আলোচিত-সমালোচিত সাবেক বাংলাদেশ কোচ হাথুরুসিংহ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে এরকম ব্রাত্যই ঘোষনা করেছিলেন মিমি আর রিয়াদকে। সেই হাথুরুকে সামনে পেয়েই নিজেদের জাতটা চিনালেন বাংলাদেশ দলের এই দুই তারকা।
এক সময় মুমিনুলকে বলা হত বাংলাদেশের ব্রাডম্যান। অসাধারণ ব্যাটিং গড়, সহজাত প্রতিভা, নিখুঁত টেকনিক এবং চমৎকার ধারাবাহিকতা দিয়ে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং নিউক্লিয়াস হয়ে উঠেছিলেন মুমিনুল। চোখ ধাঁধানো সব ইনিংস তিনি উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশকে। কিন্তু হাথুরু দায়িত্ব নিতেই বদলে যেতে শুরু করলো দৃশ্যপট। লঙ্কান এই কোচের অনেক অসামান্য আবিষ্কারের একটি মুমিনুলের পেস বোলিং খেলতে না পারা! অদ্ভুত এই আবিষ্কার হজম হবার আগেই তিনি আবিষ্কার করলেন শুধু পেস না স্পিনেও দুর্বল মুমিনুল! পেস-স্পিন দুটিতেই দুর্বল একজন ব্যাটসম্যানের গড় কি করে ৪০+ হয় তা বের করতে গিয়ে বিষম খেয়েছিলেন অনেকেই। লঙ্কান এই কোচের অদ্ভুত আবিষ্কারে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিলেও বোর্ড আস্থা রাখলেন হাথুরু আবিষ্কারেই। এক সময়ের বাংলার ব্র্যাডম্যান বাদ পরে গেলেন ব্র্যাডম্যানের দেশ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সে সময় তার বাদ পরার পিছনে যে যুক্তিটি নির্বাচকরা দিয়েছিলেন সেটি ক্রিকেটিয় বিবেচনায় সহীহ গণ্য হলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। মুমিনুলের বাদ পরার কারণ হিসাবে উল্লেখ করা অফ-ফর্মের বিষয়টি সত্য। কিন্তু প্রশ্ন যেটি তা হলো, ধারাবাহিকতার অসাধারণ নজির স্থাপন করা একজন ব্যাটসম্যান আচমকাই কেন রান খরায় ভুগতে শুরু করলো? কোথায় হারালো তার সেই আত্মবিশ্বাস? সহজাত সব শট? এর উত্তর কেউ খুঁজেছেন বলে আমাদের অন্তত জানা নেই। ৭০ এর কাছাকাছি থাকা গড়টাও কেন নামতে নামতে ৪০ এর ঘরে এসে ঠেকলো?
ক্রিকেট যতটা স্কিলের ততটাই মানসিক, এ কথাটা নতুন না; বহু বছর ধরেই চলে আসছে। একজন ব্যাটসম্যান যত প্রতিভাবানই হন না কেন তার স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে দেয়ার বদলে খুঁত খুজে তাকে দল থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা হতে দেখলে কখনোই ভালো খেলতে পারবেন না। মুমিনুলের ইনিংসগুলোতে জড়তা, শট খেলার আড়ষ্টতাগুলো কি তার অদক্ষতার কারণে ছিলো নাকি কাধে চাপিয়ে দেয়া বিষম চাপের কারণে সে প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই উঠতে বাধ্য। তাকে তার মত করে খেলতে দিলে ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষের কি হালত তিনি করতে পারেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা গেল সদ্য সমাপ্ত টেস্টে। প্রথম ইনিংসে ওয়ান ডে স্টাইলে ব্যাট করেও নিখুঁত এক ইনিংস দিয়ে যেমন দলকে তুলেছেন ৫০০ রানের পাহাড়ে তেমনি দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট আকড়ে থেকে প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে জোড়া টেস্ট সেঞ্চুরি করে যেন হাথুরুর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের জাত। যে স্পিনের বিপক্ষে মুমিনুলকে দুর্বল ঘোষনা করেছিলেন হাথুরু তার দলের তিন স্পিনারকে নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন স্পিনটা তিনি শুধু খেলতেই না, বরং বেশ ভালোই খেলতে পারেন।
শান্ত স্বভাবের মুমিনুলের ভিতরের অাগুনটা বোঝা গিয়েছিলো প্রথম ইনিংসে তার সেঞ্চুরির পরই। শূণ্যে লাফিয়ে, বাতাসে ঘুসি মারা মিমিকে আগে কখনো কেউ দেখেছেন বলে মনে হয় না। জবাবটা ওখানেই দেয়া হয়ে গিয়েছে বলেই দ্বিতীয় ইনিংসে গর্বের সেঞ্চুরির পরেও দেখা গেল সেই শান্ত, নিরাবেগ মুমিনুলকে। প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে জোড়া সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েছেন বলে এমনিতেই ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ম্যাচটি, কিন্তু সাধারণ দর্শকদেরও বহু বছর চোখে লেগে থাকবে মুমিনুলের এই টেস্টের ব্যাটিং। চোখ ধাঁধানো সব শট, নিখুঁত টাইমিং, নিখুঁত প্লেসমেন্ট, লম্বা ইনিংস খেলার ধৈর্য্য; যে কোনো বিশেষনই বসিয়ে দিতে পারেন ইনিংস দুটোর সামনে। হাথুরু হয়ত মুখে কিছু বলবেন না, যা বোঝান তিনি বুঝে নিয়েছেন ব্যাট হাতে মুমিনুলের রূদ্র মুর্তির সামনে তার বোলারদের অসহায় অবস্থা দেখেই, কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচকরা কি বুঝেছেন ? এখানে এ দুপক্ষের কথা আসতে বাধ্য কারণ টেস্ট থেকে বাদ দেয়ার অনেক আগেই ওয়ান ডে দলের মুমিনুলের দরজা বন্ধ্ করে রেখেছেন তারা। প্রথম ইনিংসে তিনি সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন মাত্রই ৯৬ বলে। ছয়টি টেস্ট সেঞ্চুরির দুটি সেঞ্চুরিই একশ’র কম বলে। শট খেলতে পারার সামর্থ যে তার রয়েছে এটা বোঝার জন্য এই তথ্যটাই তো যথেষ্ট। ওয়ানডে তে বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই একজন মানসম্পন্ন ব্যাটসম্যানের খোঁজে রয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনকে দিয়ে চেষ্টা করার দৃশ্যও দেখেছি আমরা। অথচ, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মুমিনুল বরাবরই থেকে যাচ্ছেন উপেক্ষিত। ক্রিকেট সমর্থকদের আশা এই যে, নিজের যোগ্যতার যে প্রমাণ এই টেস্টে মুমিনুল রেখেছেন, তারপরেও আর অন্ধ হয়ে বসে থাকবে না বোর্ড।
উপেক্ষিত আরেক তারকা মাহমুদুল্লাহ। বহু বছর ধরে মিডল অর্ডারে বাংলাদেশকে সার্ভিস দেয়া এই অল-রাউন্ডারও পরেছিলেন হাথুরুর রোষানলে। দলের অন্যতম সিনিয়র সদস্য হবার পরেও সিরিজের মধ্যপথে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর হাথুরিও উদ্যোগও দেখেছি আমরা। বাংলাদেশ দলের ওয়ান ডে অধিনায়ক মাশরাফির হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় হাথুরু হার মানলেও পরে ঠিকই রিয়াদকে বাদ দিয়ে দেখিয়েছিলেন। টেস্টে ব্যর্থতার দায়ে শুধু টেস্টই না, ওয়ান ডে দল থেকেও তাকে নির্বাসনে পাঠানোর প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেই ফেলেছিলো প্রায়। ঘরোয়া লিগের পারফরর্ম্যান্স এবং সাকিবের ছুটিতে নেহায়েত যেন বাধ্য হয়েই তাকে দলে ফেরায় বোর্ড। ফিরেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অর্ধশতক তুলে নিয়ে জানিয়ে দেন যে, হাথুরু তার শেষ দেখে ফেললেও জাতীয় দলকে এখনো বহু কিছু দেবার আছে তার। সময়ের বদলা বোধহয় একেই বলে। সেই সফর শেষেই লঙ্কানদের দায়িত্ব নিলেন হাথুরু, আর সহ-অধিনায়ক হলেন মাহমুদুল্লাহ। নিয়মিত অধিনায়ক সাকিবের ইনজুরির কারণে টেস্টে বাংলাদেশের নেতৃত্বের ভার গিয়ে পরে রিয়াদের ওপর। হাথুরুর লঙ্কার বিপক্ষে দশম বাংলাদেশি টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে টস করতে নামেন রিয়াদ। প্রথম ইনিংসে তার হার না মানা ৮৩ রানের ইনিংসটি বাংলাদশকে সাহায্য করে স্কোর বোর্ডে ৫০০ রান জমা করতে। এই ইনিংসটি অধিনায়কত্বের অভিষেকে যে কোনো বাংলাদেশির সর্বোচ্চ। এখানেই থামেননি তিনিও। দ্বিতীয় ইনিংসে মাটি আকড়ে পরে থেকে লঙ্কানদের বাধ্য করেছেন ড্র মেনে নিতে। ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে অধিনায়কত্বের অভিষেকের দুই ইনিংসেই অপরাজিত থাকলেন রিয়াদ।
ওয়ান ডে বাংলাদেশের বহু স্বরণীয় জয়ের নায়ক তিনি। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শতক, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শতক প্রমাণ করে বড় মঞ্চগুলোতে দলকে টেনে নিতে তার বিকল্প নেই। কার্যকর বোলিং, সাথে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে রিয়াদ একটি পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ। অথচ তাকেই ছুড়ে ফেলতে দুবার ভাবেনি বোর্ড।
বিদেশ প্রীতি আমাদের মজ্জাগত। বিদেশীদের হাস্যকর প্রেসক্রিপশনকে অমরত্ব লাভের মহাঔষধ ভেবে পান করে জীবন দিতেও যেন আমাদের আপত্তি নেই। আখেরে লাভ হয় সেই প্রেস্ক্রিপশনদাতারই। এর আগে জিমি সিডন্স খুঁত খুজে পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুলের ব্যাক লিফটে। আশ্চর্য্য বিষয় হচ্ছে বিদেশী এই কোচদের যে কোনো কথাকেই কেন যেন বেদ-বাক্য বলে মেনে নেই আমরা। প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে পরে সৌম্যের নাম, হাথুরু তার মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন অসামান্য ক্রিকেটিয় প্রতিভা। তাই বারংবার ব্যর্থ হলেও দলে থেকে তার বাদ পরার দৃশ্য দেখা যায়নি। প্রতিভাকে হাথুরু খুঁজে বার করুক কিংবা অন্য কেউ সবার ক্ষেত্রেই মানদন্ড সমান হওয়া প্রয়োজন। শুধু মাত্র হাথুরুর বিশ্বাসের কারণেই যেখানে সৌম্য সুযোগের পর সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন, সেখানে মুমিনুল-মাহমুদুল্লাহকে আমরা দেখেছি ছিটকে পরতে। দায়টা সৌম্যের না। কেন তিনি ব্যর্থ হবার পরেও সুযোগের পর সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন এ প্রশ্নটি তাকে করাটাও যথার্থ না। দায়টা সম্পূর্ণভাবেই টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক প্যানেল এবং বোর্ডের। যেসকল খেলোয়াড়দের আমরা তাদের ক্যারিয়ারের শুরু থেকে দেখে আসছি, আচমকাই ভিনদেশ থেকে কেউ এসে তাকে অবমূল্যায়ন করাটা যতটা বাজে দৃষ্টান্ত তার চেয়ে বাজে হচ্ছে আমাদের বোর্ডের মুখে কুলুপ এটে সেই মূল্যায়ন কবুল করাটা। এটা এক ধরনের দৈন্যতা।
মুমিনুল-রিয়াদের প্রতিভা, সামর্থ্য নিয়ে সাধারণ দর্শক বা বোদ্ধাদের কখনো কোনো সংশয় ছিলো না, এখনো নেই। বিদেশী প্রীতি তে বধির হয়ে গিয়েছিলেন কর্তা ব্যক্তিরা। এ ম্যাচের পর সবার অন্তত এটুকু আশা থাকবে যে, অভিন্ন মানদন্ডেই সব খেলোয়াড়কে বিচার করা হবে এবং সকলেই চাপমুক্ত হয়ে নিজের সহজাত খেলাটা খেলতে পারবেন। যদি আশানুরুপ নৈপুণ্য কেউ দেখাতে ব্যর্থ হয়, তার বাদ পরাটা স্বাভাবিক। তেমন কিছু হলে কেউ প্রশ্নও তুলবে না। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় মমিনুল-মাহমুদুল্লাহ বাদ পরেছিলেন সেটা স্বাভাবিক ছিলো না। বিদেশীরা যা খুশী বলতে পারেন কিন্তু নিজেদের সন্তানদের রক্ষার দায়িত্বটা আমাদেরই। এই অনুধাবনটাই একান্ত কাম্য এখন।
শাবাশ মাহমুদুল্লাহ
শাবাশ মুমিনুল