সুপারহিরো শুনলেই আমাদের মাথায় সবার আগে আসে সিনেমায় দেখা স্পাইডারম্যান, আয়রনম্যান বা সুপারম্যানের কথা। তারা তো শুধু কাল্পনিক, গল্পের প্রয়োজনে তৈরি। সেলুলয়েড পর্দা বা বইয়ের পাতার বাইরে তাদের অস্তিত্বই নেই। কিন্তু যদি বলা হয় বাস্তবের সুপারহিরো কারা বা প্রশ্ন করা হয় আপনার জীবনের হিরো কে? তাহলে হয়তো অনেকের নামই মাথায় আসবে কিংবা কারো জানতে ইচ্ছা হতে পারে সফল ব্যক্তিদের হিরো কারা। মাইক্রোসফট-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসকে সবাই চিনি।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাওিই ধনকুবের শুধু বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিই নন- একাধারে দানবীর, দেশপ্রেমিক ও লাখো তরুণের চোখে সুপারহিরো। লাখো মানুষের জীবন নানানভাবে নানান সময় প্রভাবিত করেছে তার চিন্তা, কাজ বা নির্দেশনা। এবার লাখো মানুষের চোখে হিরো যে মানুষ তার চোখে হিরো হওয়ার মতো মানুষ হয়তো কল্পনাতেই সম্ভব। কিন্তু এটি কল্পনায় নয়, বাস্তবেই এমন মানুষ আছে যাদের বিল গেটস নিজের কাছে হিরো মনে করেন। যাদের দ্বারা তিনি বিভিন্ন সময় অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আর এমনই পাঁচজনের কথা জানান তার নিজস্ব ব্লগে। আসুন জেনে নিই বিল গেটসকে অনুপ্রাণিত করা ওই পাঁচ সুপারহিরোর কথা—
এক. সেগেনেট কেলেমু
৬০ বছর বয়সী এই প্লান্ট প্যাথলজিস্ট-এর জন্ম ১৯৬০ সালে ইথিওপিয়ার একটা অনুন্নত গ্রামে। কৃষিপ্রধান ওই গ্রামে জন্ম হওয়া কেলেমু শৈশবে নিজের চোখের সামনে দেখেন তার গ্রামের সব ফসল কীভাবে পোকার আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই বিপর্যয়ের ভুক্তভোগী হওয়ার পর মনে মনে শপথ নেন এবং স্বপ্ন দেখেন ওই আক্রমণ থেকে তার গ্রামকে রক্ষা করবেন। এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখতে চান।
ফলে তার জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়ালেখা করা। লক্ষ্য পূরণের প্রথম ধাপ হিসেবে তার গ্রামের সর্বপ্রথম নারী হিসেবে কলেজ ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরে আমেরিকা থেকে প্লান্ট প্যাথলজিস্ট হিসেবে শিক্ষাজীবন শেষ করেন কেলেমু। দক্ষিণ অ্যামেরিকার একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠাণে টানা ২৫ বছর কাজ করে ২০০৭ সালে তিনি ফিরে যান নিজের দেশে। সেখানে একদল তরুণ বিজ্ঞানীকে নিয়ে নেমে পড়েন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে। এখন নাইরোবি-র ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনসেক্ট ফিজিওলজি অ্যান্ড ইকোলজি’র সম্মানিত পরিচালক হিসেবে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
দুই. ম্যাথিও ভারঘেজ
বেশভূষায় অবশ্য বোঝার কায়দা নেই পাশের ছবির ব্যক্তি কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার। গতানুগতিক ডাক্তারদের মতো তার গলায় দেখা যায় না স্টেথোস্কোপ। এর পরিবর্তে হাতে থাকে রাবারের হাতুড়ি যা দিয়ে রোগীদের হাড় পরীক্ষা করতে ব্যস্ত থাকেন সব সময়।
বলছি ভারতের দিল্লিতে সেইন্ট স্টিফেন হাসপাতালের অর্থোপেডিক ডাক্তার ম্যাথিও ভারঘেজ-এর কথা। ২০১১ সালে ভারতের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর মধ্যে একটি ছিল পোলিওমুক্ত সমাজ গড়া। ভারতে অতীতে কয়েক পোলিও রোগী থাকলেও এখন আর কেউ পোলিওতে আক্রান্ত হয় না। সেইন্ট স্টিফেন হাসপাতালে ভারতের একমাত্র পোলিও ওয়ার্ডের পরিচালক ম্যাথিও ভারঘেজ-কে এ জন্য তারিফ করতেই হয়। তার একান্ত অধ্যবসায় ও চেষ্টার ফলে অনেক পোলিও আক্রান্ত ব্যক্তি আজ চলাফেরা করতেও সক্ষম।
তিন. আডা অকোলি
নাইজেরিয়ান ডাক্তার আডা অকোলি। চিকিৎসাসেবায় সব সময়ই নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। হঠাৎ ২০১৪ সালে তিনি খবরের শিরোনাম হন বিরল রোগ ইবোলা-য় আক্রান্ত হয়ে। ইবোলা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেই আক্রান্ত হন ওই মারাত্মক জীবনঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণে। তাই বলে দমে যাননি আজীবন মানুষের সেবার ব্রত নেয়া আডা অকোলি। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেনি তিনি। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখে দমে যাননি। বাকি জীবন মানবতার জন্য বিলিয়ে দিতে চান বলে তিনি মন দেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষের কাজে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এসেও নতুন করে শুরু করার ওই সাহসী উদ্যোগই গেটসকে নানানভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
চার. অ্যানা রসলিং
গ্যাপমাইন্ডার-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ৪২ বছর বয়সী অ্যানা রসলিং। গ্যাপমাইন্ডার হলো সুইডেনের স্টকহমের একটি অলাভজনক সেবা প্রতিষ্ঠান। গ্যাপমাইন্ডারের মাধ্যমে শিশুদের কাছে শিল্প ও বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে এই জটিল পৃথিবীকে সহজ করে বােঝাতে চেষ্টা করেন অ্যানা রসলিং। যেমন- সুইডেনের রাস্তায় নানান তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তিনি কিছু চিত্রকর্ম আঁকানোর ব্যবস্থা করেন। এসব ছবিতে পৃথিবীতে মানুষের ক্রমবিবর্তনের ধারা সম্পর্কে সহজেই ধারণা পাওয়া যায়।
পাঁচ. ক্যামিল জনসন
ওয়াশিংটনের রিয়াল কুইন্সি অঞ্চলে জন্ম বিল গেটসের অন্যতম প্রেরণা ক্যামিল জনসন। কুইন্সির পাইওনিয়ার এলিমেন্টরি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষিকা ক্যামিল জনসন ২০১৭ সালে ওয়াশিংটন রাজ্যের ‘টিচার ফি দি ইয়ার’ সম্মানে ভূষিত হন। শ্রেণিকক্ষে তার ছাত্রছাত্রীদের আগামী দিনের উজ্জ্বল স্বপ্ন দেখতে প্রভাবিত করেন। গতানুগতিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার পরিবর্তে হাতে-কলমে শিক্ষাদানে বেশি গুরুত্ব দেন তিনি যা তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে।
নিজের জীবনকে সাজাতে বিল গেটস উপরের ওই ব্যক্তিদেরই অনুপ্রেরণা মনে করেন। আসলে যে কোনাে কাজ থেকেই যে কেউ অনুপ্রাণিত হতে পারেন। জনপ্রিয় সাহিত্যিক নিকোলাস স্পার্কস যেমন বলেন, ‘অনুপ্রেরণা যে কোনোদিক থেকেই আসতে পারে। অনুপ্রেরণা আসতে পারে কোনো ছবি থেকে বা কোনো মন্তব্য থেকে কিংবা নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা থেকেও।’