কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের নজর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত-প্রশান্তের দিকে সরে যাওয়ার ফলে ওই অঞ্চলে বাংলাদেশের ওপর আমেরিকার মনোযোগ যে শুধুই বাড়ছে তা নয়, বরং এ ইস্যুতে বাংলাদেশ কার স্বার্থ রক্ষা করবে সেটিই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কাছে।
এতদিন উপেক্ষিত থাকলেও নতুন এই ভূরাজনীতির সমীকরণে ভারত-পাকিস্তানের পাশাপাশি বাংলাদেশেকেও পাশে রাখতে চাইছে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দেশগুলো।
ভৌগােলিক দিক থেকে বাংলাদেশকে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়ে থাকে। কারণ, ভারতের উত্তরে রয়েছে ভূমিবেষ্টিত হিমালয়ের দেশ নেপাল ও ভুটান, দক্ষিণে দ্বীপদেশ শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ এবং পূর্বে এককভাবে রয়েছে কেবল বাংলাদেশ। ফলে ভারত-প্রশান্তের গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়তে বাধ্য। সমুদ্র আধিপত্যের জন্য বাংলাদেশের সমুদ্রপথ বা ‘বে অফ বেঙ্গল’ খুবই প্রয়োজনীয় জলভূমি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বিষয়টি নতুন করে ওই সমীকরণে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। অন্যদিকে ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান, নৌ-সড়ক যোগাযোগ ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের দিকেই এখন সবার দৃষ্টি থাকা স্বাভাবিক।
তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশের পক্ষে যে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং এখানকার বাজার যে আন্তর্জাতিক পুঁজির জন্য খুবই লোভনীয় তাও মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ মানে, নব্বইয়ের দশকের পরই প্রমাণিত হয়েছে। দুই দশক ধরে এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের আশপাশে থাকলেও গত বছর তা ৭ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছে যায়। অবশ্য সরকারি ওই হিসাব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সরকারি প্রমাণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে, বাংলাদেশে কমছে দরিদ্র ও বেকারত্বের হার। বেসরকারি সংস্থা ‘প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্স’-এর হিসাব মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে প্রবৃদ্ধিশীল তিন অর্থনীতির একটি যদি দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়। তাই ওই অঞ্চলে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার জন্য তোড়জোড় চালাচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র- উভয় দেশই।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অসম ‘বন্ধুত্ব নীতি’র কারণে বাকি দুই পরাশক্তির মধ্যে কোনাে দর কষাকষিতে সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ। ভারত নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত না হলে ওই নতুন ভূরাজনৈতিক খেলায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা অনেক বিশ্লেষকের।
যুক্তরাষ্ট্র তার ‘পিভোট’ বা ‘রিব্যালান্সিং’ (পুনরায় ভারসাম্য আনা) নীতি ঘোষণা করে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার রণকৌশলের অবস্থান পুনরুজ্জীবিত করার যে প্রকল্প নিয়েছে এ জন্য বাংলাদেশকে আলাদাভাবে দরকার তাদের।
এখানে লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবেই চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে। বিগত বছরগুলোয় দেশের সামরিক ক্ষেত্রে চীনের প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতাে। চীন থেকে অস্ত্র ক্রয় করা ছাড়াও কিছুদিন আগেই চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয় করেছে বাংলাদেশ। চীন স্বভাবতই বাংলাদেশকে হাত ছাড়া করতে চাইবে না । এর উপর ঐতিহাসিক সিল্ক রুটের পুনর্জীবনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটানোর প্রকল্প ‘ওয়ান বেল্ট ও ওয়ান রোড’-এর স্বপ্ন দেখছে চীন। ফলে তাদের জন্যও স্থল ও নৌভাগে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ রয়েছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে চীনের সমস্যা ঐতিহাসিক। একই সঙ্গে বাংলাদেশে ভারতের ভারসাম্যহীন নীতির কারণে ওই সরকারের বন্ধুত্বের বয়ানের বাইরেও জনমনে ভারত নিয়ে ক্ষোভ অন্য যে কোনাে সময়ে চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। তাই ভারতকে চাপে রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কটা চীন গুরুত্ব দিয়েই দেখবে- এতে সন্দেহ নেই।
অন্যদিকে বাংলাদেশ নিয়ে আলাদা করে ভাবছে যুক্তরাষ্ট্রও। অবশ্য অনেকে মনে করেছিলেন, বিতর্কপ্রিয় ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের মতো ছোট দেশ নিয়ে উদাসীন। কিন্তু সমুদ্র ও ভূরাজনীতির হিসাব তা বলছে না।
যুক্তরাষ্ট্র তার ‘পিভোট’ বা ‘রিব্যালান্সিং’ (পুনরায় ভারসাম্য আনা) নীতি ঘোষণা করে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার রণকৌশলের অবস্থান পুনরুজ্জীবিত করার যে প্রকল্প নিয়েছে এ জন্য বাংলাদেশকে আলাদাভাবে দরকার তাদের
২০১২ সালেই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকান সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল ওবামা প্রশাসন। ওই ঘোষণা অনুযায়ী ২০২০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের মোট যুদ্ধজাহাজের ৬০ শতাংশই এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হবে। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের সমদ্রসীমা গুরুত্বপূণ ভূমিকা রাখবে বলে ভাবা হচ্ছে।
নিরাপত্তা বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান সম্প্রতি মিডিয়ায় বলেন, আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতিতে নতুন এক বয়ান হাজির হয়েছে ‘পার্টনারশিপ ডায়ালগ’ নামে। ওই অঞ্চলের সব দেশের সঙ্গে আমেরিকার ‘পার্টনারশিপ ডায়ালগ’ নামে চুক্তির জন্য তৎপর হয়ে উঠতে দেখছি আমরা। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ‘পার্টনারশিপ ডায়ালগ’ বিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ধরনের দিক থেকে ‘পার্টনারশিপ ডায়ালগ’-এর ফোকাস অর্থনৈতিক নয়, বরং কিছুটা কৌশলী অর্থাৎ সামরিক ও রাজনৈতিক।
এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ওই অবস্থান আগের থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে হবে। দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে আগে স্টেট ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশ ডেস্ক বলে আলাদা কিছু ছিল না। বাংলাদেশকে ভারত ডেস্কেরই অন্তর্গত হিসেবে কাজ করা হতাে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের ক্রমবর্বমান গুরুত্বের কারণে ২০১১ সাল থেকে আলাদা বাংলাদেশ ডেস্ক খোলা হয়।
তাছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের পাশেই ছিল। চীনের হুমকিকে আমলে নিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা নীতিপন্থী সংস্থা, এমনকি জাতিসংঘের ভূমিকাও সক্রিয় ছিল। অবশ্য এতে গণহত্যা বন্ধ করা বা রোহিঙ্গাদের ভাগ্য উন্নয়নে তেমন কোনাে ব্যবহারিক ভূমিকা দেখা যায়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত নীরবতা ধরে রাখলেও আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ওই নিপীড়নকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যা দেন। কিছুদিন আগে আমেরিকার কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে ‘সন্ত্রাস দমন সহযোগিতার আঞ্চলিক মডেল’ বলে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই বাংলাদেশপ্রীতি এ দেশের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন আনবে, নাকি বাংলাদেশ ওই আগের চীনা নীতিতে অটল থাকবে, না ভারতের সঙ্গে নতজানু নীতিই বজায় রেখে এই নতুন সমীকরণ থেকে ছিটকে পড়বে সেটিই এখন দেখার বিষয়। এছাড়া বাংলাদেশের দিক থেকে আরো কৌশলী কোনাে অবস্থান আমরা দেখতে পারব কি না তাও বিবেচেনার বিষয়। বিশেষ করে দেশের রাজনীতির হাওয়া যেভাবে উত্তপ্ত হতে চলেছে এতে সামনের দিনগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তাই আগামী দিনগুলোতেই এটি স্পষ্ট হয়ে যাবে, আসলে কোন নীতির দিকে এগোবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের উচিৎ তার নিজের স্বার্থ দেখা, নিজের স্বার্থ রক্ষা করা।