বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিরাট উদ্বেগ প্রকাশ করেন জগদ্বিখ্যাত ই-কমার্স সাইট আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক প্রভাবশালী ধনকুবের জ্যাক মা। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে জ্ঞান ও তথ্যভিত্তিক হওয়ার ফলে তিনি মনে করেন, এই ব্যবস্থা আগামী ৩০ বছর পরই গভীর সংকটে পড়বে। কারণ তখন আমাদের প্রতিযোগী হবে রোবট। ফলে রোবটের উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিমার্জন-পরিবর্ধন করার কথা বলেন তিনি।
আলিবাবা প্রতিষ্ঠার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা জ্যাক মা সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের এক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘মিট দি লিডার’ শীর্ষক তরুণ উদ্যোক্তাদের মুখোমুখি এক অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে এসব কথা বলেন।
এসবের পরিবর্তে কী পড়ানো উচিত এই প্রশ্নে জ্যাক মা চিন্তা করার সক্ষমতা, নৈতিক শিক্ষা, টিম ওয়ার্ক, অন্যের প্রতি সহানুভূতি ইত্যাদির প্রতি জোর দেন। তিনি বলেন, প্রযুক্তি আমাদের বাহ্যিক দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছে। কিন্তু নিজেকে দেখা ও মূল্যায়ন করা কিংবা প্রয়োজনে সংশোধন করার অন্তর্দৃষ্টির বড্ড অভাব রয়ে গেছে। ফলে আমরা অন্যের ভুল দেখি। তাদের চিন্তার ভুল ধরি। অথচ নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চিন্তা আমাদের থাকে না। তিনি জানান, প্রতিদিন তিনবার নিজেকে ওই অন্তর্দৃষ্টির আয়নায় দেখেন। নিজেকে ঝালাই করে নিতে চেষ্টা করেন। তিনি সফলতার জন্য তরুণদের কমপক্ষে দশ বছর অপেক্ষা করতে বলেন।
কোনো কিছুতে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ আইকিউয়ের সঙ্গে জ্যাক মা ‘আইকিউ অফ লাভ’ চর্চা করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, কোনো কিছু সফলভাবে করতে সমর্থ হতে কেবল বুদ্ধিমত্তার আইকিউ লাগে। কিন্তু কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের সম্মান পেতে হলে ভালােবাসার আইকিউয়ের ভিন্ন কোনাে পন্থা নেই।
তার প্রতিষ্ঠানে নারীর সংখ্যা প্রায় ৪৯ শতাংশ। অথচ সারা বিশ্বের নারীদের অধিকার নিয়ে চলছে লড়াই, প্রতিবাদ। কিন্তু জ্যাক মা কেন এখানে বিপরীত- এর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নারীরা কোনাে কাজ করতে গিয়ে পেশিশক্তির সাহায্য কম নেন এবং, মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের সাহায্য বেশি নেন। ফলে আলিবাবা যেহেতু সেবাভিত্তিক সেহেতু কর্মক্ষেত্রে ক্ষেত্রে নারীদের কাছ থেকে কার্যকর ফল পাওয়া যায়।
আলিবাবার ক্রেতাদের মধ্যে জ্যাক মা খেয়াল করে দেখেছেন, বেশির ভাগ পুরুষ নিজের জন্য পণ্য বেশি কিনলেও বেশির ভাগ নারী তার স্বামী-সন্তানের জন্যই কেনাকাটা বেশি করেন। কারণ তাদের মধ্যে আছে প্রগাঢ় ভালােবাসা। ফলে তিনি ওই ভালােবাসাকে তার গ্রাহকদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চান বলেই নারীদের আলিবাবায় যুক্ত করেন সব সময়।
অবশ্য জ্যাক মা নিজেকে দুর্বল ছাত্র হিসেবে সবার কাছে পরিচয় দেন। তিনি গণিতে একবার শুধু ১ পেয়েছিলেন। খোদ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দশবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়েও ব্যর্থ হন। কিন্তু তিনি মনে করেন, ওই ভুলগুলো ছিল সফল হওয়ার পথে নিবিড় প্রশিক্ষণ এবং জীবনের ভুলগুলো সামনের পথে হাঁটার আসল আলোকবর্তিকা।
তরুণ উদ্যোক্তাদের মুখোমুখি প্রশ্নোত্তরের ওই অনুষ্ঠানে সফলতার জন্য তরুণদের কমপক্ষে ১০ বছর অপেক্ষা করতে বলেন জ্যাক মা।
জ্যাক মা বলেন, আসলে মানুষের সফলতার গল্প থেকে আমাদের শেখার কিছু নেই। আমাদের শিখতে হবে সফল মানুষের ভুল থেকে। এই ভুল থেকে শিখে আমরা হয়তাে ভুল করা থেকে রেহাই পাবাে ন। কিন্তু ভুল থেকে কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয় তা আমরা খুব ভালোভাবে শিখতে পারবাে। আমিও একটি বই লেখার পরিকল্পনা করছি। বইটির নাম হবে ‘আলিবাবার এক হাজার একটি ভুল’।
জ্যাক মা মনে করেন, তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করে। তবে আমাদের সবাইকে একে অন্যের প্রতি যুদ্ধ ঘোষণা না করে জনমানুষের জীবনঘাতী রোগ, দারিদ্র্য ও পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিত।
জ্যাক মার জীবন যাপন নিয়ে নানান ধোঁয়াশা আছে বলে একজনের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, একবার হার্ভার্ডের এক কেস স্টাডিতে তার সাফল্যগাথা নিয়ে লেখা হয়। তা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পড়ানো হয়। কিন্তু ওই কেস স্টাডির সঙ্গে তার প্রকৃত জীবনের মিলই তিনি পাননি।
টাইম ম্যাগাজিনের প্রভাবশালী তালিকাভুক্ত জ্যাক মা তরুণদের উদ্দেশ্যে আদেশের সুরে বলেন, ২০ থেকে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকে অভিজ্ঞ ব্যক্তির অধীন বা বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের অধীন কাজ করতে হবে। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সে এসে নিজে নতুন কাজে হাত দিতে হবে। নতুন নতুন পরীক্ষামূলক কাজ শুরু করতে হবে। এরপরের দশ বছর কেবল যে কাজটি আপনি সবচেয়ে ভালাে পারেন সেটিতে পুরো সময় কাজে লাগাতে হবে। ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সে এসে নিজের এতদিনের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও ভুল-ত্রুটি তরুণদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। সর্বেশেষে ৬০ বছরের বেশি বয়সী সবাইকে নিজের নাতি-নাতনিকে সময় দিতে বলেন তিনি।
জ্যাক মা বলেন, প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে আলিবাবার অগ্রাধিকারমন্ত্রে সর্বপ্রথম গ্রাহক, এরপর প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা এবং সবার শেষে মালিকপক্ষ। চীনের ই-কমার্স ব্যবসার পথিকৃৎ আলিবাবায় নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে সব সময় নিজের চেয়ে স্মার্টদের নিয়োগ দিতে চান বলে জানান ওই চীনা বিলিয়নিয়র। এক্ষেত্রে তার কাজ শুধু এই স্মার্ট ব্যক্তিদের পরিচালনার দায়িত্ব নেয়া।
এক পর্যায়ে বিশ্বায়নের প্রভাব নিয়ে জ্যাক মা-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমরা চাইলেও বিশ্বায়ন রুখে দিতে পারবাে না। তাই আমাদের উচিত বিশ্বায়নের সঙ্গে নিজেকে চালু রাখা। আমরা সারা বিশ্বে এর মাধ্যমে যুক্ত হয়ে আছি। কিছুদিন পর চাইলে আপনি কেনিয়া থেকেও কিছু অর্ডার করতে পারেন, করতে পারবেন নরওয়ে থেকেও। ফলে এক ধরনের বৈশ্বিক ব্যবসার নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হবে। আর সারা বিশ্বে ব্যবসা যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে শুরু হবে যুদ্ধ।
সারা বিশ্বে বিরাজমান লড়াই-বিদ্বেষকে রাষ্ট্রনেতাদের বেখেয়ালিতা বলে মনে করেন ওই চিন্তাশীল ব্যক্তি। তিনি বলেন, ২০০ রাষ্ট্রের প্রধানকে এক কামরায় বসিয়ে কোনাে ঐক্যে পৌঁছানো না গেলেও আমি বিশ্বাস করি, ব্যবসায়ীরা দ্রুত যে কোনাে বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেন।