অপারেশন ‘থ্রি-স্টার’ ও একজন গালিব গুরু

অপারেশন ‘থ্রি-স্টার’ ও একজন গালিব গুরু

এক.

ভারতের মাটিতে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ কাশ্মিরী চির নিদ্রায় শায়িত হয়ে আছেন। এরা হলেন ইউসুফ শাহ চাক, মকবুল বাট এবং আফজাল গুরু।

এই তিনজনই কাশ্মিরীদের আজাদির আন্দোলনের তিন গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক এখন। যদিও প্রথম দুই জনের তুলনায় তৃতীয় জনের প্রতীকী উত্থান অনেকটাই ভিন্ন সূত্রে। ভিন্ন প্রক্রিয়ায়।

ইউসুফ শাহ চাক হলেন কাশ্মিরের শেষ স্বাধীন শাসক। ১৫৮৬ সালে আলোচনার কথা বলে দিল্লিতে ডেকে এনে মোগলরা তাঁকে বন্দি করে এবং সেই থেকে আজো কাশ্মির দিল্লির অধীন। ইউসুফ শাহ চাকের কবর রয়েছে বিহারের বিশয়ক গ্রামে ১৬০৯ সালে তিনি সেখানে মারা যান।

মকবুল বাট হলেন কাশ্মিরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেয়া সংগঠন জম্মু-কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্ট বা জেকেএলএফ-এর সামরিক ও রাজনৈতিক কাজের মুখ্য সমন্বয়ক। কাশ্মিরী অনেকে তাঁকে স্বাধিকার আন্দোলনের জনক হিসেবেও অভিহিত করে। ১৯৭৬-এর ৭ জুন তাঁকে আটক করতে সমর্থ হয়েছিল ভারত। ১৯৮৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দিল্লির তিহার জেলে তাঁকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয় এবং জেলের ভেতরই তাঁকে কবর দেয়া হয়। ফাঁসি দেয়ার পূর্বে পরিবারের সদস্যদেরও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি।

স্ত্রীকে লেখা আফজাল গুরুর শেষ চিঠি। সূত্র: ইন্টারনেট।

 

মকবুল বাটের মতোই আফজাল গুরুর লাশও তাঁর পরিবারকে ফেরত দেয়া হয়নি। এমনকি তাঁকে যে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে সেই তথ্যও তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছানো হয় ঘটনার দুই দিন পরে। তাঁর লাশও ভারত সরকার তিহার জেলেই রেখে দেয় এবং ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরই কাশ্মিরে জারি হয় কারফিউ, বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট সার্ভিস।

যদিও ইউফুফ শাহ ও মকবুল বাট যেরূপ ব্যাপক পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন আফজাল গুরু তা ছিলেন না। বরং ভারতের নীতিনির্ধারকদের ক্রুদ্ধ কাশ্মির-বিদ্বেষ এবং কাশ্মিরীদের জন্য ন্যায়বিচার না থাকার এক প্রতীকী দৃষ্টান্ত হয়ে আফজাল গুরু মারা যান এবং মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তিনি কাশ্মিরের আজাদির আন্দোলনের জীবন্ত এক প্রতীকে পরিণত হন। উপরন্তু ইউসুফ চাক বা মকবুল বাটের ক্ষেত্রে যা হয়নি আফজাল গুরুর ক্ষেত্রে তাই ঘটে। ভারত জুড়ে এই অন্যায় ও অমানবিকতায় তীব্র ধিক্কার ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশেষ করে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে তরুণরা, অরুন্ধতি রায়, প্রফুল বিদওয়াইসহ অনেক লেখক-সাংবাদিক আফজাল গুরুর বিচার প্রক্রিয়া ও ফাঁসি নিয়ে আইনগত ও রাজনৈতিক প্রশ্ন তোলেন। এসব সামাজিক প্রতিবাদ ঘটনার পাঁচ বছর পর এখনও তীব্রভাবে জারি রয়েছে।

দুই.

কাশ্মিরের বারামুল্লা জেলায় জন্ম নেয়া আফজাল গুরু দিল্লিতে একটি ওষুধ কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। ২০০১-এর ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবনে এক হামলার পর আফজাল গুরুকে আটক করা হয়। এই ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়েছিলেন। যদিও পার্লামেন্টের ঐ আক্রমণকারী পাঁচজনই ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছিল কিন্তু দিল্লি পুলিশ ঘটনার দুদিন পর দাবি করে যে, এই ঘটনায় আফজাল গুরুর সংযোগ ছিল; তিনি আক্রমণকারীদের সহযোগিতা করেছেন। ঘটনার দুই দিন পর তাঁকে কয়েকজন নিকটাত্মীয়সহ কাশ্মিরের প্রধান শহর শ্রীনগর থেকে আটক করা হয় এবং চরমভাবে বিতর্কিত এক বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকালে ফাঁসি দেয়া হয় তিহার জেলে। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতে এই মামলার অন্য অভিযুক্তদের মৃত্যুদন্ড বাতিল হলেও আফজাল গুরুর দন্ড বহাল রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকা কিংবা কোন ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনে যুক্ত থাকার কোন প্রমাণ তো দূরের কথা, সরাসরি হামলার ‘ষড়যন্ত্রে’ যুক্ত থাকারও কোন প্রমাণ মেলে নি। কেবল বলা হয় ‘সামগ্রিক ঘটনাবলী থেকে মনে হয়েছে আফজাল গুরু এই ঘটনায় জড়িত’। এইরূপ দুর্বল অভিযোগে ফাঁসির রায় নিয়ে সেসময় মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রশ্ন তোলে এবং ফাঁসির আদেশ বাতিলের জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছে আবেদনও জানায়। তবে একই সময়ে ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন ব্যক্তি, দল ও প্রচারমাধ্যম দ্রুত আফজাল গুরুকে ফাঁসি দেয়ারও দাবি জানাতে থাকে। ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকা এসময় এক জরিপ চালিয়ে এই মর্মে তথ্য প্রকাশ করে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় আফজাল গুরুর ফাঁসির পক্ষে। বিজেপি নেতা আদভানী লোকসভায় দাঁড়িয়ে এই ফাঁসি বিলম্বিত করার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন, অথচ তখনও প্রেসিডেন্টের কাছে আফজালের সাজা মওকুফের আবেদন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল। স্বভাবত ফাঁসির পক্ষে এরূপ প্রচারণা ও চাপ ছিল কার্যত বিচারিক হত্যাকে ন্যায্যতা দেয়ার লক্ষ্যে। এমনকি এই ফাঁসির পর দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদী দলগুলো উৎসবের আয়োজন করেছিল। এইরূপ বিভিন্ন উপলক্ষ্য ও আয়োজন সাক্ষী দিচ্ছিলো, ভারতীয় শাসক এলিটদের জন্য আফজাল গুরু হয়ে উঠেছিলেন হিন্দুদের মাঝে মুসলমান ঘৃণার জাগরণ ঘটানোর জন্য এক দারুণ রাজনৈতিক পণ্য।

তিন.

ভারতের বিভিন্ন স্থানে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ ঠেকাতে ব্যর্থ পুলিশের জন্য আফজাল গুরুর আটক ও বিচারের ঘটনাটি পেশাগত ‘সুনাম’ রক্ষার এক মরিয়া চেষ্টাও ছিল। বিচারালয়ে শুরুতে পুলিশ দাবি করে, আফজাল এই ঘটনায় যুক্ত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কিন্তু আফজাল এই স্বীকারোক্তির সত্যতা অস্বীকার করে বলেন, তিনি কথিত স্বীকারোক্তিতে বাধ্য হয়ে স্বাক্ষর করেছিলেন, কারণ স্বাক্ষর না করলে তাঁর পরিবারকে হুমকি দেয়া হচ্ছিলো। এছাড়া রিমান্ডে তাঁকে ব্যাপক নির্যাতন করা হচ্ছিলো। সে কারণেই তিনি উক্ত স্বীকারোক্তিতে সম্মতি দিয়েছিলেন। এই ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য খ্যাতি পাওয়া ‘দ্য কারাভান’-এর সম্পাদক বিনোদ যোসেফও একই তথ্য জানিয়েছেন তাঁর রিপোর্টে। আফজালের পক্ষে আইনগত লড়াই চালানোর জন্য যেসব আইনজীবী আগ্রহী হতেন; তাদের অনেকেই বাদীপক্ষের এজেন্ট ছিলেন বলেও পরবর্তীকালে খবর মেলে।

তবে একই সময়ে ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন ব্যক্তি, দল ও প্রচারমাধ্যম দ্রুত আফজাল গুরুকে ফাঁসি দেয়ারও দাবি জানাতে থাকে। ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকা এসময় এক জরিপ চালিয়ে এই মর্মে তথ্য প্রকাশ করে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় আফজাল গুরুর ফাঁসির পক্ষে।

গত পাঁচ বছরের বিভিন্ন লেখা, সাক্ষাৎকার এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা থেকে আফজাল গুরুর ফাঁসির অধ্যায় নিয়ে বিস্ময়কর অনেক তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। প্রচারমাধ্যম সূত্রেই জানা যায়, এই ফাঁসি কার্যক্রমের ভারতীয় ‘কোড নেইম’ ছিল ‘অপরাশেন থ্রি-স্টার’। এইরূপ তথ্য থেকে স্পষ্ট, একজন নাগরিকের বিচার কার্যক্রমকে ভারতের প্রশাসন তখন একটি ‘অপারেশন’ হিসেবে গণ্য করছিল এবং অন্যান্য ফাঁসির ক্ষেত্রে যা ঘটে, সেই রূপ অনেক প্রথা ও নিয়ম-কানুনেরই ব্যত্যয় ঘটে আফজালের ক্ষেত্রে। কেবল যে তাঁর পরিবারকেই ফাঁসির পূর্বে অন্ধকারে রাখা হয় তাই নয়; জেলকর্তৃপক্ষ এই মর্মে সাধারণ কোন ঘোষণাও দেয়নি; সচরাচর যা ঘটে অন্যান্য ফাঁসির পূর্বে। নাম প্রকাশে একজন কর্মকর্তা পরবর্তীকালে এও জানান, এই ফাঁসির জন্য শুক্রবারের পরের দিনকে বেছে নেয়া হয়েছিল যাতে কাশ্মিরে জুম্মার নামাজের পর বিক্ষোভ কর্মসূচি এড়ানো যায়।

তবে আফজাল গুরুর মৃত্যুতে পুরো কাশ্মির জুড়ে চারদিন শোক দিবস হিসেবে পালিত হয় এবং আফজালের নিজ বাসভূমে এই ঘটনা যে চিরস্থায়ী শোক ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে সেটা বোঝা যায় যখন ২০১৪-এর ডিসেম্বরে ফাঁসির কিছুদিন পর কাশ্মিরে নির্বাচন হয় তখন ঝিলাম নদীর পাড়ে আফজালদের গ্রাম জাগীর হাট কেন্দ্রে ৪৬৮ জন ভোটারের মধ্যে মাত্র দুটি ভোট পড়েছিল। বস্তুত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি প্রত্যাখ্যানের এই চিত্র কাশ্মিরে আজাদির সংগ্রামে কেবল যে নতুন পথের ইঙ্গিত দিচ্ছিলো তাই নয়, এ যেন ফাঁসির মঞ্চে আফজাল গুরুর পূর্বসূরি মকবুল বাটের জীবনদানের ন্যায্যতাও জানিয়ে দিচ্ছিলো।

ফাঁসির পূর্বে পরিবারের উদ্দেশ্যে ৪৩ বয়সী গুরু লিখেছিলেন, ‘আমি তোমাদের বলে যাচ্ছি, ফাঁসি দেয়ার এই পূর্ব মুহূর্তে চিঠি লেখার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও দেয়া হয়নি আমাকে। আমি খোদার কাছে কৃতজ্ঞ, হয়তো তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাবাস্সুম ও গালিবকে দেখবে।’

ইতিহাস ও নিয়তির এক বড় বিস্ময় এই যে, পিতার ৫ম মৃত্যুবাির্ষকীর ঠিক পূর্বে গত মাসে কাশ্মিরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ফলাফলে আফজাল গুরুর পুত্র গালিব গুরু ব্রিলিয়ান্ট এক রেজাল্ট করে সমগ্র ভ্যালিকে জানিয়ে দিল নয় দশকের সংগ্রাম শেষেও কাশ্মিরীরা মনোবল হারাতে নারাজ।

আফজাল গুরুর নামে নামফলক।  সোর্সঃ ইন্টারনেট

পুনশ্চ:

শ্রীনগরের ঈদগা সংলগ্ন একটি কবরস্থান রয়েছে আজাদির আন্দোলনের শহীদদের জন্য। স্থানীয়রা একে বলে ‘মাজার-ই-শুহাদা’। এখানে ইতোমধ্যে প্রায় এক হাজার শহীদ কবরস্থ হয়েছে। কিন্তু দুটি কবরের পাশে ফলক থাকলেও তাতে কোন লাশ নেই। এই দুটি কবর ফাঁকা হলেও মার্বেল পাথরের ফলক লাগিয়ে রাখা হয়েছে। একটি কবর রাখা হয়েছে মকবুল বাটের জন্য, আরেকটি আফজার গুরুর জন্য। কাশ্মিরী তরুণরা বিশ্বাস করে একদিন তারা তিহার জেল থেকে এই দুই জনের মরদেহ কাশ্মিরী আনতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে, ইউসুফ শাহ’র কবর কাশ্মিরে আনার জন্যও একটি সামাজিক আন্দোলন রয়েছে কাশ্মীরে।

২ thoughts on “অপারেশন ‘থ্রি-স্টার’ ও একজন গালিব গুরু

কমেন্ট বন্ধ।