বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা রকেট টেস্ট সিরিজ
দ্বিতীয় টেস্ট, ১ম দিন
মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ঢাকা
• ২২২ রানে শেষ লঙ্কানদের প্রথম ইনিংস
• ৬৩/৪; টেস্টে ইনিংসে আব্দুর রাজ্জাকের সেরা বোলিং
• ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয়বারের মত কোনো ইনিংসের প্রথম দুই ওভার বল করলেন দুই স্পিনার। ১৯৬৪ সালে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্টে প্রথম দেখা গিয়েছিলো এ দৃশ্য
• তামিমকে ফিরিয়ে টেস্টে নিজের ১০০তম উইকেট তুলে নিলেন লকমল
• প্রথম দিন শেষে স্কোর: শ্রীলঙ্কা ২২২; বাংলাদেশ ৫৬/৪
প্রথম সেশন
দু-প্রান্ত থেকে আজকে স্পিনার দিয়ে দিন শুরু করে বাংলাদেশ। এক পাশে মেহেদী মিরাজ, অপর পাশে চার বছর পরে দলে ফেরা আব্দুর রাজ্জাক। প্রথম ওভার থেকেই ব্যাটসম্যানদের চাপে রেখে বল করা শুরু করেন মিরাজ। পাল্টা আক্রমণে তার বেশ জবাব দিয়েছেন মেন্ডিস। কিন্তু অপর প্রান্তে গত টেস্টের একমাত্র ব্যর্থ করুণারত্নেকে এদিনও অস্বস্তিতে ভুগতে দেখা যাচ্ছিলো। অস্বস্তিকর অবস্থায় মাঠে থাকার যন্ত্রনা থেকে তাকে মুক্তি দেন আব্দুর রাজ্জাক। রানের জন্য মরিয়া করুণা চেষ্টা করেছিলেন ডাউন দ্য ট্র্যাকে গিয়ে আক্রমণ করার। চেষ্টার খেসারত তিনি দিয়েছেন লিটনের হাতে স্ট্যাম্পিং হয়ে। শ্রীলঙ্কার রান তখন মাত্র ১৪ আর করুণার ৩। উইকেট হারানোর পরে যেন আরো অাক্রমণাত্বক হয়ে ওঠেন মেন্ডিস। প্রায় প্রতি ওভারেই আসছিলো বাউন্ডারি। ধণাঞ্জয়াকে নিয়ে দ্রুতই গড়ে তোলেন ৪৭ রানের জুটি। এ জুটি জমে ওঠার আগেই আঘাত হানেন তাইজুল। চমৎকার এক ডেলিভারিতে সাজঘরে ফেরান ১৯ রান করা ধণাঞ্জয়াকে। দলের রান তখন ৬১। ১৬.৩ ওভারেই দু উইকেট হারিয়ে ফেললেও ব্যাটিংয়ের ধরণে কোনো পরিবর্তন আনেননি মেন্ডিস। দ্রুতই নব্বইয়ের ঘরে পৌছে যায় লঙ্কানরা। ব্যাটিংয়ের ধরণে মনে হচ্ছিলো প্রথম সেশনটা শেষ হবে লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের শাসনেই। কিন্তু লাঞ্চের ঠিক আগ মুহুর্তেই সে ধারণাকে নির্বাসনে পাঠান রাজ্জাক। নিজের দ্বিতীয় স্পেলের প্রথম বলেই ফেরান গুণাথিলাকাকে। মিড অফে মুশফিকের চমৎকার এক ক্যাচে পরিণত হবার আগে তিনি করেন ১৩ রান। চমক তখনো শেষ হয়নি। পরের বলেই চমৎকার এক ডোলিভারিতে বোল্ড করেন লঙ্কান অধিনায়ক চান্দিমালকে। রাজ্জাকের বলটির কোনো জবাবই ছিলো না চান্দিমালের কাছে। দুই উইকেটে ৯৬ থেকে মুহুর্তেই চার উইকেটে ৯৬ এ পরিণত হয় শ্রীলঙ্কার স্কোর। তার পরের ওভারেই আরো একবার উল্লাসে মাততে পারতো বাংলাদেশ। তাইজুলের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন রোশান ডি সিলভা। সাব্বির ক্যাচটি নিলেও বল তার হাতে জমা পরার আগে মাটি স্পর্শ করার সে যাত্রায় রক্ষা পায় লঙ্কা, রক্ষা পান রোশান। তার বেশ কিছুক্ষন আগেই নিজের অর্ধশতক তুলে নিয়েছেন মেন্ডিস। সেশনের শুরু আর শেষ পুরোটাই রাজ্জাকময়। মাঝে মেন্ডিসের একার লড়াই। তবে এই সেশনটা পুরোটাই আব্দুর রাজ্জাকের। সেশন শেষে রোশান আর মেন্ডিস অপরাজিত ছিলেন যথাক্রমে ৫ এবং ৬৪ রানে।
প্রথম সেশন শেষে স্কোর : শ্রীলঙ্কা ১০৫/৪
সেশন হিরো : আব্দুর রাজ্জাক

দ্বিতীয় সেশন
সেশনের প্রথম বলেই চার মেরে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার বার্তাই যেন দিতে চেয়েছিলেন মেন্ডিস। কিন্তু চার খাওয়ার ঠিক পরের বলেই মেন্ডিসের লড়াইয়ের ইতি টানেন রাজ্জাক। সকাল থেকে দুর্দান্ত বোলিং করা রাজ্জাকের চতুর্থ শিকারে পরিণত হন মেন্ডিস। ৬৮ রানে থামে লঙ্কান ওপেনারের ইনিংসটি। তার পরের ওভারেই আবোরো অঘাত হানে বাংলাদেশ। এবার হন্তারক তাইজুল। এর রানেই ফিরে যেতে বাধ্য করেন ডিকেওয়ালাকে। অল্প রানেই গুটিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক চেপে বসা লঙ্কানদের হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন রোশান এবং দিলরুয়ান পেরেরা। দলের ১৪৩ এবং নিজের ১৮ রানেই ফিরতে পারতেন পেরেরা। মোস্তাফিজের বলে দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্লিপ ফিল্ডারের অভাবে যাকে দলে নেয়া, সে সাব্বিরই ফেলে দেন সহজ একটি ক্যাচ। সুযোগ পাওয়ার পর দেখেশুনেই দলকে টানতে থাকেন পেরেরা-রোশান। বাংলাদেশের হতাশা বাড়িয়ে গড়ে তুলেন পঞ্চাশ রানের জুটি। সিলি পয়েন্টে তাইজুলের বলে মুমিনুলের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন পেরেরা। বাংলাদেশের আবেদনে সাড়া দিয়ে আম্পায়ার আঙ্গুল তুললে রিভিও নেন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, রিভিওতে আম্পায়ারে সিদ্ধান্ত বহাল থাকায় সাজ ঘরের পথ ধরতে বাধ্য হন পেরেরা। ভাঙ্গে ৫২ রানের জুটি। ফেরার আগে পেরেরা করেন ৩১ রান। এরপর আবার অপেক্ষার পালা। বাংলাদেশের হতাশার মাত্রায় বাড়তি পালক যোগ করে আকিলা ধণাঞ্জয়াকে নিয়ে আরো একটি কার্যকর জুটি গড়ে তোলেন রোশান। এ জুটি ভাঙ্গতে না পারার হতাশা নিয়েই যথন সেশন শেষ করার পথে বাংলাদেশ তখই আঘাত হানলেন মোস্তাফিজ। স্লোয়ারে বিভ্রান্ত আকিলা ক্যাচ দেন কাভারে। চমৎকারভাবে সেটি তালুবন্দি করেন মুশফিক। ২০ রান করা আকিলার বিদায়ের সাথে সাথেই শেষ হয় সেশনের খেলা। মাঝে দুটি জুটি বাংলাদেশের জন্য হতাশার হলেও সেশনটি খুব একটা খারাপ যায়নি। শুরু আর শেষের একটি সহ চারটি উইকেট তুলে নেয়ায় সেশনটা বেশ ভালোই গিয়েছে বলা যায়।
সেশন শেষে স্কোর : শ্রীলঙ্কা ২০৫/৮
সেশন হিরো :
তৃতীয় সেশন
২০৫ রানে দ্বিতীয় সেশন শেষ করা শ্রীলঙ্কা আবারো সেশনের শুরুতেই উইকেট হারায়। ২০৫ এর সাথে দুই রান যোগ করে ফিরে যান হেরাথ। মোস্তাফিজের স্লোয়ারে বিভ্রান্ত হয়ে মুশফিকের হাতে লোপ্পা একটি ক্যাচ তুলে দেন তিনি। ফেরেন মাত্র দুই রান করে। লঙ্কানদের প্রথম ইনিংস শেষ করতে আর বেশী সময় নেয়নি বাংলাদেশ। দলীয় ২২২ রানের সময় তাইজুলের বলে লিটনের হাতে রোশান ক্যাচ দিলে শেষ হয় শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস। আউট হওয়ার আগে রোশান খেলেন ৫৬ রানের একটি কার্যকর ইনিংস। বাংলাদেশের হয়ে রাজ্জাক-তাইজুল চারটি এবং মোস্তাফিজ দুটি করে উইকেট নেন। লঙ্কানদের অল্প রানে বেঁধে ফেলার আনন্দ দিয়ে মাঠে নামে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় বলেই তামিম চার মেরে রানের খাতা খুললে হাসি চওড়া হয় সবার। কিন্তু হাঁসিমুখে আধার নামতে সময় লাগেনি মোটেও। পরের বলেই লকমলের হাতে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তামিম। প্রথম টেস্টের নায়ক মুমিনুলও ফিরে যান কোনো রান না করেই। সহজ একটি সিঙ্গেল আয়েসি ভঙ্গিতে নিতে গিয়ে নিজের এবং দলের বিপদ ডেকে আনেন মুমিনুল। ডি সিলভার থ্রো যখন ডিকেওয়ালা গ্লাভসে তখন ক্রিজের দাড়প্রান্তেই ছিলেন তিনি। কিন্তু ব্যাট মাটির বদলে শূণ্যে তুলে রেখে জোড়া সেঞ্চুরির পর প্লাটিনাম ডাকের বিভীষিকা নিয়ে মাঠ ছাড়েন মুমিনুল। এরপর টিকে থাকার যুদ্ধ শুরু করেন মুশফিক-ইমরুল। লঙ্কানদের নিখুঁত লাইন লেন্থের সামনে বেশ অসহায় দেখাচ্ছিলো দুজনকেই। পেরার বলে ফিল্ডারদের আবেদনে আঙ্গুল তুলে দিয়েছিলেন আম্পায়ার। তখনো দলের রান মাত্র ১০। কিন্তু রিভিও নিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পান মুশফিক। লকমল নির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা নিয়ে বোলিং করছিলেন মুশফিককে। দু দফা লিভ দিয়ে রক্ষা পেলেও প্রায় একই রকম আরো একটি ডেলিভারি একই ভঙ্গিমায় খেলতে গিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনেন মুশফিক। লকমলের প্রায় গুড লেংন্থ এর একটি বলে ব্যাট তুলে রেখে বোল্ড হন তিনি। মুশফিকের মত অভিজ্ঞ একজনের এমন ভুলটা বেমানান। বাইরে থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো লকমলের পরিকল্পনাটি কি। দুবার রক্ষা পেলেও তা থেকে কোন শিক্ষা না নিয়ে নিজের উইকেটটি একরকম উপহারই দেন তিনি। প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো মুমিনুলের আউট হবার ধরণটাও। টেস্টে এমন ক্যাজুয়ালভাবে আউট হওয়া খুবই দৃষ্টিকটূ। দিনের শেষভাগে প্রায় প্রতি ওভারেই উইকেটের জন্য আবেদন করছিলো লঙ্কানরা। তাতে খুব একটা কাজ না হলেও একদম শেষভাগে আসে সাফল্য। খেলা শেষ হবার আড়াই ওভার আগে ইমরুলের বিপক্ষে আরো একটি জোড়ালো আবেদনে আঙ্গুল না তুলে পারেননি আম্পায়ার। এবার রিভিও নেন ইমরুল। কিন্তু এবার ভাগ্য ছিলো লঙ্কানদের পক্ষে। পেরেরার বলে ১৯ রান করে লেগ বিফোর হয়ে ফিরেন তিনি। আর কোনো বিপদ হতে না দিয়ে মিরাজকে নিয়ে দিন শেষ করেন লিটন। দিন শেষে লিটন আর মিরাজ অপরাজিত ছিলেন যথাক্রমে ২৪ এবং ৫ রানে। দিনের শুরুটা যদি হয় বাংলাদেশের শেষটা চোখ বুজেই শ্রীলঙ্কার। প্রথম দিন শেষে এইটা স্পষ্ট যে ঢাকা টেস্টে ফল আসছেই। সেটি নিজেদের পক্ষে টেনে নিতে হলে সামর্থ্যের সবটুকুই যে ঢেলে দিতে হবে বাংলাদেশের সেটি বোধ করি আর না বললেও চলে।
তৃতীয় সেশন শেষে স্কোর : শ্রীলঙ্কা ২২২; বাংলাদেশ ৫৬/৪
সেশন হিরো : সুরাঙ্গা লকমল