কৃষ্ণবর্ণের জীর্ণ-শীর্ন দেহ, মাথায় সুবিন্যস্ত চুলের জট, কাঁধে ঝােলানো গিটার, গান করতেন প্রাণের পক্ষে, জীবনের দাবিতে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কৃষ্ণাঙ্গসহ নিপীড়িতের পক্ষে আওয়াজ তুলতেন গানের মাধ্যমে। জীবনজুড়েই ছিলেন রাস্তাফেরি আন্দোলনের সঙ্গে। তৃতীয় বিশ্ব থেকে উঠে আসা যে কোনো রক শিল্পীর মধ্যে তার নাম সবার আগে উচ্চারিত হয়। এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তার গান, ফ্যাশন, রাজনীতি, এমনকি সংস্কৃতির আষ্টেপৃষ্ঠে আছে। ষাট ও সত্তরের দশকে দেশে দেশে উত্তাল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে বিদ্রোহী মানুষের বুকে সাহস জুগিয়েছে তার গান। বলছি নেসতা রবার্ট মার্লে বা বব মার্লে-র কথা।
পঞ্চাশের দশকে জ্যামাইকায় জন্ম নেয়া বিখ্যাত ওই শিল্পী ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক। ষাটের দশকে জ্যামাইকায় জন্ম নেয় ‘র্যাগে’ নামক নতুন একটি গানের ধারা। ওই ধারা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলেন বব মার্লে। তার অসাধারণ লেখার ক্ষমতা। তিনি কণ্ঠ দিয়ে মাতিয়ে তোলেন বিশ্ব। গানও যে প্রতিবাদের মোক্ষম ভাষা হতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তিনি।
১৯৪৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম বব মার্লের। তার বাবা ছিলেন ইংল্যন্ডে নেভি-র ক্যাপ্টেইন আর মা ছিল জ্যামাইকার একটি গ্রামের সাধারণ নারী। শেতাঙ্গ বাবা আর কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের ঘরে জন্ম নেয়া মার্লের ছিল দ্বৈতপরিচয়। তিনি ছিলেন না শেতাঙ্গ, না কৃষ্ণাঙ্গ। তার ওই মিশ্র পরিচয়ের জন্য প্রতিবেশীরা তাকে ‘হোয়াইট বয়’ বলে উত্ত্যক্ত করত। মাত্র ৪ বছর বয়সেই তার অদ্ভুত প্রতিভা দেখা যায়। ওই বয়সেই গণকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ফলে হাত দেখেই তিনি ভবিষ্যৎ বর্ণনা করতেন এবং তা মিলেও যেত। কিন্তু বেশিদিন ওই ঝোঁক তার থাকেনি। তিনি মোড় নিলেন গানের দিকে। শৈশব থেকেই ছিল গানের প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই দুই বন্ধু বানি লিভিংস্টন ও পিটার টশ-কে নিয়ে গড়েন গানের ব্যান্ড ‘ওয়েলিং ওয়েলার্স’। পরে নাম ছোট করে শুধু ‘ওয়েলার্স’ করা হয়।
মার্লে পরিবার বিপত্তিতে পড়েন ১৯৭৬ সালে। একটি ফ্রি কনসার্ট-এর দুই দিন আগে বব মার্লে ও তার স্ত্রীর ওপর আক্রমণ করে অজ্ঞাতনামা এক বন্দুকধারী। ফলে কনসার্ট হচ্ছে না বলে চারদিক গুঞ্জন শুরু হলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক জগৎ
ওয়েলার্স ষাটের দশকে জ্যামাইকার লোকাল ল্যাবেল-এর সঙ্গে গান রেকড করতে থাকে। তখন থেকে জ্যামাইকা-য় র্যাগে ঘরানার গানের উত্থান হতে থাকে মার্লের মাধ্যমে। সত্তরের দশকের প্রথম দিকে ‘আইল্যান্ড রেকর্ডস’-এর সঙ্গে চুক্তি করে ওয়েলার্স এবং শুরু হয় বিশ্বজোড়া খ্যাতি। ওইয়েলার্স ওই সময়ই জ্যামাইকার স্থানীয় মঞ্চ থেকে চলে আসে আন্তর্জাতিক আলোয়। কিন্তু সত্তরের দশকের মাঝামাঝি এসে ওয়েলার্স ভেঙে যায়। মার্লে তখন নতুন ব্যান্ড সদস্য যোগ করে নতুন নাম দেয় ‘মার্লে অ্যান্ড ওয়েলার্স’ এবং নিজেই গান গাওয়া ও লেখা ছাড়াও রিদম গিটারিস্ট হিসেবে ব্যান্ডের নেতৃত্ব দেন। তখন তার চিন্তাধারার মতাে লেখনীতেও পরিবর্তন আসে।
গানের মাধ্যমে জ্যামাইকা-র বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার প্রতিবাদ করা শুরু করেন মার্লে। ফলে সবার আইকন বনে যান রাতারাতি। এতে কারো কারো রোষানলেও পড়েন। বিপত্তিতে পড়েন মার্লে পরিবার। ১৯৭৬ সালের আগস্টে একটি ফ্রি কনসার্টের দুই দিন আগে বব মার্লে ও তার স্ত্রীর উপর আক্রমণ করে অজ্ঞাতনামা এক বন্দুকধারী। ফলে কনসার্ট হচ্ছে না বলে চারদিক গুঞ্জন শুরু হলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক জগৎ। কিন্তু গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে কনসার্টের দিন সবাইকে চমকে দিয়ে ৮০ হাজার দর্শকের সামনে মঞ্চে ওঠেন মার্লে দম্পতি। তাদের ওই অজেয় মনোভাব শ্রোতা-ভক্তের কাছে জনপ্রিয়তার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। এর প্রতিফলন দেখা গেছে পরবর্তী অ্যালবামের জনপ্রিয়তায়। মার্লে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিবাহিত ছিলেন একজনের সঙ্গেই। তাদের সন্তান ৫ জন। তবে দত্তক নেয়াসহ তাদের সন্তানের সংখ্যা ১৩।
মার্লে-কে ঘিরে নানান বিতর্কও বাজারে আছে। নানানভাবেই রাস্তাফেরি আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সক্রিয় ছিলেন। রাস্তাফেরি মূলত আধ্যাত্মিক ও সামাজিক আন্দোলনের নাম হলেও এর অনুসারীরা এটিকে ধর্ম বলে প্রচার করতেন। মার্লে-ও ওই ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। তাদের ধর্ম মতে, গাঁজা হচ্ছে ‘হোলি হার্ব’ বা ‘পবিত্র ভেষজ’। তাই মার্লে ও তার ব্যান্ড সব সময়ই গাঁজা সেবনটিকে প্রচার ও সমর্থন করত। এভাবেই র্যাগে সম্রাট হয়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম ‘গ্লোবাল মারিজুয়ানা ব্যান্ড’।
মার্লের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আবেগ টের পাওয়া যায় পরবর্তীকালে তার পায়ে আঘাত লাগলে। ১৯৭৭ সালে ফুটবল খেলতে গিয়ে বুড়ো আঙুলে বেশ গুরুতর ব্যথা পান। কিন্তু ওই ব্যথা না কমে বাড়তে থাকলে ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্যানসর শনাক্ত করেন এবং রোগ ছড়িয়ে পড়ার আগেই আঙুল কেটে ফেলতে চান। তবে তার রাস্তাফেরি ধর্ম অনুসারী এবং ওই ধর্মে মানুষের অঙ্গহানি মহাপাপ তা যে কারণেই হোক না কেন। এ কারণে তিনি তখন পায়ের অপারেশন করান না। পরে আর কোনো উপায় না দেখে অপারেশন করাতে চাইলেও ততদিনে দেরি হয়ে যায় এবং রোগ সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়।
র্যাগে সঙ্গীতের ওই বরপুত্র মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১৯৮১ সালে মিয়ামি-তে মৃত্যুবরণ করেন। জ্যামাইকায় সমাধিতে মরদেহ ছাড়াও তার ৩টা অত্যধিক প্রিয় বস্তু রেখে আসা হয়। ওই তিনটি হচ্ছে হলো ফুটবল, তার গিবসন গিটারওি গাঁজা। ২০১৪ সালের ‘ফোর্বস’-এর তথ্য অনুযায়ী মারা যাওয়া প্রভাবশালী তারকাদের মধ্যে বব মার্লে পঞ্চম অবস্থানে আছেন। ১৯৬৫ সালে স্টুডিও ওয়ান-এর লেবেলে তাদের প্রথম অ্যালবাম বের হয় ‘দি ওয়েলিং ওয়েলার্স’। জ্যামাইকায় অ্যালবামটি অনেক দর্শক সুনাম অর্জন করে। জ্যামাইকায় গান করলেও তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক হিট ‘স্টিয়ার ইট’। ১৯৭২ সালে জন ন্যাশ-এরসিঙ্গে করা ওই গান বৃটেনে হিট করে। তাদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে দেশে ও দেশের বাইরে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে টশ ও লিভিংস্টোন ছেড়ে দিলে ব্যান্ড-এর হাল ধরেন মার্লে। নিজেই তুলে নেন গিটার ভোকাল ও গান লেখার কাজ। ১৩টি স্টুডিও অ্যালবাম ও ৫টি লাইভ অ্যলবাম বের হয় তার জীবদ্দশায়।
আজ ৬ ফেব্রুয়ারি বব মার্লের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ওই বিশ্বজয়ী র্যাগে সম্রাটের বয়স হতাে ৭৩ বছর। দুনিয়ার ইতিহাসের খুব কম শিল্পীকেই মারা যাওয়ার এত বছর পরও এত ভালোবাসায় সিক্ত করা হয়েছে। তার গাওয়া ‘নো ওম্যান নো ক্রাই’ বা ‘ইজ দিস লাভ’-এর মতাে গানগুলো আজও শ্রোতাকে মোহাবিষ্ট করে রাখছে দিন থেকে বছর। তার না থাকার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় টিএসসি-র দেয়ালে বা যুবকদের টি-শার্টে বব মার্লের ছবি দেখেলেই। মৃত্যুর চার দশক হতে চললেও আজও যেন মনে হয় গিটার হাতে মঞ্চে মার্লে চিৎকার দিয়ে শ্রোতার বুকে কাঁপন ধরিয়ে গাইছেন-
‘জাগো, দাঁড়াও: দাঁড়াও তোমার অধিকারের জন্য
জাগো, দাঁড়াও: ছেড়ে দিও না বন্ধু বাঁচার যুদ্ধ’