মুমিনুলের দুর্দান্ত ব্যাটিং দ্যুতির কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছিল চট্টগ্রাম টেস্টের বাকি সব প্রসঙ্গ। বাস্তবতাটাই এমন। একটা পরাজয় যেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় অনেক দুর্বলতা তেমনি জয় বা ড্র ঢেকে দেয় অনেক কিছুই। কিন্তু কাল থেকে শুরু হতে যাওয়া দ্বিতীয় টেস্টে অনেক কিছুই ঠিক করতে হবে বাংলাদেশের।
ইতিবাচক দিক
চট্টগ্রাম টেস্টের একমাত্র ইতিবাচক দিক হচ্ছে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং। প্রায় প্রত্যেক ব্যাটম্যানই রান পেয়েছেন প্রথম টেস্টে। তামিম, ইমরুল, মুমিনুল, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরা প্রথম ইনিংসে বেশ সফল ছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম ইনিংসের ভুল শুধরে রানের দেখা পেয়েছেন লিটন। উইকেট আঁকড়ে অপরাজিত থেকে ছোট্ট কিন্তু কার্যকর ইনিংস খেলেছেন মোসাদ্দেক। ব্যাটিং বাদ দিলে পুরো টেস্টে প্রাপ্তি বলুন বা ইতিবাচক দিক- কোনোটিরই দেখা পাবেন না।

নেতিবাচক দিক
• চট্টগ্রাম টেস্টে প্রায় দেড় হাজারের বেশি রান হয়েছে। উইকেট পড়েছে মাত্র ২৪টি। এটিই বুঝিয়ে দেয় পিচটি বোলারদের জন্য বধ্যভূমিরূপেই আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু এ কথা দিয়েও ঢাকা যাবে না বাংলাদেশের বোলিং ব্যর্থতা। যে কোনো পিচেই পাঁচশ’র বেশি রান বোলারদের জন্য ভালো একটা সুযোগ এনে দেয় কিছু একটা করার জন্য। আর সেখান থেকে স্কোর বোর্ডে কোনো রান যোগ করার আগেই প্রতিপক্ষের এক ব্যাটম্যানকে সাজঘরে ফেরাতে পারলে আরো বড় সুযোগ সৃষ্টি হয় চাপ প্রয়োগ করার। প্রথম টেস্টে তেমনটা আমরা দেখিনি। শূন্য রানেই প্রথম উইকেট হারানো লংকনরা যে সাতশ’র বেgt রান তুললেন এতে শ্রীলংকার ব্যাটসম্যানদের কৃতিত্ব যেমন আছে তেমনি বাংলাদেশের বোলারদের ব্যর্থতাও কম নয়। নির্বিষ বোলিং, বাজে লাইন লেন্থ, চাপ তৈরি করার অক্ষমতা চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছে আফ্রিকা সফরে বোলারদের নিয়ে মুশফিকের উষ্মা প্রকাশের যথার্থতা। এমন পিচে বল করার জন্য যে পরিকল্পনা থাকা দরকার ছিল এর কিছুই দেখা যায়নি বাংলাদেশের বোলিংয়ে। স্কোর কার্ড অনেক সময়ই ধোঁকা দেয়। যেমন- মিরাজের তিনের বিপরীতে মোস্তাফিজের এক উইকেট দেখে যদি কেউ মনে করেন, মিরাজের তুলনায় মোস্তাফিজ নির্বিষ ছিলেন তাহলে সেটি ভুল ধারণা হবে। মিরাজ উইকেট পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু প্রথমটি বাদ দিলে বাকি দুটি ব্যাটসম্যানের রান তোলার গতি বাড়াতে গিয়ে দ্রুত খেলার চেষ্টার সময়। লংকানরা যখন জুটি গড়ে তুলছিলেন তখন তিনি ওই অর্থে কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। অন্যদিকে মোস্তাফিজ একটি উইকেট পেলেও অনেকটা সময়ই চাপে রেখেছিলেন ব্যাটসম্যানদের। কখনো ক্যাচ মিস, কখনে বা ভাগ্য মুখ তুলে না তাকানোর কারণে বঞ্চিত হয়েছেন ওই পেসার। এটি স্পষ্ট, লংকানদের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বোলারদের ভূমিকা আবশ্যক। টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, বোলাররা কেন এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত।
• চট্টগ্রাম টেস্টে বোলারদের চেয়েও বাজে ছিল ফিল্ডিংয়ের অবস্থা। একাধিক ক্যাচ মিস, রান আউট মিসের খেসারত দিতে হয়েছে বেশ বাজেভাবেই। বিস্ময়কর হচ্ছে, টেস্টের আঙিনায় ১৭ বছর পার হতে চললেও এখনো বাংলাদেশ দলে কোনো বিশেষজ্ঞ স্লিপ ফিল্ডার নেই। বোলারদের ব্যর্থতার পেছনে এটিও অন্যতম কারণ বটে। মোস্তাফিজের বলে যেখানে মাত্র চার রানেই মেন্ডিস ফিরে যেতে পারতেন সেখানে আউট হয়েছেন ১৯৬ রান করে। টেস্টে যেখানে হাফ চান্সটিও চান্সে পরিণত করা আবশ্যক সেখানে বাংলাদেশের ফিল্ডাররা সহজ সুযোগগুলোও মিস করে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের সুযোগ করে দিয়েছেন রান করার। শুধু ক্যাচিংই নয়, গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ের হালতও হতাশাজনক। যে রান আউটের সুযোগটি মিরাজ নষ্ট করেছিলেন সেটি এ পর্যায়ের ক্রিকেটে বেমানান। একই সঙ্গে মুশফিকের বদলে বিশেষজ্ঞ কিপার হিসেবে দলে আসা লিটনও বেশকিছু সুযোগ নষ্ট করেছেন। ব্যাট হাতে ভুল শুধরে দলে নিজের জায়গা ধরে রাখলেও কিপিংয়ের ভুলগুলো শোধরানো আবশ্যক। পুরো ম্যাচে ফিল্ডিংয়ে মনে রাখার মতো মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন শুধু মুশফিক। তিনি উল্টোদিকের অনেকটা জায়গায় দৌড়ে যেভাবে মেন্ডিসের ক্যাচটি ধরেছিলেন সেটি ছিল দেখার মতাে।
সূত্র : ইন্টারনেট
এই টেস্ট শেষে আরো বিষয়ে ওপর নজর দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
• চট্টগ্রাম টেস্টের একাদশ নির্বাচনে ভুলটা ছিল চোখে পড়ার মতাে। উপমহাদেশের কোনো দলের বিপক্ষে বিশেষজ্ঞ তিন স্পিনার নিয়ে খেলার সিদ্ধান্ত বেশ অবাক করার মতাে। পিচের হালত এক্ষেত্রে বর্মের কাজ করবে না। মোস্তাফিজের বোলিং দেখে বরং বেশ ক’বারই এক পেসারের অভাব অনুভূত হয়েছে।
• ইদানীং বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের পাশাপাশি আরো একটি বিষয় আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। সেটি হচ্ছে পিচ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশে বসেছিল ডিমেরিট পয়েন্ট। এবার চট্টগ্রাম টেস্ট শেষে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের পাশেও যোগ হলো ডিমেরিট পয়েন্ট। দেশের প্রধান দুটি টেস্ট ভেনুর নামের পাশে ডিমেরিট পয়েন্ট যোগ হতে দেখার দৃশ্যটি উদ্বেগজনক। উপমহাদেশের দলগুলোর শক্তির জায়গা প্রায় একই। তাই এসব দলের বিপক্ষে খাঁটি স্পিন উইকেট বানিয়ে খেলার চেয়ে বরং স্পোর্টিং উইকেট বানানোটাই হবে বেশি কার্যকর। খেলাটা এতে উপভোগ্য হবে।
• রিভিও কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতা আরো একটি দিক যেটির উন্নতি আবশ্যক। প্রথম ইনিংসে রিভিও হাতে থাকার পরও সেটি ব্যবহার না করে মাঠ ছেড়েছিলেন ইমরুল। পরে রিপ্লেতে দেখা গেছে, রিভিও নিলে নিশ্চিতভাবেই রক্ষা পেতেন তিনি। বোলিংয়ের সময়ও দেখা গেছে একই দৃশ্য। উইকেটের জন্য মরিয়া হয়ে দ্রুতই নিজেদের সব রিভিও হারায় বাংলাদেশ। এর একটিও যে বাংলাদেশের পক্ষে আসেনি তা বলাই বাহুল্য।
• চট্টগ্রাম টেস্টে দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন ইমরুল। দিনের শেষবেলায় যখন উইকেটে টিকে থাকাটাই ছিল মুখ্য তখন শট খেলার বিলাসিতা দেখাতে গিয়ে দৃষ্টিকটুভাবে নিজের উইকেটটি উপহার দিয়ে এসেছিলেন তিনি। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি ক্ষমার অযোগ্য। দীর্ঘদিন জাতীয় দলে খেলা এক ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে ওই সময় এমন শট একটা বাজে দৃষ্টান্ত।
বর্তমানে শক্তির বিচারে বাংলাদেশ-শ্রীলংকা প্রায় সমমানের দল। তাই ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশ জয়ের জন্য খেলবে- এটিই প্রত্যাশিত। কিন্তু জয়ের আশাটি বাস্তবে রূপ দিতে গেলে প্রথম টেস্টে ভুলের পুনরাবৃত্তি করার কোনো সুযোগ নেই। এ পর্যায়ের ক্রিকেটে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভুল শোধরাতে না পারলে জেতার সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হতে শুরু করে। যে সামর্থ্য আছে এতে ওই ভুলগুলো শুধরে নিয়ে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়বে টাইগাররা- এমনটিই প্রত্যাশা সবার।