রাজপুতদের উচ্চপ্রশংসা, জওহরকে মহিমান্বিত করা, খিলজীর দানবীকরণ বাদ দিলেও, ‘পদ্মাবত’ অতিদীর্ঘ একঘেয়েমির উৎসবের বাইরে কিছু হয়ে উঠতে পারে নাই।
সঞ্জয় লীলা বানসালির সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটা ছবিতে পুরুষ শরীরের স্থূল উদযাপন স্পষ্ট। যেমন ‘সাভারিয়া’তে তোয়ালে জড়ানো রণবীর কাপুর বা রণবীর সিং-এর ‘গালিও কি রাসলীলা রামলীলা’য় তেল চকচকে শরীর কিংবা ‘বাজিরাও মাস্তানি’তে গোসলের সময়ের ঢেউ তোলানো পেশি। ‘পদ্মাবত’-এ দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর সাথে ক্রীতদাস মালিক কাফুরের (জিম সার্ভ) গোসলখানায় একটি দৃশ্য আমাকে কিছুটা হলেও নাড়া দিয়েছে। বানসালি তাদের শরীরি ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে একধরনের হোমো-ইরোটিক টাচ দিয়েছেন। দুঃখজনক ব্যাপার, এমনকি বলিউডের অদ্ভুত আইডেনটিটি পলিটিক্সের সীমা ডিঙানোর চেষ্টা সত্ত্বেও, বানসালি শেষ পর্যন্ত সেটিকে শুধু খিলজীর জান্তব দিক, সম্পর্কের অবসান আর ভোগোন্মত্ততার মতো সমস্যাগুলি চিহ্নিত করতেই ব্যবহার করলেন।
সচেতনভাবে এক্সট্রিম নিয়ে কাজ করে একটা ফিল্মের কাছে গভীরতা আশা করাও বেশিই চাওয়া যেখানে মন্দ, ভ্রষ্ট বা বহিরাগত খিলজীদের (মুসলমান) চরম দানবীকরণ আর ভালো, স্বাভাবিক দেশবাসী রাজপুতদের (হিন্দু) নতজানু তোষামোদ করা হয়েছে। এমনকি সামান্যতম দূর্বলতাও গৌরবোজ্জ্বল আবরণে ঢেকে, সোনালি অতীতের প্রশংসাসূচক কেচ্ছা একের পর এক পুরো ছবিজুড়ে শোনানো সত্ত্বেও কোন ধরণের যুক্তিতে তা রাজপুতদের আঁতে ঘা লাগাতে পারে?
যত্ন নিয়ে চিত্রিত জওহর চরিত্রটাই ধরা যাক। পদ্মাবতীকে বানসালি একজন যোদ্ধা রাণী ও রাজনৈতিক হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। কেতন মেহতার ‘মিরচ মাসালা’ থেকে ভিন্ন (মরিচের বদলে জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে) ও প্রতিবাদী হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও তা শেষপর্যন্ত মহিমান্বিত করার ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে তেমন ভারসাম্য আনে নাই, এই ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলনের সময়ে তা কিছুই হয় নাই। একদমই না কারণ পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জোর দিয়ে গেছে। পদ্মাবতীকে তার স্বামীর অনুমতি নিতে হয়েছে, এমনকি তার মৃত্যুও স্বামীর হাতে, নিজের হাতে না।
এইসব মতাদর্শিক, রাজনৈতিক, নারীবাদী প্যাঁচাল বাদ দেওয়া যাক। সিনেমাটি নিয়ে আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা সিনেমাটি এককথায় ঘুমপাড়ানি গান। ‘পদ্মাবাত’-এর জন্যে উপযুক্ত ডিসক্লেইমার হতে পারে, ‘কোনো প্রকার একঘেয়েমি সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয়। কারণ, আমার ভেতরের সমালোচক সত্ত্বা ‘পদ্মাবতকে একটি নিখুঁত ও নিরবচ্ছিন্ন শিশুতোষ একঘেয়েমির আয়োজন হিসাবে বলতে চাইছে।
অপরিমিত চাকচিক্য, ভিজুয়ালের বাড়াবাড়ি, তীব্র আবেগ বৈশিষ্ট্যের বানসালি ঘরানার সিনেমা নিয়ে আমার হয়তো আপত্তি আছে, তবু ঠিক ঠিক সিকোয়েন্স ব্যবহার করে যথাযথ নাটকীয়তা সৃষ্টি করার ক্ষমতা তার যথেষ্ট রয়েছে। তাল ও সংগীতবোধ তার ভালো বলে আর নাচ-গানের দারুণ কিছু স্পন্দিত ঐক্য সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন।
‘পদ্মাবত’-এ, তা সত্ত্বেও, তিনি সঠিক নোট যেমন ব্যবহার করতে পারেন নাই, সাউন্ডট্রাকে মনে রেশ থেকে যাওয়ার মতো কোনো সিকুয়েন্সও সৃষ্টি করতে পারেন নাই। কোনো চরিত্র স্পর্শ করে না, কোনো মুহূর্ত নাড়া দেয় না। ‘গুজারিশ’ আর ‘সাভারিয়া’র কাল থেকে ‘পদ্মাবত’ই বানসালির সম্ভবত সবচেয়ে নিষ্ফল যাত্রা। এটা শুধুই ক্লান্তি আর হতাশাই দিতে পেরেছে।
কস্টিউম, রঙচঙ, অলঙ্কারের আড়ম্বর অভিনেতাদেরকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। আশ্চর্য হয়েছি, থ্রিডি আইম্যাক্সের (প্রচন্ড বিস্ফোরণধর্মী দৃশ্যয়নে ব্যবহৃত ত্রিমাত্রিক ডিজিটাল প্রযুক্তি) জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর কৃত্রিমতায়। এইসব ব্যাপকতা মোটেই সম্ভ্রমোদ্দীপক মনে হয় নাই, স্পেশাল-ইফেক্ট, কিছু যুদ্ধদৃশ্যে তো একদম আনাড়ি লেগেছে; বিশেষত লং শটে অভিনেতাদের কাঠের পুতুল মনে হয়েছে। এক্সট্রিম ক্লোজ-আপেই শুধু মানুষের মুখের মতো লাগে। তখনই কেবল দীপিকা পাড়ুকোনকে (অদিতি রাও হায়দারিকেও) উজ্জ্বল ও রাজকীয় লাগে, যা দীপিকাকে এমনিতে সবসময়ই লাগে।
হরিণ তাড়া করার দৃশ্যে ‘ক্রাউচিং টাইগার, হিডেন ড্রাগন’ (তাইওয়ানের ডিরেক্টর এ্যাং লি পরিচালিত মার্শাল আর্টসের সিনেমা) এর প্রভাব স্পষ্ট। তাছাড়া ‘গালিও কি রাসলীলা রামলীলা আর ‘বাজিরাও মাস্তানি’তে রণবীর সিং-এর সাথে দীপিকার যেমন রসায়ন, শহীদ কাপুরের সাথে তা জমে নি। অন্যদিকে, রণবীর সিং এখানে খিলজী বলা গেলেও, চরিত্রায়নে সেই ‘গোলিয়ন…’-এর চরিত্রের লাগামছাড়া যৌনোদ্দীপক অভিব্যক্তির, আগ্রাসী পুরুষই বটে। ‘টাট্টাড টাট্টাড’ ধরণের নাচের সময়ও অতি জিম করা পেশিবহুল শরীর রয়ে গেছে। পছন্দনীয় এই অভিনেতা ‘বর্ণাঢ্য, খামখেয়ালি’র ফাদে পড়ার বিপদজনক ঝুঁকিতে আছে। আশা করি কেউ তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
দ্য হিন্দু থেকে অনূদিত।
নম্রতা জোশি, চলচ্চিত্র সমালোচক ও দ্য হিন্দু মুম্বাই এর সিনেমা বিষয়ক সম্পাদক। ২০০৪ সালে তিনি ভারতের সেরা চলচ্চিত্র সমালোচকের জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি টরন্টো, ক্লুজ, মস্কো এবং থিরুভানানথাপুরম আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সমালোচক জুরি সদস্য।
পদ্মাবত
পরিচালক: সঞ্জয় লীলা বানসালি
অভিনয়ে: দীপিকা পাডুকোন, রনভির সিং, শহীদ কাপুর, আদিতি রাও, জিম সরভ।
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ৪৪ মিনিট।