মেসবাহ কামালদের আত্মসমর্পণ কী বার্তা দেয়

মন্তব্য প্রতিবেদন

মেসবাহ কামালদের আত্মসমর্পণ কী বার্তা দেয়

মেসবাহ কামালের মাদ্রাসাফোবিক বক্তব্য মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চরম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। জনমতের ওই জাগরণ কোনােভাব্ই পাশ কাটানোর উপায় না দেখে মেসবাহ কামাল ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন। ওই ঘটনাই প্রমাণ করে, এনজিও বুদ্ধিজীবিতাকে নীরবে মেনে নেয়ার দিন শেষ। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এমন প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে ডিজিটাল ‘মব জাস্টিস’ বলছেন। আর ওই ‘মব’ বা ‘জনমত’ তথাকথিত প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধেই দিন দিন সোচ্চার হচ্ছে।

সম্প্রতি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামালের দেয়া বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে। পরে মেসবাহ কামাল তার ফেসবুকে ক্ষমা চেয়ে দুঃখ প্রকাশ করে যে বক্তব্য দিয়েছেন এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ হচ্ছে, মেসবাহ কামালদের ওই বিদ্বেষপূর্ণ অবস্থান আজ নতুন নয়। যারা মেসবাহ কামালদের চেনেন তারা ঠিকই জানেন কীভাবে তারা বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদের সুবিধা ভোগ করে সমাজের বিভিন্ন অংশকে ‘অপর’ বানিয়ে দেখান। ফলে মেসবাহ কামালরা যখন তাদের দেয়া বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান তখন তা সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শুধু আনন্দিতই করে না, বরং তাদের ওই ‘বিদ্বেষপূর্ণ এনজিও জ্ঞানের পাহাড়’ যে ধ্বসের মুখে আছে এ ব্যাপারটিও উদাম হয়ে যায়। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওই পরিবর্তনের প্রবণতা বাংলাদেশের সমাজের জনচৈতন্যকে নতুন করে তৈরি করছে।

এগুলোকে সমাজ পরির্বতনের চিহ্ন হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা এবং ওই ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে ইসলামোফোবিক বা মাদ্রসাবিদ্বেষী বুদ্ধিজীবী তার পরাজয়ের আলামতকে বুঝে নিতে সমস্যা হচ্ছে না সমাজ ও রাজনীতি সচেতন নতুন প্রজন্মের।

আবার মেসবাহ কামাল যখন তার বক্তব্যে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন একটি উচ্চতর মাদ্রাসায় পরিণত হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষায় মাদ্রাসা ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা জায়গা পাচ্ছে না। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশেরও বেশি ভর্তি হয় মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা। এটা কোনােভাবে গ্রহণযোগ্য নয়’ তখন তার এই কথার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রতি তার চরম বিদ্বেষের প্রকাশ যেমন দেখা যায় তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটা এজেন্ডাও যে আছে সেটিও চোখে পড়ে। তাই তার ওই বক্তব্যের পেছনেও কোনো এনজিওর হাত আছে কি না তা খোঁজা জরুরি। কেননা এনজিও প্রজেক্টের বাইরে মেসবাহ কামালরা কথা বলবেন এটা অনেকে ভাবতেই রাজি নন।

এখানে কিছু বিষয় বোঝা খুবই জরুরি। নাগরিক প্রতিবাদের মুখে মেসবাহ কামালের দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়া মানেই সব শেষ নয়, বরং এটি আমাদের কিছু জরুরি প্রশ্নের মুখোমুখি করে। তিনি যখন বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফোরের একটা স্কুলের ছাত্রের সমান ইংরেজিও জানে না এবং তারা এই জ্ঞান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি করে তখন কীভাবে তারা এই ক্লাস ফোরের ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় আর কর্তৃপক্ষ কিংবা মেসবাহ কামালরাই সেখানে কী করেন ওই জবাব তিনি দেন না। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে জনগণ কি ওই দায়িত্ব অবহেলার জন্যই নিজেদের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়? আর তার ওই অভিযোগের দায় তিনি কি এড়াতে পারেন? এ জন্য মেসবাহ কামালের ওই মিথ্যার ওপর দেয়া বক্তব্য নিয়ে তাকেই প্রশ্ন করা দরকার।

অধ্যাপক মেসবাহ কামালের দেয়া ফেসবুক স্টেটাস-এর স্থিরচিত্র
অধ্যাপক মেসবাহ কামাল দুঃখ প্রকাশ করে দাবি করেছেন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি শঙ্কিত। তার আসলেও শঙ্কিত হওয়া উচিত। কিন্তু তা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়, তিনি বরং নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কারণ আমাদের ছেলেমেয়ে ও তাদের ছেলেমেয়ে বলে মেসবাহ কামালরা যে বিভক্তির রেখা টেনে মাদ্রাসার ছাত্র থেকে অন্যদের আলাদা করার চেষ্টা করেন তা আর কেউ মেনে নিচ্ছেন না। ফলে তাদের ওই ধরনের বুদ্ধিজীবিতার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। মূলত শাহবাগের পরই ওই ধারার বুদ্ধিজীবিতার প্রচারণা ও সামজিক গুরুত্ব কমতে শুরু করেছে। অচিরেই তাদের সব ভূমিকা মানুষের প্রতিবাদ ও সমালোচনার কারণে সমাজ থেকে ‘নেই’ হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

দুঃখ প্রকাশ করে দেয়া ফেসবুক স্টেটাস-এ ইতিহাসের ওই অধ্যাপক বলেন, ‘ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি জানি যে, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এ দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থা। তাছাড়া উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও মওলানা ভাসানী (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পাশাপাশি যে দু’জন আমার পরম শ্রদ্ধেয়) তাঁরা দু’জনেই মাদ্রাসায় পড়েছেন।” এখানে মাওলানা আজাদের মাদ্রাসায় পড়ার তথ্যটি ভুল। মওলানা ভাসানী মাদ্রাসায় পড়লেও আজাদ কখনো মাদ্রাসায় পড়েছেন বলে জানা যায়নি। তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই নেননি। পারিবারিক শিক্ষা ও নিজের চর্চার মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠেন। যিনি ১৯০০ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সেই একটি পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দরকারও পড়ে না। দুঃখজনকই বটে, ইতিহাসের অধ্যাপক হয়েও নিজের পরম শ্রদ্ধেয় তিনজনের একজনের জীবন নিয়ে ভুল তথ্য দেন।

অন্যদিকে ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দি ইকনমিস্ট’-এর ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর সর্বশেষ (২০১৪ সালের মার্চে প্রকাশিত) প্রতিবেদন আমাদের দেখায়, বাংলাদেশে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের ৪৭ শতাংশই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চ শিক্ষিত বেকার আছে কেবল আফগানিস্তানে- ৬৫ শতাং। ওই বেকারদের মধ্যে বড় অংশ মাদ্রাসায় পড়া নয়। তাই সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে শঙ্কিত না হয়ে শুধু মাদ্রাসায় পড়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার ওই শঙ্কিত হয়ে পড়াও সন্দেহের চোখে দেখা উচিৎ। এটিও সত্য বক্তব্য বলে মনে করার কারণ নেই। আসলে সমালোচনা থেকে বাঁচতে তিনি ওই কৌশলী বক্তব্য দিয়েছেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কথায় কথায় তাদের ওই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ার মনস্তত্ত্ব। মাদ্রাসার ছাত্ররা যখন ভালো ফল অর্জন করেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হতে পারেন না তখন সেটি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন হন না। তিনি উদ্বিগ্ন হন, কেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি ভর্তি হচ্ছেন তা নিয়ে। তার দাবি, বর্তমানে ঢাকা বিশেবিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী মাদ্রাসা থেকে আসা এবং সেটি নাকি অগ্রহণযোগ্য। তার ওই ফ্যাসিবাদী উদ্বেগ একদিকে যেমন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্যের দিকে নির্দেশ করে অন্যদিকে তেমনি ক্রমাগত ভালো ফল করার পরও মাদ্রাসা ছাত্রদের কীভাব মূল স্রোত থেকে আলাদা করে দেখা হচ্ছে এর প্রমাণ দেয়। এগুলো যে ভবিষ্যতে কতটা ভয়াবহ পরিণতি বহন করবে তা বলাই বাহুল্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হলো অন্যতম সেরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। আর এতে কয়েক বছর ধরেই মাদ্রাসা থেকে আসা পরীক্ষার্থীরাই এগিয়ে থাকছেন। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা এখন প্রশ্ন ফাঁসের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যেও যে মাদ্রাসার ছাত্ররা ভালাে করছেন এতে বরং মাদ্রাসা শিক্ষাকে অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন।

আশার কথা হলো, সবকিছুর পরও মেসবাহ কামালের ওই বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেনি। এ ইস্যুতে মানুষ সহনূভতিশীল না থেকে বরং নাগরিক দায়বদ্ধতা থেকেই ওই বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছে। ফলে তাকে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে হয়। তাই ওই ক্ষমা চাওয়াকে অন্যভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এটি সরাসরি আত্মসমর্পণ। ওই আত্মসমর্পণ হলো সচেতন নাগরিক প্রতিবাদের কাছে এক ধরনের উপনিবেশিক মানসিকতার আত্মসমর্পণ যেখানে একই সীমানা মধ্যেও বিভাজনের বৃত্ত এঁকে দেয়। তাই অন্তর্ঘাতমূলক পঙ্গু মানসিকতার বিরুদ্ধে ওই সচেতন প্রতিবাদ অব্যহত থাকলেই কেবল এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এটি নতুন দিনের জন্য শুভবোধ জাগ্রত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

অধ্যাপক মেসবাহ কামালের বক্তব্যের ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে