ঢাকার রাস্তায় আলাদা ভিআইপি লেইন নির্মাণ নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম যে প্রস্তাবটি সবার নজরে এনেছেন সেটিকে আমি অভিআইপি হিসেবে খুব একটা খারাপ চোখে দেখছি না। উল্টো সাধুবাদই জানাতে হয়। তার প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে অনেক দেরিতে হলেও ভিআইপিদের চলাচলের জন্য আলাদা রাস্তা নির্মাণ দেখতে পাবে বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে ঢাকাবাসী। এর মধ্যে মেট্রোরেল নির্মাণের কসরত দেখতে গিয়ে ঢাকার অর্ধাংশ অচল হয়ে রয়েছে। বিশেষ করে মিরপুরের বাসিন্দারা ওই উন্নয়নের অভিশাপে আজ দিশাহারা। অন্যদিকে নিচের রাস্তা যাচ্ছেতাই রেখে ফ্লাইওভার ব্রিজ করে জ্যামটি আকাশে তুলে দেয়া হয়েছে। কাজেই এত উন্নয়নের পরও ভিআইপিদের জন্য তো বিশেষ কিছু করা হলাে না। এবার আলাদা লাইন বাস্তবায়ন করে যদি বিশেষ কিছু ওনাদের জন্য করা যায় তাহলে সাধারণ ‘প্রজারা’ও খুশি হবে। এতে অন্তত ভিআইপিদের সুখ দেখার আনন্দ মিলবে।
ভিআইপিদের জন্য বিশেষ রাস্তা নির্মাণের অনেক সুবিধা আছে। প্রথম সুবিধা হলাে, ভিআইপি রাস্তা ব্যবহারের লোভে অনেকেই হয়তো নতুন ভিআইপি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করবেন। বাংলাদেশের মেহনতি কৃষক, কামার, জেলে, ক্ষেতের মজুর- সবাই দলে দলে শহরে এসে ভিড় করবেন ভিআইপি রাস্তার চাকচিক্যময়তা দেখার জন্য। যানজটমুক্ত এলাকা দেখে তারা ভুলে যাবেন জীবনের সব ব্যর্থতা, হতাশা অথবা নৈরাশ্যবাদী চিন্তা। ভিআইপি রাস্তার আদল হতে পারে ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজধানী লখনৌ-এর মতাে। বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতি যেভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতায় এলেন আর এসেই আম্বেদকার-এর নামে ৭ বিলিয়ন ভারতীয় রুপি খরচে পাথরের হাতি পার্কে বসানোর জন্য সব শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন ওই রকমের একটি প্রকল্পের কাজ বর্তমান সরকার হাতে নিতে পারে। আবার নতুন নির্মিত ভিআইপি রাস্তার নামকরণ করা যেতে দেশের ভিআইপিদের নামে। তাহলে ভিআইপিরা মনে মনে ভাবতে পারতেন নিজের রাস্তা দিয়েই তো চলাচল করছেন, এতে কার বাপের কী?
আবার মায়াবতি যেমন ভারতের সংবিধান প্রণেতা আম্বেদকার-কে নামকরণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন তেমুন আমরাও তার চেয়ে উঁচু মাপের কোনাে নেতাকে ভিআইপি সড়কের নামকরণের জন্য খুঁজতে পারি। উপযুক্ত নাম পেয়ে গেলে এবং রাস্তা ওই নামে ফলক হলে কারো মুখে নেতিবাচক কথা শুনতে হবে না। দুই কূলের মাঝি নিয়ে সরকারও নিরাপদে যাত্রা শুরু করতে পারবে। ওই ভিআইপিদের সুবিধা দেয়ার জন্য অচল নগরেও নব উন্নয়নের দেখা মিলবে। এরই ধারাবাহিকতায় আসতে পারে নোবেলও। আর নন-ভিআইপি যারা এ কাজে সর্বাত্মক সহায়তা করছেন কিংবা অন্তত নীরব থাকছেন তারা পেতে পারেন গান্ধীবাদী পুরস্কার। কাজেই এটিকে ছোট করে দেখার সুযোগ কই?
ভিআইপি রাস্তা যে কত গুরুত্বপূর্ণ ওই ব্যাখ্যা শুধু কলাম লিখে শেষ করা যাবে না। আর্থসামাজিকভাবে বাংলাদেশ কত উন্নতি করেছে সেটি বুঝতেও ওই সড়ক নির্মাণ সময় উপযোগী ও বাস্তবসম্মত। আর নগর জীবন সব সময়ই আলাদা। গ্রামের মানুষের সঙ্গে নগরবাসীর পার্থক্য বহু পুরনো। আপনার এনলাইটেন্টমেন্টও ওই দূরত্ব কমাতে পারেনি। এখন ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষকে যদি ভিআইপি আর নন-ভিআইপি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা না যায় তাহলে কিসের আর উন্নয়ন! আমেরিকার মতাে বাংলাদেশে তো আর ‘আমরা ৯৯ শতাংশ’ বলে কেউ চেঁচামেচি করতে আসবেন না। আসলেও কি রাষ্ট্রের কামান-গোলার কোনাে অভাব আছে? আর ওই ৯৯ শতাংশওয়ালাদের থামানোর জন্য ঢাকার আশপাশে কিছু কারাগার তৈরি করলেই হয়। বিপুল প্রজাকে (ইচ্ছা করেই নাগরিক বলছি না) কারাগারে পাঠিয়ে দিয়ে উন্নয়নের সুফল ভিআইপিদের ভালোভাবে ভোগের সুযোগ করে দেয়ার জন্য বিশ্ব দরবারে রোল মডেল হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ। সারা দিন বিদেশিরা প্রশংসার জন্য আমাদের পেছনে লেগে থাকবেন, আমরা পাত্তাই দেবো না- ভাবতেই চোখের কোণ জলে ভরে যায়।
ওই ভিআইপিদের সুবিধা দেয়ার জন্য অচল নগরেও নব উন্নয়নের দেখা মিলবে। এরই ধারাবাহিকতায় আসতে পারে নোবেলও। আর নন-ভিআইপি যারা এ কাজে সর্বাত্মক সহায়তা করছেন কিংবা অন্তত নীরব থাকছে তারা পেতে পারেন গান্ধীবাদী পুরস্কার। কাজেই এটিকে ছোট করে দেখার সুযোগ কই?
শুধু ঢাকা শহর কেন, দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গণমানুষ এক রকম রাস্তা ব্যবহার করবে আর ভিআইপিরা তাদের জন্য বানানো রাস্তা ব্যবহার করবে। প্রতিটি রাস্তার শেষে ভিআইপিদের জন্য বিনোদন সেন্টার থাকবে। এগুলোয় ভবিষ্যতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এসে গিজগিজ করবনি। তখন আমরা অতি উচ্চ মূল্যে ভিআইপি টুরিস্টদের এখানে মাস্তি করার জন্য ডাকবাে। সমাজে ভিআইপি ও অভিআইপিদের সহজে আলাদা করা যাবে। এখন যেমন যে কেউ ভিআইপি ভাব ধরতে পারেন তখন তেমনটা থাকবে না। এটি না করলে প্রকৃতিগতভাবেই যে মানুষ সাদা-কালো, ধনী-নির্ধন, উঁচু-নিচুর পার্থক্য আছে সেটি স্পষ্ট হয় না! সমাজের সব শ্রেণিকে তাদের নিজ নিজ মানদণ্ডে দাঁড় করানোই তো আমাদের রাষ্ট্রের কাজ হওয়া উচিৎ! এর ব্যতিক্রম হতে দেয়া যায় না। ফলে ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেইন নির্মাণটিকে স্বাগত জানানো উচিৎ। সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটি কোনো ব্যাপারই নয়। সোজা কথায় বলবাে, ‘এ নিয়ে রাজনীতি করার কিছুই নেই।’
বিবিসি-র প্রতিবেদনে ওই প্রস্তাবটিকে মানসিকভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করলেও আমি বলবাে, এ কাজ সরকার করতেই পারে। যদি না পারে তাহলে সেটি তাদের রাজনৈতিক নীতির সঙ্গে যাবে না। এই কথা এ জন্য বলছি কারণ, শুধু সংবিধানের বাধ্যবাধকতা সামনে এনে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ২০১৪ সাল থেকে দেশ চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোটারবিহীন কথার সঙ্গে জনবিচ্ছিন্নতার কি কোনাে সম্পর্ক নেই? আপাতদৃষ্টিতে বহুমাত্রিক সম্পর্ক আছে। সরকার শুধু ভারত বা তৃতীয় কোনাে রাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দেশ চালাচ্ছে- ওই দাবি করার আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে ভিআইপিবলয় সৃষ্টি করেছে এদিকে নজর দেয়া যেতে পারে। পাকিস্তান আমলের যে ২২ পরিবার বাংলাদেশ সৃষ্টির পর ২২ হাজার পরিবার হলাে তাদের সাবলীল জীবনা যাপনের জন্য আলাদা রাস্তা নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।
ভিআইপিদের জন্য রাস্তা বানাতে কেউ বাধা দিলে জনগণেরই উচিৎ এর প্রতিবাদ করা। ভিআইপিদের জন্যই তো এ দেশ। জনগণ মানে, আমজনতা হচ্ছে দেশের বায়বীয় পদার্থ। জনগণকে বায়বীয় পদার্থ বানিয়ে এক নব্য ভিআইপি শ্রেণি তৈরি করতে শেয়ারবাজারের টাকা হরিলুট করা হয়েছে, ফ্লাইওভার বানিয়ে নিচের রাস্তা মেরামতে গাফিলতি দেখানো হয়েছে ওই ভিআইপি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাবলেই। আরেক শ্রেণির ভিআইপি রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ সহযোগী নতুন রাস্তা নির্মাণের ঠিকাদারি নিযুক্ত হয়, কয়েক বছরে পদ্মা সেতুর ব্যয় চারগুণ হয়ে যায়- এসব ভিআইপি-সিআইপির কল্যাণেই। আবার দেখেন, দেশের জনগণ কত ভিআইপিবান্ধব যে, ব্যাংকে তারা টাকা রাখেন ভিআইপিদের কল্যাণেই। হাজার হাজার কোটি টাকা তো আমরা ভিআইপিদের নিয়ে যেতে দিচ্ছি, বলতে পারেন বিলিয়ে দিচ্ছি। ভিআইপিরা সুখে থাকলে হতদরিদ্রতার সব দুঃখ আমরা ভুলে যেতে পারি। রাজা ও ভিআইপদের খেদমত করতে পারলেই যেন ধন্য হয়ে যায় এ দেশের জনগণ। কাজেই ভিআইপিদের উচিত জনগণের ওই ভিআইপিপ্রীতি কাজে লাগিয়ে চিরকালের জন্য নিজেদের সবকিছু আলাদা করে ফেলা। তাদের ভোগ হবে আলাদা পদ্ধতিতে, ত্যাগও আলাদা পদ্ধতিতে। চলবেনও আলাদা স্টাইলে। সব হবে আলাদা। ছোটলোকদের সঙ্গে তাদের পার্থক্যটা যেন খালি চোখেই ধরা পড়ে যায়। এভাবে আমাদের দেশে একটি ভিআইপি বিপ্লব সংগঠিত হবে আশা করি।
দেশের ভিআইপিরা সরকারকে জনপ্রতিনিধিত্বহীন সংসদ পরিচালনা করতে সহায়তা করছেন। সময়ের সঙ্গে তারা কত সহজে নিয়ম হিসেবে এসবে মানিয়ে নিচ্ছেন, জনগণকেও বাধ্য করছেন এটি মেনে নিতে। তো সরকারের উচিত ভিআইপিদের জন্য এমন একটি মহৎ কাজে আর দেরি না করা। যে গরু দুধ দেয় এর লাথিও মাঝে মধ্যে খেতে হয়। সরকার না পারলে ওই লাথি না হয় বাংলাদেশ তথা ঢাকার জনগণই খাবে। জনগণের মধ্যে ক্ল্যাসিফিকেশন সবক্ষেত্রেই জরুরি। সরকারের কাছে তো দেশের ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, আমলাতন্ত্র, আইন রক্ষার নামে আইনভঙ্গকারী- নানান বাহিনী বিশেষ আপনজন। তারা যদি ঢাকায় আলাদা করে ভিআইপি রাস্তার দাবি তোলনি তাহলে এটিকে অন্যায় বলা যেতে পারে না। এমন প্রস্তাব কোনাে অমূলক ভাবনা নয়। তাছাড়া এটি বলতে পারি, ভিআইপিদের খুশি রাখতে পারলে আগামী নির্বাচনে জয়লাভও সুনিশ্চিত। ২০১৪ সালের মতাে আরেকটি নির্বাচন দেশে করতে চাইলে ভিআইপিদের সব দাবি পূরণ করাই শ্রেয়।
ওই কারণে সময় থাকতেই ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেইন শুধু কেন- রাস্তা, ফ্লাইওভারসহ যা যা দরকার সবই করা হোক। ক্ষমতার জন্য ভিআইপি হলেই চলবে। জনগণ বলে কিছু নেই। এগুলো মিডিয়ার সৃষ্টি। এতে কান দিতে নেই।
(কার্টুনটি এঁকেছেন মেহেদী হক, সৌজন্যে নিউ এইজ)