনিয়র সম্পাদক টাইমস অফ ইন্ডিয়া
আফজাল গুরুর বিরূদ্ধে অকাট্য প্রমাণের দাবি থাকলেও বিচারে ওই প্রমাণের বিপক্ষে কোনো চ্যালেঞ্জই আসতে দেয়া হয়নি যা তার জন্য মামলাটিতে জেতা বস্তুত অসম্ভব করে তোলে।
—নির্মালাংশু মুখার্জি, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়
আফজাল গুরুর ফাঁসিতে ঝােলানোর কথা জানতাে না তার পরিবার। তার দুর্ভাগ্য যে, ফাঁসির আগে শেষবার দেখা করার সুযোগ হয়নি পরিবারের সঙ্গে। ফাঁসির দুই দিন পর কাশ্মীরে তার পরিবারের কাছে চিঠি পৌঁছানো হয়।
-টিআর আন্ধরুজিনা, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী
যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-এর হামলায় এখন পর্যন্ত মাত্র একজন ধরা পড়েছে। সে হলো জাকারিয়া মুসা। বিচারালয় তাকে মৃতুদণ্ডাদেশ থেকে অব্যহতি দেয়। কিন্তু একই ঘটনা ভারতে ঘটলে মুসার ভাগ্য এতটা প্রসন্ন নাও হতে পারতাে। আফজাল গুরুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে বলা যায়, নানান পুলিশি অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে অনেক আগেই কারাগারের ভেতর একঝাঁক টিভি সাংবাদিকের কাছে মুসা সব ঘটনা স্বীকার করে ফেলতাে এবং ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের গোয়েন্দারা সাংবাদিকদের চা-বিস্কুট পরিবেশন করতেন।
—জাভেদ নাকভি, প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মতাদর্শগত বিভ্রান্তি এখন সমাপ্তির পথে। ফলে একমাত্র শক্তি ও ঔদ্ধতার জোরেই কাশ্মীর এখনো ভারতের সঙ্গে যুক্ত আছে। তিহার জেলখানায় শহীদ আফজাল-এর মৃতদেহই যেন ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্কের রূপক। আফজাল গুরুর মৃতদেহ যেমন ভারতের ভূমির অন্তর্ভুক্ত নয় তেমনি কাশ্মীরও ভারতের অংশ নয়।
—মুহাম্মদ জুনায়েদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কাশ্মীরি নৃবিজ্ঞানী
আফজাল গুরুকে শাস্তির আওতায় আনতে সুপ্রিম কোর্টের কাছে একাধিক আইন ছিল। অথচ আদালত কঠোরতম আইনটিই বেছে নিল (সেকশন ১২০-এর (খ) এবং ৩০২ ধারা অনুযায়ী)। ফলে আফজাল গুরুর রায় ওই কারণে দেয়া হয়নি যে, একমাত্র ফাঁসির মাধ্যমেই ন্যায়বিচার সম্ভব। বরং ফাঁসির রায় দেয়ার কারণ ছিল, শুধু ফাঁসিতে মৃত্যু হলেই ভারতের জনগণ তুষ্ট হবে।
—সোনিয়া জব্বার, আন্তর্জাতিক পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক