২০০১ সালে ভারতের সংসদে হামলার ‘পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে ফাঁসির চূড়ান্ত রায় হয় কাশ্মিরী নাগরিক আফজাল গুরুর। যেনতেন ভাবে এক বিচারের সম্মুখীন করা হয় তাকে। আফজাল গুরুর স্ত্রী তাবাসসুম ইনসাফের আশায় ২১ অক্টোবার ২০০৪ কাশ্মির টাইমস পত্রিকায় ভারতের জনগণের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি স্বামীকে নির্দোষ ঘোষণা করে জনতার কাছে এই বিচারের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তিনি ন্যায় বিচার পাবেন। প্রচন্ড আবেগ এবং হৃদয়স্পর্শী চিঠিটি জবানের পাঠকদের জন্যে বাংলায় প্রকাশ করা হল–
আমি মোহাম্মাদ আফজালের স্ত্রী,
যাকে ১৩ ডিসেম্বর ২০০১ সালে ভারতীয় পার্লামেন্ট হামলার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। জজ আদালত থেকে আফজালকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়েছে এবং এস এন ধিংরার নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টেও সেই রায় বহাল রাখা হয়েছে। বর্তমানে তার রায় মাননীয় সুপ্রিম কোর্টে আপিলের তালিকায় রাখা হয়েছে।
আপনারা সকলেই দেখেছেন; ভারতের মানুষ ২০০১ সালের সেই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এবং আমি নিজেও মনে করি এই সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে সকলের দাঁড়ানো উচিৎ। সাথে সাথে এই ভয়াবহ হামলার জন্য যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের শাস্তি দেয়ার আগে তাদের কথাগুলোও গুরুত্ব দিয়ে শোনা উচিৎ। আমি বিশ্বাস করি আমার স্বামীর কথা কেউ শোনেনি এবং তার কথাগুলো আদালতেও ঠিকমত উপস্থাপন করা হয়নি।
আমি আপনাদের কাছে আরজি করছি; আমাদের কথাগুলো আগে শুনুন। তারপর নিজে সিদ্ধান্ত নিন কি বিচার আপনারা করবেন। আফজাল এবং আমার গল্পটা আরো হাজারো কাশ্মিরী দম্পতির মতই। আমাদের গল্পটাই বলে দেয় প্রতিদিন কত কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছি আমরা।
সময়টা ১৯৯০ সাল, অন্য হাজারো কাশ্মিরী যুবকের মতই আফজাল জুম্মু কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্টের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন। তিনি স্বল্প দিনের প্রশিক্ষণ ও গ্রহণ করতে পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তার আশা ভঙ্গ হয়। বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়া পাকিস্তানপন্থি দলগুলোকে তিনি সমর্থন করতে পারেননি। তাই মাত্র তিন মাসের মধ্যে কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই তিনি ফিরে আসেন। এবং দিল্লিতে ফিরে গিয়ে তিনি আবার পড়াশোনোয় মনোযোগ দেন। তিনি সবসময়েই পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলেন এবং আন্দোলনে যোগ দেয়ার আগেই তিনি এমবিবিএস পাশ করেন।
আমার স্বামী আবার সাধারণ জীবনে ফিরে আসতে চাইতেন। তাই তিনি তিনি ঠিক করলেন তিনি আত্মসমর্পণ করবেন। কিন্তু বিএসএফ কমান্ড্যান্ট তাকে আরো দুইজন লোককে সাথে না নিয়ে আত্মসমর্পন করতে বাঁধা দিল। শেষে আফজাল আরো দুই জন মুজাহিদকে আত্মসমর্পণ করাতে রাজি করালেন। অতঃপর তাকে একজন যোদ্ধা হিসেবে আত্মসমর্পণ করার অনুমতি দিলো। আপনি ভাবতে পারবেন না কাশ্মিরে একজন যোদ্ধার আত্মসমর্পণের জীবন কতটা দূর্বিসহ। কিন্তু তবুও আমার স্বামী কাশ্মিরে তার পরিবারের সাথেই থাকিতে সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৯৭ সালে কাশ্মিরেই তিনি ছোট্ট একটা ফার্মাসি দিলেন এবং হাসপাতালের জিনিসপত্রের ব্যবসা শুরু করলেন। এর পরের বছর আমাদের বিয়েও হয়। তখন তার বয়স ২৮ আর আমার বয়স ১৮ বছর।
কাশ্মিরে থাকার সময়গুলোতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর লোকরা ক্রমাগতই আমার স্বামীকে জ্বালাতন করতে থাকে। তারা আমার স্বামীকে সন্দেহভাজন অন্য যোদ্ধাদের উপর গোয়েন্দগিরি করার জন্য চাপ দিতে থাকে। রাষ্ট্রীয় রাইফেলস এর মেজর রাম নামে একজন তাকে তুলে নিয়ে তার গোপন অঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক পর্যন্ত দেয়। তাকে এভাবে অপদস্থ করে অত্যাচার করা হত।
সে আমার স্বামীকে উল্টো করে ঠান্ডার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখতো। তারা আমার স্বামীর গোপন অঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক দিতো। এভাবে দিনের পর দিন তাকে অত্যাচার করা হতো।
এভাবে ভারতীয় সেনারা প্রতিনিয়তই তাকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করতো। তারা আফজালের কাছে তথ্য চাইতো। এক রাতে ভারতীয় বাহিনীর লোকেরা আমাদের বাড়িতে আসলো এবং তারা আমাদের সকলকে অত্যাচার করে আফজালকে তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেলো। আরো একবার তাকে এসটিএফ (স্টেট টাস্ক ফোর্স) এর পালহালান পাত্তান ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো।
এর কিছুদিন পরে তাকে এসটিএফের হামহামা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ক্যাম্পের অফিসার আমাদের কাছে এক লাখ রুপি মুক্তিপণ দাবি করে। আমরা মোটেই ধনী নই। তাই আফজালকে অত্যাচার থেকে বাচানোর জন্য আমরা আমাদের যা কিছু সম্বল ছিলো সব কিছু বেঁচে দিলাম। আমাদের বিয়ের সময় আমাকে ছোট্ট একটা সোনার গহনা দেয়া হয়েছিলো; সেটাও বেঁচে দিলাম।
ক্যাম্পে তার গোপন অঙ্গ দিয়ে তার শরীরে ঠান্ডা পানি-পেট্রোল ঢুকানো হতো। শান্তি সিং নামে একজন অফিসার ছিলো সে আমার স্বামীকে উল্টো করে ঠান্ডার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখতো। তারা আমার স্বামীর গোপন অঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক দিতো। এভাবে দিনের পর দিন তাকে অত্যাচার করা হতো।
আপনারা হয়তো ভাবছেন আমার স্বামী নিশ্চয়ই কোনো কোনো জঙ্গি নেতা ছিলেন যার জন্য তাকে এভাবে অত্যাচার করা হতো; যাতে তার কাছ থেকে কোনো গুরুত্বপুর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু আপনাকে কাশ্মিরের অবস্থা আগে বুঝতে হবে। এখানে প্রত্যেকটি মানুষ, প্রত্যেকটি নারী এমনকি শিশু পর্যন্ত আন্দোলন সম্পর্কে কিছু না কিছু জানে। যদি তারা এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত না থাকে তবুও। ভারতীয় বাহিনী এখানে গোয়েন্দা তৈরি করে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইকে দাড় করাতো; স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীকে। আফজাল এটা চায়নি। তিনি সবার সাথে মিলেই বাঁচতে চেয়েছিলেন যে সুযোগটা এসএফটি তাকে দেয়নি।
আপনারা হতো এটাও জেনে থাকবেন কিভাবে এসটিএফ কাশ্মিরের সাধারণ মানুষদের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার করে মুক্তিপণ আদায় করে থাকে। এবং যখন মুফতি সাইদ মুখ্যমন্ত্রী হন তখন তার নির্বাচনী ইশতেহারে এই ফোর্সকে কাশ্মীরে নিষিদ্ধ করে দেয়ার অঙ্গীকার করেন যাতে করে এসটিএফ আরো হিংস্র হয়ে ওঠে। এছাড়াও কাশ্মিরে তারা হত্যা, অন্যায়ভাবে জেলে নিয়ে মারধর এবং অমানবিক অত্যাচারসহ বিভিন্ন প্রকার মানবতা-বিরোধী অপরাধের সাথে যুক্ত।
এই অবস্থায় আফজাল নিজের ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। সে পরিবার নিয়ে দিল্লিতে চলে আসেন। এর কিছুদিন পর আমাকে এবং আমাদের চার বছর বয়সী ছেলে গালিবকেও দিল্লিতে নিয়ে আসেন। এখানে আমরা অন্য পাচটা পরিবারের মত স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমাদের সন্তানের ভালো শিক্ষা দিয়ে তাদের মানুষের মত মানুষ হিসেবে বড় করার স্বপ্ন দেখতে থাকি। কিন্তু সেই স্বপ্নটাও ভেঙ্গে যায় যখন আমার স্বামী আবারো দিল্লি থেকে গ্রেফতার হয়।
শেষ পর্যন্ত এমন একজনকে আদালত আমার স্বামীর পক্ষে ওকলাতি করার জন্য নিয়োগ করা হল যিনি যুক্তিতর্ক করার বিপরীতে আফজালকে অপরাধী প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে লাগলেন
এসটিএফ অভিযোগ করলো; আমার স্বামী মোহম্মাদ নামে একজনকে কাশ্মির থেকে দিল্লিতে এনেছিলো। ঘটনাটা হলো মোহম্মদ এবং আরেকজন লোক যার নাম তারিক তাদের সাথে আমার স্বামীর দেখা হয়েছিলো এসটিএফ এর ক্যাম্পে। এর আগে আমার স্বামী তাদের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। তাকে কেনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে সে কিছুই জানতেন না। এ সব কথাই আমার স্বামী আদালতে বলেছিলেন। কিন্তু আদালত তার কথার অর্ধেকটা শুনলো। আদালত এটা মেনে নিলো যে মোহাম্মাদকে আনার পিছনে আমার স্বামীর হাত ছিলো; কিন্তু আদালত এটা শোনে নি যে এসব কিছুই ঘটেছিলো এসটিএফের ইশারায়।
আমার স্বামীর হয়ে কোর্টে দাড়ানোর জন্য কেউ ছিলো না। শেষ পর্যন্ত এমন একজনকে আদালত আমার স্বামীর পক্ষে ওকলাতি করার জন্য নিয়োগ করা হল যিনি যুক্তিতর্ক করার বিপরীতে আফজালকে অপরাধী প্রমানের জন্য লেগে পড়লেন। তিনি ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক আর আমার স্বামীর ওপর ছিলো তার প্রবল ঘৃণা। আমার স্বামী যখন বিচারপতি ধিংরার কাছে আইনজীবি নিতে অস্বীকার করেন তখন বিচারক তার কথার মূল্য দেয়নি। এমনকি আমার স্বামী যখন কোর্টের সামনে কিছু বলতে চেয়েছিলেন তখন আদালত তাকে সেই সুযোগও দেয়নি। আদালত আমার স্বামীর ব্যাপারে খোলাখুলিভাবেই বৈষম্যমুলক আচরণ করেছে।
এমন সময়ে হাইকোর্টে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা একজন আইনজীবী আমার স্বামীর হয়ে কোর্টে দাড়াতে চাইলে আমার স্বামী রাজি হন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তিনি আমার স্বামীর হয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন না করে আমার স্বামীর মৃত্যুদন্ড কিভাবে কার্যকর করা হবে সেসব নিয়ে যুক্তি দিতে থাকেন। তিনি আফজালকে মরণঘাতী ইনজেকশন দিয়ে মৃত্যু কার্যকর করার প্রস্তাব করেন। আমার স্বামী কখনোই মরতে চাইতেন না। তিনি তো এসটিএফের হয়েই কাজ করেছিলেন। এসব দেখে আমার স্বামী অবাক হয়েছিলেন কিন্তু তখন আইনজীবী পরিবর্তন করার কোনো উপায় ছিলো না। কারণ তখন তিনি উচ্চ নিরাপত্তা সম্বলিত জেলে বন্দি ছিলেন। এভাবে উচ্চ আদালত আমার স্বামীর বিরুদ্ধে রায় দেয়ার পর মামলা সুপ্রিম কোর্টে চলে যায়। আমার স্বামী বুঝতে পারেন সুপ্রিম কোর্টেও তাকে একই আইনজীবি দেয়া হবে। তিনি এই আইনজীবি নিতে অস্বীকার করে আপিল করেন। আমার পক্ষে নতুন আইনজীবি নিয়োগ করা সম্ভব ছিলো না। আমি দিল্লিতে কাউকেই চিনতাম না। শেষ পর্যন্ত আফজাল গুরু ডিফেন্স কমিটির কাছে জনাব গিলানীকে নিয়োগ দেয়ার দাবি করলেন। আমি এই চিঠি যুক্ত করে দিলাম। এবং ডিফেন্স কমিটি আফজালকে সাহায্য করে সুশীল কুমার নামে একজন সিনিয়ার আইনজীবিকে তার পক্ষে নিযুক্ত করতে রাজি হন। যাইহোক আদালত আমার স্বামীর পক্ষে উপস্থাপিত যুক্তি প্রমান কিছুই দেখেনি। আমি সত্যিই জানি না আদালত কেনো এটি করেছিলো।
আমি আপনাদের কাছে আমার স্বামীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি করছি। নিশ্চয়ই আপনারা চিন্তাশীল মানুষ এবং আপনারা কি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে একজন মানুষের কথা শোনার আগেই তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়াকে সমার্থন করতে পারেন? পুলিশ এবং মিডিয়া তার বিচার শুরুর আগেই ভুলভাবে তার কথা প্রচার শুরু করে। তাকে মারধর করে এবং বিভিন্নভাবে তার উপর অত্যাচার নির্যাতন করে। এমন কি তার মুখের মধ্যে প্রস্রাব পর্যন্ত করে দেয়। আপনাদের সামনে এভাবে কথা বলতেও খুব লজ্জা করছে; কিন্তু এটা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলো না। আমার কাছে কাগজে এসব লেখা অনেকটা অভিশাপের মতো। কিন্তু আমার ছয় বছর বয়সী সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে লিখতে হচ্ছে।
আপনারা কি আমার স্বামীর সাথে ঘটতে যাওয়া অবিচার নিয়ে কিছু বলবেন না? আমার হয়ে আপনারা কেউ কি দাঁড়াবেন না? আমি ঠিকই আমার স্বামীর জন্যে লড়ে যাবো। লড়ে যাবো আমার সন্তানের বাবার জীবনের জন্যে। কিন্তু আমি একজন কাশ্মিরী নারী হিসেবে বলছি, ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার উপর সকল বিশ্বাস আমি হারিয়ে ফেলেছি। বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি কাশ্মিরী মুসলিমদের উপর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে এমন স্বপ্ন দেখার উপর।