কেন সব ভুলে যাই

কতো বই পড়ি, সিনেমা দেখি

কেন সব ভুলে যাই

প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেখা ও শোনার কাজ আজ খুব সহজলভ্য এবং মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক কিংবা মোবাইলর ফোনের মেমােরিতে ঢুঁ মারলে সেখানে শত শত বই বা সিনেমা পাওয়া যাবে যা আমরা প্রায় বিনামূল্যে ও কোনো চেষ্টা ছাড়াই সংগ্রহ করে রেখেছি। এখন আর বই পড়ার জন্য দিনের পর দিন টাকা জমাতে হয় না, দোকান থেকে কিনে আনতে হয় না বা লাইব্রেরি থেকে এক সপ্তাহিকিংবা দশ দিনের মেয়াদে ইস্যু করে আনতে হয় না। সিনেমা দেখার জন্য এখন আর আমাদের সিনেমা হলে যাওয়া লাগে না বা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখার প্রয়োজন পড়ে না। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি ডিসপ্লেওয়ালা স্মার্টফোনের এই পৃথিবীতে আজ যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো তথ্যের ভাণ্ডারে প্রবেশ করা সম্ভব। তা মুরাকামি-র সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসই হোক আর নোলান-এর নতুন কোনো সিনেমাই হোক না কেন। যেহেতু কোনো কিছু সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে কষ্ট ও সময় দুটিই আমাদের আজ কম লাগছে, সেহেতু আমাদের জ্ঞানের পরিধিও আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু আদতে চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন।

আজ যখন আমরা একটা বই পড়ে শেষ করি, মূলত বইটির প্রচ্ছদ কেমন ছিল বা বইটা আমাদের কে পড়তে দিয়েছিলন এতটুকুই আমাদের মনে থাকে। আমাদের মনে থাকে কোথা থেকে আমরা বইটি কিনেছিলাম কিংবা বইটি মোটা ছিল, নাকি চিকন। যা আমাদের মনে থাকে না তা হচ্ছে, বইটাতে আসলে কী ছিল, বইটা কী নিয়ে লেখা হয়েছিল, বইটাতে কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল বা বইটাতে কী কী বিষয় তুলে ধরা হয়েছিল- এসবের কোনোটাই কিছু সময় পর আমাদের মাথায় থাকে না। নিউ ইয়র্ক টাইমস বুকসের সম্পাদক পামেলা পলের মতে, ‘যখন আমি বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন-এর জীবনী পড়ছিলাম তখন আমেরিকান রেভলিউশনের ওপর লেখা অংশটা আমার খুবই ভালো লেগেছিল এবং মনে হচ্ছিল, ওই তথ্যগুলো আমার অনেক দিন মনে থাকবে। কিন্তু বইটা পড়ে শেষ করার মাত্র দুই দিনের মধ্যে আমেরিকান রেভলিউশন আমার মাথা থেকে গায়েব। এখন আমি চাইলেও আর বইয়ের ওই অংশটা মনে করতে পারব না যদি আরেকবার রিভিশন না দিই।’

ভুলে যাওয়ার এই প্রবণতাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ‘ফরগেটিং কার্ভ’ বলা হয়। কানাডার আথাবাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারিয়া সানার মতে, ‘আমাদের মস্তিষ্কের একটি স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা আছে। কোনো কিছু জানার পর কেবল ২৪ ঘণ্টার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক ওই বিষয়ে সচেতন থাকে। যদি বিষয়টির ওপর পুনরায় চোখ বােলানো না হয় তাহলে কোনো কিছু পড়ার একদিন পর থেকে আমরা সেটি ভুলতে শুরু করি এবং এভাবে যত দিন যায়, ভুলতে থাকার পরিমাণও ততই বাড়তে থাকে। এভাবে একটা পর্যায়ে গিয়ে যা আমরা পড়ি এর কোনোটাই আর আমাদের মনে থাকে না।

এই মনে রাখা কিংবা ভুলে যাওয়ার পুরো ব্যাপারটির সঙ্গে স্মৃতিশক্তি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বর্তমান যুগে স্মৃতিশক্তির ধারণাটা একেবারেই পাল্টে গেছে। মানুষ এখন জ্ঞানকে বস্তু বা দ্রব্যের মতো ভক্ষণ করে। চাল-ডাল-আটা, কাপড়, টাকা-পয়সা ইত্যাদি বস্তুবাদী বিষয়গুলো ভোগ করার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই মানুষ এখন জ্ঞান অর্জনও দেখে। মানুষ এখন চায় তথ্য, যত বেশি তথ্য যত কম সময়ে যত সহজে জোগাড় করা যাবে তত বেশি উন্নতি করা যাবে, পয়সা কামানো যাবে, উপরে ওঠা যাবে, সফল হওয়া যাবে- এই হচ্ছে আধুনিক যুগের মানুষের চিন্তা-ভাবনা। প্রাযুক্তিক বিপ্লব ও বিকাশ মানুষের ওই ধারণাটি আরো পাকাপোক্ত করে দিয়েছে। মানুষ এখন জানে কোথায় কোন তথ্য আছে এবং কীভাবে ওই তথ্য জোগাড় করতে হবে। এতে কোনো কিছু মনে রাখার প্রয়োজনীয়তা একেবারেই কমে এসেছে। এখন আর আমাদের কোনো কিছু টুকে রাখা বা কোনো কিছুতে বার বার ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দুটি ক্লিক করতে পারলেই হয়ে গেল, জ্ঞান অর্জন কমপ্লিট।

গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ইন্টারনেট আমাদের জন্য এক প্রকার বর্ধিত স্মৃতিশক্তির মতো কাজ করে। যখন মানুষ জেনে যায়, সে চাইলেই পরে কোনো এক সময় কোনো একটি তথ্য খুঁজে পাবে তখন তার আর ওই তথ্যটি মনে রাখার কোনো প্রয়োজন থাকে না। সাধারণত মানুষ যতটুকু নিতে পারবে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ তথ্য দিয়ে তাদের মস্তিষ্ক বোঝাই করে রাখে। এক্ষেত্রে দুই ধরনের মানুষ পাওয়া যায়। প্রথমত. যারা ধীরে-সুস্থে সময় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। দ্বিতীয়ত. যারা অতি স্বল্প সময়ে অনেক তথ্য জোগাড় করার পক্ষপাতী। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, দ্বিতীয় ধরনের মানুষ আসলে কিছুই মনে রাখতে পারে না। একটা সময় পর জোগাড় করা তথ্যের প্রায় কিছুই তার আর মনে থাকে না এবং জীবনে এগুলো কোনো কাজেই আসে না। এর পাশাপাশি এই দ্বিতীয় ধরনের মানুষ যখন কোনো কিছু পড়ে বা দেখে তখন খুব বেশি উপভোগও করতে পারে না। কারণ তাদের পড়া বা দেখার মূল উদ্দেশ্যই থাকে ‘আমি অমুক সিনেমা দেখে ফেলেছি’ বা ‘আমি অমুক বই পড়ে ফেলেছি’ বলতে পারার সক্ষমতা অর্জন করা।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বই কিংবা সিনেমা এমন কোনো ফাইল বা ফোল্ডার নয় যা আমরা আমাদের মস্তিষ্কে আপলোড করছি। আমাদের বুঝতে হবে, আমরা যা পড়ি বা দেখি তা অন্য অনেক কিছুর মতোই নিজেদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দ্রুতগতিতে জ্ঞান অর্জন ট্রেন্ডের ফলে আসলে আমাদের মধ্যে যে ভুলে যাওয়ার বা মনে না রাখার প্রবণতা জন্ম নিয়েছে তা অনাগত সময়ের জন্য খুবই ক্ষতিকর হতে যাচ্ছে। এ ধারাটি বন্ধ করার জন্য আমাদের এখন থেকেই সচেতন হতে হবে। কোনো কিছু পড়ার সময় ধীরে-সুস্থে পড়তে হবে। গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো চিহ্নিত করতে হবে টেক্সট লাইনার বা অন্য যে কোনো ধরনের মার্কার পেন দিয়ে। বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ডায়রি কিংবা নোট বইয়ে টুকে রাখতে হবে। আরো ভালো হয় প্রতিটি বই পড়া শেষে সম্পূর্ণ বইয়ের ওপর যদি আমরা একটা রিভিউ লিখে ফেলতে পারি। এতে পুরো বইয়ের বিষয়বস্তু বা সারকথা অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের স্মৃতিতে জাগ্রত থাকবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সবশেষে স্মৃতিই আসলে সবকিছু। তাই এখন সময় এসেছে মনে রাখতে শুরু ও ভুলে যাওয়ার পথ বন্ধ করার।

২ thoughts on “কেন সব ভুলে যাই

কমেন্ট বন্ধ।