শৈশব থেকে কবিতার প্রতি ভালােবাসা ছিল তার। প্রথম কবিতা লিখেই বাবাকে দেখিয়ে পুরস্কার জিতেছিলেন কবিতার নোট খাতা। সেটিই কবিতা লেখার ক্ষেত্রে প্রেরণার বাতি হয়ে ঠাঁই পেয়েছে কাশ্মীরি-আমেরিকান বিখ্যাত কবি আগা শহিদ আলির মনে। তার সঙ্গে ছিল কাশ্মীরে জনতার প্রতি ভারতের অত্যাচারের নির্মম অভিজ্ঞতা। ওই অভিজ্ঞতার সঙ্গে দেশান্তরী হৃদয়ের লম্বা যাত্রাপথ তার কবিতায় ফুটে উঠেছে। মূলত ১৯৭০ সাল থেকেই নানান জায়গায় তার কবিতা প্রকাশিত হলেও ১৯৮৭ সালে তার প্রথম কবিতার বই ‘অ্যা ওয়াক থ্রো দি ইয়েলো পেজেস’ বিার নজর কেড়ে নেয়। এরপর তিনি একটু বিরতি নিয়ে প্রকাশ করেন “অ্যা নস্টালজিস্ট’স ম্যাপ অফ আমেরিকা” (১৯৯১)। তার ওই প্রবাস জীবন ও কাশ্মীরের প্রতি গভীর স্মৃতিকাতরতা ফুটে উঠেছে এই কবিতার বইয়ে।
১৯৯৭ সালে আগা শহিদ আলি লেখেন নিজের রক্তাক্ত জন্মভূমি কাশ্মীর নিয়ে কবিতার বই ‘দি কান্ট্রি উইদাউট অ্যা পোস্ট অফিস’। প্রকাশের পর পরই পাঠকদের মনোযোগের কেন্দ্রে হাজির হন তিনি। ১৯৯০ সালে কাশ্মীরের আপামর জনতা ভারতের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে প্রবল সামরিক অভিযানের মুখোমুখি হয় তারা এবং ওই অভিযানের পর কাশ্মীরের সব পোস্ট অফিস বন্ধ থাকে দীর্ঘ সাত মাস। ওই নির্মম প্রেক্ষাপট সামনে রেখেই ওই কবিতার বইটি লেখেন তিনি। সাম্প্রতিক কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের মঞ্চগুলোয় নানান সময় ওই কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়। এমনকি কাশ্মীরের এক নিরীহ স্বাধীনতাকামী পুরুষ আফজাল গুরুকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই কবিতা লড়াইয়ের জাতীয় ভাষা হয়ে ওঠে। শুধু ভারতীয় লড়াই-সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে অত্যাচারের বিরুদ্ধেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রেও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতেন এই কবি। স্পষ্ট প্রকাশভঙ্গি এবং ইউরোপিয়ানসহ ফার্সি, আরবি ও উর্দু কবিতার নানান উপাদান তার কবিতায় হাজির থাকে। ফলে তার কবিতা হিন্দু, মুসলিম ও পাশ্চাত্য তিনটি সংস্কৃতি ধারণ করেই এগিয়ে যায়।
গজল নিয়ে শহিদ আলির কাজও ছিল নজরকাড়া। ২০০১ সালে ‘কল মি ইসমায়েল টুনাইট’ বইয়ে ইংরেজি ভাষায় গজল রচনা করে তাক লাগিয়ে দেন সাহিত্য বোদ্ধাদের। এছাড়া তিনি পাকিস্তানি বিখ্যাত কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে উর্দু সাহিত্যটি বিশ্ব সাহিত্য দরবারে নতুনভাবে হাজির করেন। অন্যদিকে তিনি গজল শিল্পী বেগম আখতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। তিনি লিখে ফেলেন, ‘ইন মেমোরি অফ বেগম আখতার’।
ওই কবির জন্ম ১৯৪৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের নতুন দিল্লি শহরে। পরবর্তীকালে কাশ্মীরের শ্রীনগরে বেড়ে ওঠেন। শিক্ষকতার পেশায় জড়িত পিতা-মাতার সন্তান শহিদ অালি ক্রিস্টিয়ান মিশনারি স্কুল থেকে নিজের বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে হাজির হন কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়াশোনা শেষে ১৯৭৫ সালে পাড়ি জমান আমেরিকায়। সেখানে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয় বেশকিছু বছর সময় দেন। পেনসিলভানিয়া থেকেই তিনি ১৯৮৪ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কাশ্মীরি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয়-আমেরিকান কবি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন। কবিতা লেখার পাশাপাশি সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন দু’তিন দশক। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস-আর্মহেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়ারেন উইলসন কলেজ এবং পরবর্তীকালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন।
কবিতার স্বীকৃতি হিসেবে শহিদ আলি পেয়েছেন ২০০১ সালে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডসহ নানান ফেলোশিপ। ২০০১ সালের ৮ ডিসেম্বর নিজের ভাইয়ের বাসায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। দুরারোগ্য ব্রেইন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫২ বছর বয়সে পৃথিবী ত্যাগ করেন বিরহ আর প্রতিবাদের ওই কবি। তার আরো কবিতার বইয়ের মধ্যে আছে-
Rooms Are Never Finished (2001)
The Beloved Witness: Selected Poems (1992)
A Nostalgist’s Map of America (1991)
The Half-Inch Himalayas (1987)
In Memory of Begum Akhtar and Other Poems (1979)
Bone Sculpture (1972)
২ thoughts on “অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা কবিতা”
কমেন্ট বন্ধ।