দিনটা মাহমুদুল্লাহর জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ পুরো বিষয়টাই এতো আচমকা ঘটেছে যে তিনি নিজের ঘটনার নাটকীয়তায় অবাক হয়েছেন। এমন হঠাৎ করে অধিনায়ক হবেন তা কোন ভাবেই তাঁর ভাবনাতে ছিল না।
৩১ জানুয়ারী ২০১৮, জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়াম। বছরে নিজেদের প্রথম টেস্টে মুখোমুখি বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা। প্রস্তুত ম্যাচ রেফারি, প্রস্তুত সঞ্চালক; টস করার জন্যে দশম বাংলাদেশি অধিনায়ক হিসাবে মাঠে প্রবেশ করলেন মাহমুদুল্লাহ।
এবার একটু পেছনে ফিরে যান, খুব বেশি দুরে না, গেলো বছরের বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা সফরের সময়টাতে। এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই টেস্ট দল থেকে আচমকা বাদ পড়লেন, কোচের অনিচ্ছায় ওয়ান ডে দল থেকেও তাকে বাদ দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর কথা প্রকাশ পেলো গণমাধ্যমে। আচমকা সে আঘাতের সময়টাতে মাহমুদুল্লাহর ভেতরে কি চলছিলো তা বোধয় কেউই কখনো জানবে না, অন্তর্মুখি মাহমুদুল্লাহ যে মুখের চেয়ে ব্যাটে বলেই কথা বলতে বেশি ভালোবাসেন। অধিনায়ক মাশরাফির হস্তক্ষেপে ওয়ান ডে দলে থেকে যান মাহমুদুল্লাহ। সময় লীলা বোঝা বড় কঠিন। সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই ঠিক পরের ম্যাচটিতেই অধিনায়কের ভূমিকায় ময়মনসিহংয়ের এই সূর্য সন্তান। প্রতিপক্ষের কোচের ভূমিকায় ক্রিকেট দলে তাকে ব্রাত্য ঘোষণা করা হাথুরুসিংহয়ে। মনের ভেতরে যে অন্তর্দহন তা প্রকাশ পেয়েছে ব্যাট হাতে করা অনবদ্য অপরাজিত ৮৩ রানের ইনিংসটিতে। অধিনায়কত্বের অভিষেকে যেটি কোনো বাংলাদেশির সর্বোচ্চ রানের ইনিংস, একই সাথে সপ্তম বাংলাদেশি হিসাবে টেস্টে ছুঁয়েছেন ১ হাজার রানের ল্যান্ডমার্কও।
১৯৮৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, ময়মনসিংহ সদরের ধোপাখোলা। ওবায়েদ উল্লাহ এবং আরাফাত বেগমের ঘর আলো করে জন্ম নেন মাহমুদুল্লাহ। সবার আদরের রিয়াদ। শান্ত স্বভাবের এই মানুষটি কখনোই সেভাবে পাদ-প্রদীপের আলোয় আসেননি। অথচ বাংলাদেশের অনেক ঐতিহাসিক জয়ের পেছনে অসামান্য অবদান রিয়াদের। কেনো যেন তার ওপর একটু রুঢ় দেখা যায় বোর্ডকে। নীরবে বহুবার বাংলাদেশকে রক্ষা করার পরেও পান থেকে চুন খসলেই শুরু হয়ে যায় রিয়াদের বিকল্প খোঁজা। বেশ কবার দল থেকে বাদ পড়লেও যোগ্যতা দেখিয়ে ঠিকই ফিরেছেন দলে।
রিয়াদ যে মানসিকভাবে কতটা শক্তিশালী তা জানতে একটি ছোট্ট তথ্যই যথেষ্ট। ওয়ান ডে ক্রিকেটে তার তিন সেঞ্চুরির দুইটিই এসেছে বিশ্বকাপে, একটি ওয়ান ডের সেরা আট দলের আসর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। ‘১৫ এর বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দলটা বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। সে দলের কেউ প্রথমবারের মত বিশ্বমঞ্চে তিন অংকের রানের দেখা পাবেন এমনটা সবার প্রত্যাশা থাকলেও রিয়াদের নাম কেউ নেননি । উপেক্ষা ততদিনে গা সয়ে গিয়েছে। তামিম-মুশফিক কিংবা সাকিবদের কেউ না বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে সেঞ্চুরি করার অনন্য গৌরব অর্জন করলেন রিয়াদ। তার সে সেঞ্চুরির সুবাদে পাওয়া ঐতিহাসিক জয়ে প্রথমবারের মত কোয়ার্টারে পা রাখে বাংলাদেশ। পরের ম্যাচটিতেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে সবটুকু আলো নিজের দিকে টেনে নেন রিয়াদ। কিন্তু সে ম্যাচে আর শেষ রক্ষা হয়নি। বাংলাদেশ হেরে যায় তিন উইকেটে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেও হারের জ্বালা তিনি মিটিয়েছেন ২০১৭ সালের ৯জুন কার্ডিফে। নিউজিল্যান্ডের বেঁধে দেয়া ২৬৬ রানের লক্ষে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৩৩ রানেই চার উইকেট হারিয়ে যখন দিশেহারা বাংলাদেশ তখনই ক্রিজে আসেন রিয়াদ। সাকিব আল হাসানকে নিয়ে গড়েন ২২৪ রানের রেকর্ড জুটি। ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে ১০২ রানে অপরাজিত থেকে দলের সেমি ফাইনাল নিশ্চিত করেই মাঠ ছাড়েন তিনি। বিশ্বমঞ্চে তার এমন নৈপুণ্য অবশ্য নতুন কিছু না। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো তার। ২২৬ রান তাড়া করতে নেমে ১৬৯ রানেই ৮ উইকেট খুইয়ে ফেলেছিলো বাংলাদেশ। সেখান থেকে শফিউলকে নিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌছে দেয়ার কাজটি করেন রিয়াদ।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ১০ বছর পার করা রিয়াদের অভিষেক হয়েছিলো বোলিং অল-রাউন্ডার হিসাবে। ক্যারিয়ারের অনেকটা সময়ই কাটাতে হয়েছে লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিং করেই। জীবনের সাথে যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে শ্রীলঙ্কার নাম। ২০০৭ সালের ২৫ জুলাই কলোম্বতে লঙ্কানদের বিপক্ষে রঙ্গিন পোষাকে অভিষেক । প্রথম ম্যাচে বল হাতে ৫ ওভারে ২৮ রানের বিনিময়ে নিয়েছিলেন দুই উইকেট। ব্যাট হাতে করেছিলেন ৩৬ রান। একই বছরের পয়লা সেপ্টেম্বর কেনিয়ার বিপক্ষে টি টোয়েন্টিতে অভিষেক। ক্রিকেটারদের স্বপ্নের সাদা পোষাকে অভিষেক হয় তার দুই বছর পর, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। প্রথম টেস্টে ব্যাট হাতে ব্যর্থ রিয়াদ বল হাতে আট উইকেট তুলে নিয়ে দারুণ ভুমিকা রাখেন দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ে।
দল যখনই বিপদে নিরবে দলকে রক্ষা করার দায়িত্বটা যেন স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন রিয়াদ। দিন শেষে তাকে নিয়ে নেই তেমন আলোচনা, উচ্ছাস। এটাকে যেন নিয়ম বলেই মেনে নিয়েছেন সদা হাস্যোজ্জ্বল এই ক্রিকেটার। মাঠে তার ধীর স্থির বিচরণে ভেতরের আগুনের আঁচটা সেভাবে বোঝা যায় না। অবলীলায় মারা ছয় কিংবা উইকেট পাওয়ার পরের মিষ্টি হাসিটা যেন শেল হয়ে বিধে প্রতিপক্ষের বুকে। এত নীরবে এমন ঝড়ও তোলা যায়? যায়, আর সেটি তুলতে পারেন শুধু রিয়াদই। বহু জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ম্যাচ শেষেই কেমন যেন চলে যান আড়ালে, সব আলোটুকু সতীর্থদের জন্য বরাদ্দ রেখেই।
২০১১ সালের ২৫ জুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রিয়াদ। পাত্রী জান্নাতুল কাউসার মিষ্টি। পরের বছরের জুন মাসের ৩ তারিখে রিয়াদ-মিষ্টির ঘর আলো করে জন্ম নেয় রিয়াদ জুনিয়র। জাতীয় দলে একদশক পেরিয়ে গেলেও বিতর্কের সামান্যতম আঁচও নিজের গায়ে লাগতে দেননি তিনি। জাতীয় দলের সদ্য সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম সম্পর্কে রিয়াদের ভায়রা। পারফর্ম্যান্সের গ্রাফ যখন কিছুটা নিন্মমুখী তখন সমালোচকরা, রিয়াদ ভায়রা কোটায় খেলছেন বলে কটাক্ষ করলেও আশ্চর্য সংযমের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। সমালোচকদের সমালোচনা অসাঢ় করে দাপটের সাথেই মাঠ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন রিয়াদ।
আপাত নিরীহ চাহনির ভেতর থেকে যখন বাঘ বেরিয়ে আসে আর একের পর এক বল বাউন্ডারি পার করে তাক লাগিয়ে দেন, দুর্দান্ত সাহস নিয়ে লড়ে যান তখন। মাহমুদুল্লাহর প্রশংসার জন্য মিডিয়ার খবরের অপেক্ষা করতে হয় না। ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকদের মনে তিনি ধীরে ধীরে নীরব হিরো হয়ে ওঠেন। এমনিতেও তিনি অবশ্য একটু চুপচাপই থাকেন। তবে কাছের বন্ধুদের সাথে তার প্রাণখোলা আড্ডা বেশ জমে ওঠে। আর স্বাভাবিক ভাবে তিন একটু লাজুকও আছেন। নিজেকে সবসময়ই একটা বিনয়ের ভেতর দিয়ে প্রকাশের মাধুর্য মাহমুদুল্লাহকে সত্যিই নীরব হিরো করে তুলেছেন।
আজ যখন ব্যাটিংয়ে নামবেন পুরো বাংলাদেশই তাকিয়ে থাকবে তার দিকে। তিন উইকেট হারিয়ে যে প্রমোদ গুণছে বাংলাদেশ। এমন অবস্থা থেকে দলকে রক্ষার জন্য রিয়াদের চেয়ে বেহতার কে আছেন? জন্মদিনে বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজন, ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে কত উপহারই তো পেয়েছেন; এবার সুযোগ নিজেকেই নিজের উপহার দেয়ার। আর সেটি যদি আরো একটি রিয়াদীয় ইনিংসের মাধ্যমে হয় তার চেয়ে খুশি বোধয় কেউ হবেন না। রিয়াদীয় ইনিংস মানেই যে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ কিছু। বরাবরই নিজের চেয়ে দলকে প্রাধাণ্য দেয়া রিয়াদের ব্যাটের দিকেই তাকিয়ে বাংলাদেশ। সামনে যখন উপেক্ষার যন্ত্রনা দেয়া হাথুরু, ক্ষত উপশমে এটুকু তো রিয়াদ করতেই পারেন…