চীন-ভারত নতুন ম্যাচ এবার শ্রী লঙ্কায় : ডেটলাইন ১০ ফেব্রুয়ারি

চীন-ভারত নতুন ম্যাচ এবার শ্রী লঙ্কায় : ডেটলাইন ১০ ফেব্রুয়ারি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এখন আর কোন কিছুই ‘স্থানীয়’ থাকছে না– সবই আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির অংশ হয়ে গেছে। যেমনটি আমরা দেখবো শ্রী লঙ্কার আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি শনিবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। ২০১৭ সালের নেপালের নির্বাচনী মৌসুম শেষে চীন ও ভারত এবার ছদ্মযুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছে শ্রী লঙ্কায়। অন্তত আঞ্চলিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা এই নির্বাচনকে সেভাবেই মূল্যায়ন করছেন।

শ্রী লঙ্কায় ২০১৫ সালের পর এই প্রথম নির্বাচনী মৌসুম এলো। গত দু’ বছরে সেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে বিস্তর বিতর্ক ও পর্যালোচনা শেষে যে আইনগত সংস্কার হয়েছে তার আওতায় শনিবারের নির্বাচন হবে। যদিও দেশটিতে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের এখনও দু’বছর বাকি– কিন্তু চলতি স্থানীয় নির্বাচনই সেখানে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ এনে দিয়েছে। ইতোমধ্যে তা অভিহিত হয়েছে– শ্রী লঙ্কার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচন হিসেবে।

প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ ভোটার এই নির্বাচনে ৩৫ হাজার প্রার্থী থেকে পছন্দের প্রার্থী নয়– বরং বাছাই করবে পছন্দের দল। যদিও বিভিন্ন স্তরের ৩৪১টি স্থানীয় সরকার ইউনিটের জন্য ৮ হাজার ২৯৩ জন সদস্য এই নির্বাচন শেষে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবেন–কিন্তু ব্যালট পেপারে প্রার্থীদের নাম থাকছে না, থাকবে প্রতীক ও দলের নাম। প্রচারণাকালে প্রার্থীরা অবশ্য ভোটারদের জানিয়ে দেবেন কোন প্রতীক তাঁর প্রতিনিধিত্ব করছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী সরাসরি ভোটে ৬০ শতাংশ আসন এবং ভোটের দলীয় হিস্যার আনুপাতিক হিসাবে বাকি ৪০ শতাংশ আসন পূরণ হবে। আবার সকল পর্যায়ে ২৫ শতাংশ আসন পূরণ হতে হবে নারীদের দ্বারা।

বিস্ময়কর এই ঘটনাকে তখন অবহিত করা হচ্ছিলো চীনের বিরুদ্ধে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের মিলিত অভ্যুত্থান হিসেবে। কারণ রাজাপাকসা ক্ষমতার শেষ অর্ধ-দশকে চীনের ঘনিষ্ট মিত্রতে পরিণত করেছিলেন নিজেকে। এসময় শ্রী লঙ্কায় সমুদ্রবন্দর, এয়ারপোর্ট, বিদ্যুত কেন্দ্র ইত্যাদি খাতে ১০ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিনিয়োগ করে চীন

 

ত্রিমুখী রাজনৈতিক লড়াইয়ে অবতীর্ন শ্রী লঙ্কার তৃণমূল

নির্বাচনে লড়াই হচ্ছে মূলত ত্রিমুখী। আর এই তিন শিবিরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনজন– যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ও তাঁর দল ফ্রিডম পার্টি’র একাংশ; প্রধানমন্ত্রী বিক্রমেসিংয়ে ও তাঁর দল ন্যাশনাল পার্টি এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসা ও তাঁর অনুসারীরা। এছাড়াও নির্বাচনে জাফনাকেন্দ্রীক উত্তরাঞ্চলে রয়েছে তামিলদের দল টিএনএ এবং ইস্টার্ন প্রভিন্সে রয়েছে মুসলমানদের বহুধাবিভক্ত কিছু আঞ্চলিক দল।

যদিও উপরোক্ত প্রতিটি পক্ষই পৃথক পৃথকভাবে নির্বাচন করছে কিন্তু তাতে রয়েছে জটিল কিছু সমীকরণ। শ্রী লঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই সমীকরণ আবার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে লেপটে আছে।

বাংলাদেশের মতোই শ্রী লঙ্কায় বিগত দশকগুলোতে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে দ্বিদলীয় ব্যবস্থায়। ফ্রিডম পার্টি ও ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি পালাক্রমে সেখানে ক্ষমতায় আসতো। ফ্রিডম পার্টির সর্বশেষ মুখ্যনেতা ছিলেন রাজাপাকসা। চীন ও পাকিস্তানের সহায়তায় ২০০৯-এ তামিল টাইগারদের চূড়ান্ত যুদ্ধের মধ্যদিয়ে পরাজিত করতে পেরে যিনি শাসনক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে (২০১০-২০১৫) এসে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। সেই সুযোাগেই এখন থেকে ঠিক তিন বছর আগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে সেখানে অভাবনীয় এক ঘটনা ঘটায় ভারত ও পশ্চিমাশক্তি যৌথভাবে। তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রাজাপাকসার বিরুদ্ধে সেখানে তাঁর দল ফ্রিডম পার্টিরই সিরিসেনা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে পড়েন এবং তাঁকে সমর্থন দেয় ফ্রিডম পার্টির চিরশত্রু বিক্রমেসিংয়ের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পার্টি। বিস্ময়কর এই ঘটনাকে তখন অবহিত করা হচ্ছিলো চীনের বিরুদ্ধে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের মিলিত অভ্যুত্থান হিসেবে। কারণ রাজাপাকসা ক্ষমতার শেষ অর্ধ-দশকে চীনের ঘনিষ্ট মিত্রতে পরিণত করেছিলেন নিজেকে। এসময় শ্রী লঙ্কায় সমুদ্রবন্দর, এয়ারপোর্ট, বিদ্যুত কেন্দ্র ইত্যাদি খাতে ১০ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিনিয়োগ করে চীন। কিন্তু সিরিসেনাকে কেন্দ্রে রেখে সূচিত রাজনৈতি ঘটনার নাটকীয়তায় বোকা বনে যান রাজাপাকসা এবং প্রথমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবং পরে পার্লামেন্ট নির্বাচনেও পরাজিত হন। সেই থেকে শ্রী লঙ্কায় চলছে সিরিসেনা-বিক্রমেসিংয়ের নেতৃত্বে ফ্রিডম পার্টি-ন্যাশনাল পার্টির জোট সরকার। এক অর্থে এটা ছিল শ্রী লঙ্কার ইতিহাসের প্রথম জাতীয় সররকার। কারণ এই সরকারের প্রতি প্রধান দুই দল ছাড়াও সমর্থন দিয়েছিল উত্তরের তামিলরা এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলমানরাও।

এখনকার মতোই তখনও তামিলরা রাজাপাকসার বিরুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিহিংসায় ক্রুদ্ধ ছিল, আর মুসলমানরা ক্ষুব্ধ ছিল উগ্র সিংহলি বৌদ্ধদের লাগাতার আক্রমণে; যে সিংহলি-বৌদ্ধরা রাজাপাকসার মূল ভোটব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। তবে রাজাপাকসাকে পরাজিত করলেও সিরিসেনা-বিক্রমেসিংয়ে জোট গত তিন বছরের প্রতিশ্রুত রাজনৈতিক সংস্কার যেমন করতে পারেনি, তেমনি সুশাসনও কায়েম করতে পারেননি। ফলে এই জোট সরকারের প্রতি সিংহলি মধ্যপন্থীদের সমর্থন যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে– তেমনি তামিলরা হতাশ প্রত্যাশিত স্বায়ত্তাশাসন ও সাংবিধানিক সংস্কারের কোন ফয়সালা না হওয়ায়।

এই পটভূমিতেই শ্রী লঙ্কার রাজনীতিতে রাজাপাকসার সম্ভাবনা এখনও শেষ হয়ে যায়নি বলেই মনে করা হয়। যদিও এখনও তিনি ফ্রিডম পার্টির সদস্যপদ ছেড়ে দেননি– কিন্তু নিজ ভাইকে (বাছিল রাজাপাকসে) সামনে রেখে তাঁর নির্ভরযোগ্য অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন পিপলস্ ফ্রন্ট (পডুজানা পেরামুনা) নামে নতুন এক রাজনৈতিক দল। আর এভাবেই শ্রী লঙ্কার ছয়দশক পুরানো দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় এখন তৃতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ দলের জন্ম ঘটেছে। এটা খুব প্রতীকী অর্থ বহন করে যে, শনিবারের নির্বাচন উপলক্ষ্যে আয়োজিত পডুজানা পেরামুনার সমাবেশগুলোতে বিপুল জনসমাগম হচ্ছে এবং তাদের মার্কা হলো ‘ফুলের কুড়ি’।

কেবল বেইজিং ও নয়াদিল্লী থেকেই নয়– ঐ ফুলের কুড়ি শনিবার ফুটে উঠে কিনা সেদিকে নজর রাখছে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রও। রাজাপাকসার কারণে বিশেষভাবে ব্রিটেন তাদের এই পুরানো কলোনিতে অস্ত্র ব্যবসায়ের বিশাল বাজারটির অনেকখানি হারায়। অন্যদিকে, ব্রিটেন-কানাডা-অস্ট্রেলিয়া জুড়ে থাকা প্রায় এক মিলিয়ন তামিল প্রবাসীও শনিবারের নির্বাচনী ফলের জন্য গভীরভাবে অপেক্ষা করছে। রাজাপাকসা তাদের ‘ইলম’ এর স্বপ্ন গুড়িয়ে দিয়েছিলেন। আবার রাজাপাকসার অনুসারীরারা সম্ভাব্য সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে তামিলদের বাড়তি কোন স্বায়ত্তশাসন দেয়ারও বিরুদ্ধে। ফলে এই নির্বাচনকে হবু সংবিধানের ভাগ্য নির্ধারণী মুহূর্তও বলা যায়।

ভারত চাইছে পরিস্থিতির উপর সিরিসেনা ও বিক্রমেসিংয়ের প্রভাব অক্ষুণ্ন থাকুক। বিশেষ করে এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী বিক্রমেসিংয়ে ও ন্যাশনাল পার্টির ভালো অবস্থান দেখতে আগ্রহী তারা। ভারতের এই মনোভাবের কারণে তামিল-উত্তরের সমর্থন সিরিসেনা ও বিক্রমেসিংয়ের অনুসারী প্রার্থীদের পক্ষেই থাকবে। অন্যদিকে বহুদলে বিভক্ত ইস্টার্ন প্রভিন্সের মুসলমানরাও রাজাপাকসাবিরোধী শিবিরকেই ভোট দেবে

 

দক্ষিণের সিংহলিরা মনে করে, প্রথমত তামিল নাড়ু– এবং মুখ্যত ভারতের হস্তক্ষেপ থেকে তাদের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রটিকে সাহসের সঙ্গে মুক্ত করেছিলেন রাজাপাকসা; আর এক্ষেত্রে চীন ও পাকিস্তান তাঁর পাশে ছিল বিধায় আসন্ন নির্বাচনী যুদ্ধে রাজাপাকসা সমর্থক প্রার্থীরা পরোক্ষে চিহ্নিত হচ্ছে চীন সমর্থিত হিসেবে। যেমনটি আমরা দেখেছি নেপালের নির্বাচনকালে কে পি শর্মা ওলির দল ইউএমএল পার্টির ক্ষেত্রে। ওলিকেও ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ভারতের অবরোধের তিক্ত এক অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়েছিল।

বলাবাহুল্য যে, রাজাপাকসাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত সিরিসেনা ও বিক্রমেসিংয়ে উভয়েই এখনও যে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের বিশেষ পছন্দের– সেটা ঐসব দেশের প্রচারমাধ্যমের নির্বাচনী কাভারেজ থেকেও স্পষ্ট।

নির্বাচনে ফলাফল কি হবে তা কেউই অনুমান করতে পারছে না। কিন্তু সকলেই বলছেন, এই নির্বাচন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভূমিকম্পতুল্য ফলাফল বয়ে আনবে। এর কারণ, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনকালে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী পরস্পরের দলের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে জোট সরকারের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ যেভাবে নষ্ট করেছেন তার সংশোধন দুরূহ হবে বলেই মনে করা হয়। সিরিসেনা স্থানীয় নির্বাচনে তাঁর অনুসারীদের বিজয়ী করতে একদিকে যেমন রাজপাকসার অতীত দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলছেন তেমনি সামনে আনছেন তাঁরই রাজনৈতিক মিত্র বিক্রমেসিংয়ের ন্যাশনাল পার্টির মন্ত্রীদের দুর্নীতিও। আগামীকাল থেকে শ্রী লঙ্কার পার্লামেন্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বহুল আলোচিত এক দুর্নীতির বিষয়ে বিতর্ক শুরু হবে। নিশ্চিতভাবেই তা নির্বাচনী সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভোটারদের প্রভাবিত করবে।

এছাড়া এই নির্বাচনকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দলের গত তিন বছরের শাসনের একটা রিপোর্টকার্ড অনুষ্ঠান হিসেবেও বিবেচনা করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। কিন্তু এই রিপোর্টকার্ডের নেতিবাচক অংশের জন্য ভোটাররা প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে কাকে দায়ী করবেন সেটাই কৌতূহলের বিষয় হয়ে আছে।

ভারত চাইছে পরিস্থিতির উপর সিরিসেনা ও বিক্রমেসিংয়ের প্রভাব অক্ষুণ্ন থাকুক। বিশেষ করে এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী বিক্রমেসিংয়ে ও ন্যাশনাল পার্টির ভালো অবস্থান দেখতে আগ্রহী তারা। ভারতের এই মনোভাবের কারণে তামিল-উত্তরের সমর্থন সিরিসেনা ও বিক্রমেসিংয়ের অনুসারী প্রার্থীদের পক্ষেই থাকবে। অন্যদিকে বহুদলে বিভক্ত ইস্টার্ন প্রভিন্সের মুসলমানরাও রাজাপাকসাবিরোধী শিবিরকেই ভোট দেবে।

তবে দেশটির দক্ষিণের সিংহলি প্রধান জেলাগুলোতে রাজাপাকসার জনপ্রিয়তা এখনও বিপুল এবং এরাই ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করবে। যদিও সেখানে রয়েছে ভারত বিরোধী আরেকটি ছোট দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনা বা জেভিপি। এভাবে কার্যত ২০১৮ সালের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত-চীন প্রথম ম্যাচটি এক জটিল চিত্র তুলে ধরছে– যা পরিণতিতে নেপালকে অনুসরণ করতে পারে বা ভারতের জন্য নেপাল হারানো ম্যাচের প্রতিশোধপর্বও হতে পারে।