ফিলিস্তিনের এক সাহসী আবাসন ব্যবসায়ীর গল্প

ফিলিস্তিনের এক সাহসী আবাসন ব্যবসায়ীর গল্প

ফিলিস্তিন। নামটা শুনলেই দৃশ্যপটে ভেসে আসে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত একটা দেশের চিত্র। ফিলিস্তিন শুনলেই কল্পনা করি চারিদিকে রক্তের হোলি। ফিলিস্তিন মানেই যেন নানা অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়া একটা দেশের ধ্বংসাবশেষ।ফিলিস্তিন শুনলেই মানসপটে এই চিত্র আসার দায় আমাদের না। বরং মিডিয়ার উপস্থাপনাই যে এমন। কিন্ত এই বিলীন হতে চলা আর্থ-সামাজিক অবস্থার বাইরে কি ফিলিস্তিনের অস্তিত্বই বা কি? আচ্ছা ফিলিস্তিনের রাওয়াবি শহরের কথা কয়জন জানেন? রাওয়াবি হচ্ছে ফিলিস্তিনের সবচেয়ে আধুনিকায়িত নগরী। দেশটার পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠা এই শহর শুধু ফিলিস্তিনের না, এমন একটি শহর যা সরকারি সাহায্য ব্যতীত সম্পূর্ণ বেসরকারি বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে। পাহাড়ঘেষে গড়ে ওঠা এই শহরে আছে থিমপার্ক, বিজ্ঞান গবেষণাগার, আছে অফিস, মানসম্পন্ন রেস্টুরেন্ট, থ্রী-স্টার হোটেল, শপিং মল এবং বাচ্চাদের জন্য স্কুল। আরও আছে মসজিদ, চার্চ এবং মধ্য প্রাচ্যের সবচেয়ে বড় রোমান থিয়েটার। ১৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই শহর ফিলিস্তিনের সবচেয়ে আধুনিক শহর এবং আধুনিক ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ। কিন্ত সরকারের সাহায্য ছাড়া কিভাবে সম্ভব হল বিরাট এই পদক্ষেপ? আসলে তার নেপথ্যের নায়ক ব্যবসায়ী ধনকুবের বাশার আল-মাসরি। এই বিলিয়নিয়রের বদান্যতা এবং কাতারের রিয়াল-স্টেট প্রতিষ্ঠান ‘দায়ার’ এর সহযোগিতায় সম্ভব হয় এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আসুন তাহলে পরিচিত হই ফিলিস্তিনের প্রথম পরিকল্পিত নগরীর কারিগর, স্বপ্নবাজ ব্যবসায়ী বাশার মাসরির সাথে।

৫৭ বছর বয়সী বাশার আল-মাসরির জন্ম ১৯৬১ সালের ফিলিস্তিনের নাবলুস এ। তিনি ‘মাসার ইন্টারন্যাশনাল’ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান। ১৯৯৪ সালে মাসার ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি বেসরকারি খাত থেকে ফিলিস্তিনের উন্নয়ন সাধনের জন্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করতে থাকেন। এবং নিজেই গড়ে তুলেন ফিলিস্তিনের সবচেয়ে আধুনিক এই নগরী। তার এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে আরো ত্রিশটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে নিরন্তর।

মাসরির শৈশব কাটে যুদ্ধ বিগ্রহ দেখতে দেখতে। শৈশব থেকেই তার বৈরিতা সৃষ্টি হয় ইসরায়েল এবং এর সৈন্যদের প্রতি। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ইসরায়েলি সৈন্যদের দিকে পাথর ছুড়ার অপরাধে বন্দি হন কারাগারে। কয়েক রাত কারাগারে কাটিয়ে ছাড়া পেলেও তার প্রতিবাদ থেমে থাকে না। ফলস্বরূপ আবারও ১৬ বছর বয়সে কারাগারে ঢুকেন। এবার ছাড়া পেলে তার বাবা তাকে কায়রোতে পাঠিয়ে দেন পড়ালেখার কারণ দেখিয়ে। টাইম ম্যাগাজিনকে এক বিশেষ সাক্ষাতকারে তিনি জানান, “শৈশব থেকেই আমি আন্দোলন সংগ্রামে ছিলাম। উচ্চ বিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়েই জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনেরাল কার্ট ওয়ালধেইম-কে চিঠি লিখে আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন এর কথা জানাই আমি। তখন আমরা ফিলিস্তিনি নাগরিক এটা বলার অধিকারও আমাদের ছিল না। এমনকি আমাদের বলাও হত না ফিলিস্তিনি। নিজেকে ফিলিস্তিনি পরিচয় দিলেই গ্রেফতার করে কারাগারে পুরে রাখত, আর সাথে ফিলিস্তিনের পতাকা থাকা ছিল মাথায় গুলি খাওয়ার জন্যে যথেষ্ঠ।”

রাওয়াবি নগরীর ভেতরের দৃশ্য। ছবি: গেটি ইমেজেস।

মাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি থেকে ক্যামিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ব্রিটেন থেকে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন। পড়ালেখার পাট চুকিয়ে তিনি বিভিন্ন দেশে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। মরক্কো, লিবিয়া, জর্দান এবং মিশরের এ রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা ছাড়াও লন্ডন, সৌদিআরব এবং ওয়াশিংটন ডিসির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করে তিনি ধীরে ধীরে বিত্তশালী হয়ে উঠেন। কিন্ত তার বেশিদিন থাকা হয় নাই বাইরের দেশে। ১৯৮৭ তে প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হলে তিনি ১৯৯১ সালে নিজ দেশে ফিরতে চাইলে তাকে এয়ারপোর্টেই আটকে দেয় ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং কারণ হিসেবে বলা হয় তিনি ইসরায়েলের জন্য বিপদজনক। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে আবার চেষ্টা করলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় দেশে প্রবেশ করার।

দেশে ফিরে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা দেখেপ্রচন্ড হতাশ হন মাসরি। দেশের অবস্থা তখন খুবই শোচনীয়। অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির সাথে সাথে দেখা দেয় কাজের অভাব। এসব দেখে দেশের জন্যে কিছু করতে চাইলেন। ১৯৯৪ সালে ঐতিহাসিক ‘অসলো চুক্তি’ তাকে নতুন সুযোগ এনে দেয় এবং তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন দেশের এবং দেশের মানুষের জন্য সুযোগ তৈরি করার, নতুন আঙ্গিকে সকলের জন্যে দেশ গড়ার। এবং তখনই পরিকল্পনা করেন নতুন নগরী ‘রাওয়াবি’ নির্মাণ করার। যেখানে থাকবে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য শহরের তুলনায় কম খরচে বসবাসের সুযোগ এবং স্থানীয়দের জন্যে কাজ।

এই শহরের পরিকল্পনা-পর্ব শেষ হলেও ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সূচনা হলে কাজ শুরু করার সুযোগ হাতছাড়া হয় তার। কিন্ত ২০১১ সালে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয়। ২০১৫ এর আগস্ট এ শহর কে বসবাস উপযোগী ঘোষণা করা হলে একে একে মানুষজন আসতে থাকে এবং ফিলিস্তিনের এই বৃহত্তম নগরীর পথচলা শুরু হয়।

বর্তমানে রাওয়াবি ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বেশি চাকরি প্রদানকারী শহরগুলার মধ্যে একটি। বর্তমানে এই হাই-টেক নগরীতে দশ হাজারের বেশি মানুষের চাকরির সুযোগের পাশাপাশি রয়েছে আনুমানিক চল্লিশ হাজার মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা। শিক্ষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে রয়েছে ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রকৌশলী। পিছিয়ে নাই নারীরা। চাকরিজীবীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশই নারী।

নির্মানাধীন সময়কার রাওয়াবি সিটির দৃশ্য। ছবি: মাসার ডটকম।

রাওয়াবি শহর নির্মাণকালে বাশার আল-মাসরি সহ্য করেছেন অনেক আলোচনা-সমালোচনা। কারণ এই আধুনিক শহর নির্মাণের ক্ষেত্রে যে তার দ্বারস্থ হতে হয়েছে তার অমিত্র ইসরায়েল এর! হ্যা এই নগরী নির্মাণের প্রয়োজনে তার হাত মিলাতে হয়েছে ইসরায়েল এর আর্মি, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের সাথে। কারণ নির্মাণ কাজ সহজতর করতে বিভিন্ন সরঞ্জাম আনা হয়েছে যে ইসরায়েল থেকেই। কিন্ত এর জন্যে লজ্জিত নন মাসরি। তিনি বলেন, “আমাদের সাথে ইসরায়েলি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাথে বৈরিতার সম্পর্ক না। এবং আমি এই বিষয়ে খোলামেলা এবং এটা স্বীকার করতে আমি লজ্জিত না।”

শুধু দেশে বিদেশে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করেই ক্ষান্ত দেন নাই বাশার আল-মাসরি। তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ‘জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভার্নমেন্ট’ এর পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবেও রয়েছেন। এছাড়া পেয়েছেন ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম’ কর্তৃক “আগামী বিশ্বের লিডার” এর খেতাব। টাইমস অব ইসরায়েল এর তথ্যানুসারে ধনকুবের ও দানবীর বাশার আল-মাসরির মোট সম্পত্তি পনের’শ মিলিয়ন ডলার।