গ্রামবাংলায় কৃষির একটি আবর্তন চক্র এমনভাবে অনুসৃত হয়ে এসেছে যা দেশের গ্রামীণ সমাজ স্বনির্ভরতার এক অনন্য অবস্থায় অবস্থান করছে। গ্রামে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ফল-ফলাদির গাছ ও নানান ফসলের ক্ষেত-খামার যে অবস্থায় ছিল তা একটি অন্যটির উৎপাদনে সহায়ক হিসেবে কাজ করতাে। গ্রামে যে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি প্রতিপালিত হতাে তাদের মল-মূত্র জমির উর্বরতা বাড়াতে কাজ করতাে। আবার জমিতে উৎপন্ন ফসলের উপজাত খড় ও ক্ষেত নিড়ানোর সময় আগাছা হিসেবে যে ঘাস পাওয়া যেতাে সেই ঘাস গরু-মহিষের খাবারেজোগান দিয়েছে। ধান ভাঙানোর পর যে কুঁড়া পাওয়া যেতো তাও গরু-মহিষের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। খাবার তেলের জন্য যে সরিষা চাষ হয়েছে তা ভাঙানোর পর যে খৈল পাওয়া যেতাে তা গরু-মহিষের খাবার জোগানের পাশাপাশি জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হতাে। গ্রামের নদী-নালা, পুকুর, দীঘি ও বিল থেকে আহরিত শামুক-ঝিনুক কোনাে প্রক্রিয়াজাত না করে কেবল ভেঙে নিয়েই হাঁসের খাওয়ানো হয়েছে। গ্রামের কৃষকরা জমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য জমি পতিত রাখতেন এবং ফসলে বৈচিত্র্য পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। ফল-ফলারি গাছের পাতা গরু-ছাগলের খাওয়ানো হতাে। গ্রামের ভাগাড়ে জন্ম নেয়া ঘাস গরু-মহিষের সবুজ ঘাসেরেজোগান দিয়েছে। এ পদ্ধতিতে কৃষির যে আবর্তন চক্র ছিল তা প্রকৃতপক্ষে স্বনির্ভরতার এক অনন্যতায় অবস্থান করছিল।
অতঃপর দানা জাতীয় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষিতে আধুনিকায়নের নামে একক ফসল ধান আবাদের অপকৃষি বিজ্ঞান এমনভাবে অনুসৃত হয়েছে যাতে গ্রামীণ স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। ফলে দেশের নগরায়ন বাড়লেও গ্রাম থেকে চাহিদামতাে খাদ্য সামগ্রী না পাওয়ায় অবাধ আমদানিতে বিদেশিদের কোষাগার স্ফীত করার এক অভিনব ফাঁদে আটকে গেছে বাংলাদেশ। বৃটিশ আমলে প্রত্যক্ষভাবে এ দেশ খেকে যে পরিমাণ ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করতে পেরেছে, বর্তমানে পরোক্ষভাবে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ধন-সম্পদ বিদেশিরা নিতে পারছে। আগে এ দেশের জমিদার শ্রেণি বিদেশিদের কোষাগারের স্ফীতিতে কাজ করেছেন। কিন্তু বৃটিশরা চলে যাওয়ার পরে এ দেশে গঠিত বিশেষজ্ঞ শ্রেণি বিদেশিদের কোষাগারে রত্নরাজি জোগানোর যাবতীয় আয়োজনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
ড. বোরগল কৃষি বিজ্ঞানে একমাত্র নোবেল বিজয়ী। তিনিই সবুজ বিপ্লবের প্রবক্তা। তার মতে, স্বল্প পরিমাণ জমিতে আধুনিক কৃষি বিজ্ঞান প্রয়োগ করা গেলে কৃষি পণ্যের যে উৎপাদন পাওয়া যায় এতে বেশি জমি চাষ করার প্রয়োজন পড়ে না। তার তত্ত্ব পরিপূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ইউরোপিয়ান অর্থনৈতিক গোষ্ঠীভুক্ত দেশে অনুসৃত হচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধির নামে বাংলাদেশে কৃষি বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে বিভিন্ন বিভাগ ও উপবিভাগ গঠিত হলে ওই বিভাগ-উপবিভাগ গ্রামাঞ্চলে সুসমন্বিতভাবে কৃষি বিজ্ঞান সম্প্রসারণে উদ্যোগী হয়নি। এসব বিভাগ এমনভাবে কাজ করে যাতে কৃষক প্রাণপণ দৌড়েও লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারেন। তাঁতের চাকায় যত ভালাে সুতাই দিন না কেন, পোড়েনে সুতা না থাকলে দক্ষ তাঁতির বে শ্রম যেমন পণ্ড হয় ঠিক তেমনিভাবে কৃষি বিজ্ঞান গ্রামে অনুসৃত হচ্ছে। ফসলের জন্য সুষম সার প্রয়োগের জন্য মাটির রাসায়নিক পরীক্ষা করে সার ব্যবহারের যে বিজ্ঞান তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। ফসলের জন্য ১৪টি উপাদান প্রয়োজন হলেও কৃষি বিভাগ মাত্র তিনটি রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফর্দটি কৃষকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফষল চাষে উদ্বুদ্ধ করে বাংলার মাটিকে অনুর্বর মাটিতে পরিণত করেছে।
কৃষি বিভাগ কীটনাশকের পাগলা ঘোড়া যেভাবে ছুটিয়ে দিয়েছে এতে দেশের কোনাে ফসলই আর বিষমুক্ত ও স্বাস্থ্য সম্মত থাকতে পারছে না
সম্প্রতি মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের জরিপ রিপোর্টে বাংলার মাটির করুণদশা ও বছরওয়ারী ফসলের উৎপাদন ঘাটতির যে হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে এতে দেশের স্বনির্ভরতা অর্জন কখনোই সফল হবে না বলে প্রতীয়মান হয়। কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সুসমন্বিতভাবে কৃষি বিজ্ঞান মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণে বাধ্য করানোয় যদি রাজনৈতিক মহলের অপারগতা থাকে তাহলে এ দেশের মানুষকে স্বনির্ভরতার স্বপ্ন দেখানোর প্রতারণা ভাষণ বন্ধ হওয়াই শ্রেয়। কৃষি বিভাগ কীটনাশকের পাগলা ঘোড়া যেভাবে ছুটিয়ে দিয়েছে এতে দেশের কোনাে ফসলই আর বিষমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত থাকতে পারছে না। আমরা জানি, জাপানে বাঁধাকপি ও অন্য শাকসবজি কাঁচা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। রান্না করার চেয়ে কাঁচা অবস্থায় শাকসবজিতে বেশি পুষ্টিগুণ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে রান্না করা খাবার খেয়েই যখন মানুষ হরহামেশা হাসপাতালে দৌড়াচ্ছে তখন কাঁচা অবস্থায় শাকসবজি খাওয়ার পরামর্শ দেয়ার চেয়ে সরাসরি কীটনাশক সেবনের পরামর্শ দেয়াই ভালাে। কারণ কীটনাশক-দুষ্ট খাবার খেয়ে যে মৃত্যু হয় তা বেশ দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক। এছাড়া অার্থিক বিড়ম্বনাও সৃষ্টি করে থাকে। কিন্তু সরাসরি কীটনাশকের ক্যাপসুল খুব দ্রুত ও নির্ঝঞ্জাট মৃত্যুর দিকে বোকা কৃষকদের নিশ্চিতভাবেই ঠেলে দিতে পারবে।
বাংলাদেশে দুধ ও মাংসের চাহিদা মেটাতে গরু-গাভী পালনে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু কীটনাশকের পাগলা ঘোড়া থামানো না গেলে ওই আয়োজন অনর্থক হয়ে পড়বে। সম্প্রতি খুলনায় বাগমারা এলাকায় জনৈক ইদ্রিস আলী দোলখোলা বাজার থেকে কাঁধাকপির পাতা কিনে তার গাভীগুলোকে খেতে দেন। বাঁধাকপির পাতা গরু-গাভীর জন্য পুষ্টিকর। তবে বেশি পরিমাণে বাঁধাকপির পাতা গরু-গাভীকে খাওয়ানো হলে তাদের পেটে গোলযোগ দেখা দিতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে তা হয় না। কিন্তু ইদ্রিস আলীর গাভীগুলোকে বাঁধাকপির পাতা খেতে দেয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটি গাভী মারা যায় ও তিনটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। অসুস্থ গাভী তিনটি পশু হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার গাভীর মৃত্যু ও অসুস্থতার জন্য কীটনাশকযুক্ত বাঁধাকপিকেই দায়ী করা হয়।
বাঁধাকপির পোকা দমনে কৃষি বিভাগ মারাত্মক কিছু কীটনাশক ছিটানোর পরামর্শ দিয়ে থাকে। অন্যদিকে পশুপালন বিভাগ বাঁধাকপি গরু-গাভীর জন্য পুষ্টিকর খাবার বলে থাকে। বাঁধাকপি মানুষের জন্য যেমন গরু-গাভীর জন্যও তেমনি পুষ্টিকর খাদ্য। কিন্তু কীটনাশক দেয়া বাঁধাকপি মানুষের জন্য যেমন, গরু-গাভীর জন্যও তেমনি ক্ষতিকর খাদ্য। অথচ ক্রেতাসাধারণ বাজার থেকে যে বাঁধাকপি কিনে খেয়ে থাকে এগুলো রান্না করা হয় বলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু না হলেও কীটনাশকের ধীরলয়ের প্রক্রিয়ায় মানুষ যে রোগাক্রান্ত হবে- এতে সন্দেহ নেই। গরু-গাভীর কীটনাশক সহনক্ষমতা মানুষের চেয়ে বেশি হলেও কাঁচা অবস্থায় বাঁধাকপি খাওয়ানোয় ওই বিপত্তি ঘটে গেল। জাপানিজরা অধিক পুষ্টিপ্রাপ্তির জন্য কাঁচা বাঁধাকপি খেলেও বাংলাদেশের মানুষের কাঁচা বাঁধাকপি খাওয়ার উপায় নেই।
পাবনার জনৈক কৃষক মিলের চালের কুঁড়া এনে গরুকে খাওয়ানােয় একটি গরু মারা যায় এবং কয়েকটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। যে চালের কুঁড়া খাওয়ানোয় গরু মারা গেল এবং অসুস্থ হয়ে পড়লো তা গবেষণাগারে পরীক্ষা করালে নিশ্চিতভাবেই কীটনাশকের উপস্থিতি ধরা পড়তো। গরু-গাভী প্রচীন বাংলায় কেবল দুধ-মাংসের জোগানই দিত না এগুলোর গোবর উন্নতমানের জৈবসার হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। কিন্তু আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার কারণে গরু-গাভীর খাদ্যের সংকুলান না হওয়ায় তা পালন সংকটের মুখে পড়েছে। ফলে গরু-গাভীর আভাবে যেমন ফসলের জমি অনুর্বর হচ্ছে তেমনি দুধ-মাংসের অভাবে মানুষও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ স্থায়িত্বশীল কৃষি উৎপাদন চক্রও বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে কীটনাশকের পাগলা ঘোড়ার অনর্থকতা রোধ করা না গেলে গৃহীত পশু সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পসহ কৃষিতে স্বনির্ভরতা অর্জনের বি প্রচেষ্টা সমূহভাবেই ব্যর্থ হবে।