- অভিষেকেই হ্যাটট্রিক মাধুশাঙ্কার
- চতুর্থবারের মতো ত্রিদেশীয় সিরিজ হারলো বাংলাদেশ
- ম্যান অফ দ্য ম্যাচ: উপল থারাঙ্গা
- ম্যান অফ দ্য সিরিজ: থিসারা পেরেরা
দ্রততম বাংলাদেশি হিসাবে ওয়ান ডে তে পঞ্চাশ উইকেটের ল্যান্ডমার্ক ছুলেন মোস্তাফিজ। পেছনে ফেললেন আব্দুর রাজ্জাককে।
গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে লঙ্কান বলারদের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে মাত্র ৮২ তেই অল-আউট হয়ে গিয়েছিলো বাংলাদেশ। সে বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে তিনটি পরিবর্তন এনে একাদশ সাজিয়েছিলেন বাংলাদেশ। পুরো সিরিজেই ব্যার্থ এনামুলের জায়গায় মিঠুন, নাসিরের জায়গায় মিরাজ এবং আবুলের জায়গায় একাদশে স্থান করে নিয়েছেন সাইফুদ্দিন। বোলিং শেষে শেষ দুটি পরিবর্তন যে বেশ কাজে এসেছিলো বলা যায়। কিন্তু বলারদের সাফল্যের রেশ ধরে রাখতে চরমভাবে ব্যার্থ ব্যাটসম্যানরা মাত্র ১৪২ রানেই গুটিয়ে গিয়ে শ্রীলঙ্কাকে উপহার দিয়েছেন ৭৯ রানের জয়, সাথে রকেট ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপাও। বাড়তি হিসাবে ছিলো অভিষিক্ত মাদুশঙ্কার হ্যাটট্রিক।
প্রথম পাওয়ার প্লে এবং আগ্রাসী লঙ্কা
সিরিজে প্রথমবারের মতো মাঠে নামা মিরাজের হাতে বল দিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশ দলপতি মাশরাফি। কিন্তু তার সে চমককে চাকচিক্যহীন করার ব্রত নিয়েই যেন মাঠে নেমেছিলেন লঙ্কান ওপেনাররা। শুরু থেকেই মিরাজের ওপর চওড়া হয়ে ব্যাটিং শুরু করেছিলেন লঙ্কান ওপেনাররা। বরাতে জোটে তিনটি বিশাল ছক্কার মার। এর মাঝে শুধু একবারই আনন্দের উপলক্ষ পেয়েছন তিনি, গুনাথিলাকাকে তামিমের তালুবন্দি করে। এটুকু বাদ দিলে লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের বাকি সবার প্রিয় লক্ষ্য বস্তু ছিলেন তিনি। সর্বোচ্চ আটটি বাউন্ডারি জুটেছে তার বরাতে। নয় বলে ২৮ রান করা কুশল মেন্ডিস যখন মিরপরুরে আরো একবার বাংলাদেশের স্বপ্ন ভঙ্গের সম্ভাবনার সলতে উসকে দিচ্ছেন তখনই আঘাত হানলেন অধিনায়ক মাশরাফি। মাহমুদুল্লাহ হাতে ক্যাচ দিয়ে থামে নয় বলে ২৮ রানের ছোট্ট এই ক্যামিওটি। প্রথম দশ ওভারে ছয়ের কাছাকাছি থাকা রান রেট সময়ের সাথে শুধু কমতেই থাকে।
অধিনায়ক মাশরাফি, অসাধারন বোলিং পরিবর্তন
৭ ওভার ৩ বলেই পঞ্চাশ তুলে ফেলা লঙ্কানদের রানের গতিতে লাগাম পরাতে মাশরাফি ব্যবহার করলেন সাতজন বোলার। বলতে নেই, তার সে সিদ্ধান্ত কাজে দিয়েছে চমৎকার ভাবে। ১১ থেকে ৪০ এ সময়টাতে লঙ্কানদের সংগ্রহ মাত্র ১০৭ রান। মাহমুদুল্লাহ, সাইফুদ্দিন, সাকিব এবং রুবেল; প্রত্যেকের ইকোনোমি ছিলো পাচের নীচে। মোস্তাফিজ তো ছিলেন অন্যান্য ১০ ওভার শেষ করেছেন মাত্র ২৯ রান দিয়ে, সাথে দুই উইকেট। ফিল্ডিংয়ের সময় আঘাত পেয়ে মাঠ না ছাড়লে সাকিব হয়তো দশ ওভারের কোটা পূর্ণ করতেন। কিন্তু সে আফসোস করার সামান্যতম সুযোগও দেননি বাকিরা।
ফিজ-রুবেলে অসহায় লঙ্কা
একপাশে যথারীতি মোস্তাফিজের কৃপন বোলিং অপর প্রান্ত থেকে রুবেলের আগ্রাসী পেসের কোনো জবাব যেন ছিলো লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের কাছে। গত ম্যাচে লঙ্কানদের দেখানো পথ ধরে শর্ট পিচ ডেলিভারিতেই তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলো বাংলাদেশের পেসাররা। বিশেষ করে তরুণ সাইফুদ্দিনের উইকেটটি ছিলো চমৎকার। এর মাঝে গলার কাটা হয়ে ছিলো লঙ্কান দলপতি চান্দিমাল। কিন্তু বড় ইনিংস গড়ার আশা জাগানো চান্দিমালকেও সে আশা পুরণ করতে দিলেন না রুবেল। রুবেলে এক অসাধারণ ডেলিভারিতে মাল আউট হয়ে যায়। ড্রেসিংরুমে ফেরার আগে করেছেন ৪৫ রান।
পার্টনারশিপের অভাব
থারাঙ্গা আর ডিকেওয়ালার ৭১ বাদ দিলে আর কোনো জুটিই পঞ্চাশও করতে পারেনি। বরং নিয়মিত আঘাত হেনে বাংলাদেশের বোলাররা তাদের থামিয়ে দিয়েছে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌছানোর আগেই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৫ এসেছে থারাঙ্গা-চান্দিমালের ব্যাট থেকে।
রিভিও রঙ্গ
রিভিউ ভাগ্য দু দলের জন্য দেখা দিয়েছিলো দু রকম ভাবে। বাংলাদেশের প্রথম রিভিওটা প্রত্যাখ্যাত হয় আম্পায়র্স কলের কারণে। নতুন নিয়মে সে রিভিও বহাল থাকায় মোস্তাফিজের বলে আবার রিভিও নেন মাশরাফি। এবার আর পার পাননি। উইকেট মিস করার কারণে বাতিল হয়ে যায় বাংলাদেশের। অপর দিকে দুবার আম্পায়ের আঙ্গুল উঠার পরেও রিভিও নিয়ে মাঠে থেকে যান দুই লঙ্কান ব্যাটসম্যান। এই জিনিসটি বোধয় ভালো লাগেনি মোস্তাফিজের। রিভিও নিয়ে বেচে যাওয়া থারাঙ্গার স্ট্যাপ উপরে দিয়েছেন পরের বলেই।
ব্যাটিং শুরুর বিপর্যয় অব্যাহত
ওপেনিংয়ে এনামুলের ক্রমাগত ব্যার্থতায় সুযোগ পেয়েছিলেন মিঠুন চৌধুরী। এক সিরিজে দুবারসহ গত কিছুদিনের মধ্যে চতুর্থবারের মত সঙ্গী বদল হতে দেখলেম তামিম। দলে ফেরা মিঠুনকে মাঠে রেখে টাইমিংয়ে গড়বড় করে এতো দিন তাকে একা ফেলে এনামুলের ড্রেসির রুমের পথ ধরার দৃষ্টান্তই যেন অনুসরন করলেন দেশ সেরা এই ওপেনার। সাকিবের অনুপস্থিতিতে মুশফিক বা মাহমুদুল্লাহকেই প্রত্যাশা করছিলো সবাই। সামনে ড্রেসিংরুমে হাথুরুসিংহকে দেখেই কি না কে জানে সাব্বিরকে তিনে নামানোর অদ্ভুত এক খেয়াল চাপল বাংলাদেশের ম্যানেজমেন্টের। তিনে নিজের অস্বস্তি প্রমাণ করে ফিরে গেলেন দৃষ্টিকটুভাবে। তার আগেই রান আউটের খড়গে কাটা পড়েছেন মিঠুন।
আশার আলো দেখানো মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ
শুরুতেই তিন উইকেট হারিয়ে আরো একটি ফাইনাল জয়ের আশা যখন জলাজ্ঞলি দিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ তখনই জুটি বাধলেন দুই ভায়রা; মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ। এক-দুই করে কখনো বা বাউন্ডারি ওভার বাউন্ডারির সাহায্যে সচল রেখেছিলেন রানের গতি। আর আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে ছিলো আপামর বাংলার দর্শকরা। মুশফিকের বিরুদ্ধে বোলারের জোরালো এলবির আবেদনে আম্পায়ার আঙ্গুল তুলে দিলে আধার নেমে আসে বাংলাদেশ দলে। কিন্তু দুজনের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে রিভিও কল করেন মুশফিক। থার্ড আম্পায়ের কল্যাণে সে যাত্রায় বেচে গেলেও ধৈর্য্য হারিয়ে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসেন মুশফিক। নীভে যায় বাংলাদেশের আশার প্রদীপ।
শিখলেন না কেউই
আগের দুই ম্যাচের ব্যাটিং ব্যার্থতা থেকে শিক্ষা নেয়ার নমূনা এ ম্যাচেও ছিলো অনুপস্থিত। সাব্বির তো পুরো সিরিজে মাঠে নেমেছেন এগারো জনের কোটা পূরণ করার স্বার্থেই। শুধু জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আরভিনের অসাধরণ ক্যাচটিকে দুর্ভাগ্য বলতে পারেন। কিন্তু বাকি ইনিংসগুলোতে তার আউট হবার ধরনে ছিলো চমর অপেশাদারিত্ব এবং ঔদাসিন্যের ছাপ। তিনে নেমে এমন আউট শুধু তার দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে না, প্রশ্ন তোলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা তার আছে কি না সেটি নিয়েও। আপনি এ ম্যাচের মাহমুদুল্লাহকেই দেখুন। ইনিংসের প্রায় পুরোটা সময়ই দলের প্রয়োজন মতো এক প্রান্ত আগলে রেখে খেলেছেন। দুটি ম্যাচ বাদ দিলে মুশফিক, সাকিব, তামিম সবাই ছিলেন কমবেশী রানের মধ্যে। কিন্তু, যাদের জায়গা অনিশ্চিত সেই এনামুল, নাসির, সাব্বিররা ব্যার্থ হয়েছেন চূড়ান্ত এবং দৃষ্টিকটুভাবে। মিঠুন মাত্রই একটি ইনিংস খেলায় তাকে হিসাবের মধ্যে আনছি না।
আবারো খলনায়ক পিচ
মিরপুরে আজকে যে পিচে খেলা হলো এমন পিচ নাকি চায়নি বাংলাদেশ দল। অন্তত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অধিনায়কের আকারে-ইঙ্গিতে বলা কথার মানে তাই দাড়ায়। তবে এটি বাংলাদেশ। যেখানে যে খেলে সে খেলোয়াড়দের পছন্দের চেয়ে কর্তার প্রিয় মুখ গামিনির প্রেস্কিপশনেই তৈরি হয় উইকেট। নিজভূমে অচেনা এই উইকেটে অসহায় আত্মসপর্নের দায় শুধুই খেলোয়াড়দের ওপর চাপানোও বোধ করি ঠিক হবে না। হ্যা, সকল কন্ডিশনের সাথে মানিয়ে নেয়া সময়ের দাবি, সত্য। তাই বলে নিজের উঠোন চিনতেই অর্ধেক সময় চলে যাবে?
আবারো ফাইনালের হতাশা
এই মিরপুরেই এটি নিয়ে তিনটি ফাইনাল হারলো বাংলাদেশ। প্রথমটিতে এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দু উইকেটে, দ্বিতীয়টিতে পাকিস্তানের বিবক্ষে দুই রানে আর এবার ৭৯ রানের হতাশায় পুড়লো বাংলাদেশ। আগের দুবার ভাগ্যকে দোষ দেয়া গেলেও এবার ভাগ্য যে বাংলাদেশের ধারে কাছে দিয়েও যায়নি, ব্যবধানটিই তার প্রমাণ।
প্রাপ্তি – অপ্রাপ্তি
প্রাপ্তির তালিকায় প্রথমেই আসবে তামিমের নাম। শেষ দু ম্যাচ বাদ দিলে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই খেলতে দেখা গিয়েছে তাকে। একই কথা প্রযোজ্য সাকিব, মুশফিক এবং রিয়াদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু আশ্চর্য রকমের ব্যার্থ ছিলেন এনামুল, সাব্বির এবং নাসিররা।
বোলিংয়ে সমালোচনা করার তেমন একটা সুযোগ নেই। মাশরাফি থেকে সাইফুদ্দিন, প্রত্যেকেই ছিলেন দারুণ। মাঝে ফুলের কাটা হিসাবে ধরে নিতে পারেন সর্বোচ্চ সংখ্যক ম্যাচ খেলেও উইকেট শূণ্য থাকার রেকর্ডের দিকে আবুলের আরেক পা এগিয়ে যাওয়া।