কোরান নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার গলদ

কোরান নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার গলদ

এখন চলছে একবিংশ শতাব্দী। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগ। বিজ্ঞানের প্রভাব তাই প্রতিটি মানুষের মানসিকতায় গভীরভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এখন আমরা সব কিছুতেই বিজ্ঞানের ছাপ খুঁজে বেড়াই। এর অনেক ভালো দিক থাকতেই পারে। কিন্তু এর একটি বিরূপ  প্রতিক্রিয়া আমাদের ধর্মপ্রাণ তরুণ ও যুবকদের মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাহলো কোরানকে বিজ্ঞানের আলোকে অভ্রান্ত প্রমাণের এক জোর প্রচেষ্টা।

সৃষ্টিতত্ত্বে কুরআনের যে কোন আয়াতকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করে তারা এক গভীর প্রশান্তি ও আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। এক্ষেত্র তারা যদিও বলে থাকেন, কোরানই আমাদের মৌলিক বিশ্বাস ও সবার উপর এটাকেই প্রাধান্য দেই। কিন্তু অবচেতনে কোন একভাবে এখানে যে বিজ্ঞানকেই প্রাধান্য দেয়া হয়ে যাচ্ছে, তা তারা অনুভব করেও করতে পারছেন না। এখন প্রশ্ন হতে পারে কোরান কি অবৈজ্ঞানিক?

উত্তরে যদি বলি- না, বৈজ্ঞানিক। তাহলে আরেকটি প্রশ্ন আসে- কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈজ্ঞানিক? মানুষের আনুমানিক ও গাণিতিক সমীকরণে অস্থিতিশীল থিওরির যে বিজ্ঞান, সে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে? এই দৃষ্টিকোণ থেকে কোরানকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগাটা কি যৌক্তিক? আমার এ কথায় ভুল বুঝবেন না। আমি কোরানকে অবৈজ্ঞানিক প্রমাণের চেষ্টা করছি তা নয়। আমি আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের কথা বলতে চাচ্ছি; যে মানসিকতায় কোরানের কোন বাণীকে বিজ্ঞানের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে একটা অস্বস্তি ও খচখচানি থেকে যায়।

একটি কথা স্মরণ রাখা জরুরি, মানুষের চিন্তা ও চর্চা প্রসূত বিজ্ঞান অস্থিতিশীল। সম্ভাবনা নির্ভরও বটে। আর কোরান স্থিতিশীল, চূড়ান্ত এবং নিশ্চিত। এটা যুক্তি চর্চার সীমাবদ্ধ জগতের বাইরের একটি উৎস থেকে আগত। বিজ্ঞানের ভুল হতে পারে এবং হয়ও। কিন্তু কোরানের কোনও ভুল নেই। বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে কোরানকে ভুল প্রমাণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা অনেকেই করেছে, তাতে অস্থিরমনা কিছু লোককেই কেবল বিভ্রান্ত করতে পেরেছে। তাই এক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাপার মাথায় রাখা অতীব প্রয়োজন:

১. কোরানের ভাষা ও বর্ণনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও আলঙ্কারিক। ফলে কোরানে সাধারণত কোন কিছুর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয় না বরং ছোট্ট একটি কথায় কোন কিছুর ব্যাপক অর্থ ও মৌলিকতা বিবৃত করা হয়। ঠিক তখনই আমরা মৌলিক অর্থ বা আসল ব্যাপারটি বুঝতে না পেরে উৎকণ্ঠায় ভুগি। উদাহরণস্বরূপ আমাদের সৌরজগত কেন্দ্রিক গ্রহাদির বিচরণের কথাই ধরা যাক। এটা নিয়ে আমাদেরই বিজ্ঞান এদিক সেদিক ধাক্কা খেয়ে সর্বশেষ যে সিদ্ধান্তে স্থির হয়েছে, তা হলো- প্রতিটি গ্রহই নিজ কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। টলেমির যুগে এবং পরবর্তী সময়ে কখনো বলা হয়েছে পৃথিবী স্থির; সূর্য ঘোরে। আবার কখনো বলা হয়েছে সূর্য স্থির, ঘুরছে আসলে পৃথিবী। অথচ পবিত্র কোরানে শুধু ছোট্ট একটি কথা বলা হয়েছে। বলা যায়, এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান! সূরা আম্বিয়ার ৩৩নং আয়াতে আল্লাহ বলেন: كل في فلك يسبحون “(চন্দ্র ও সূর্য) প্রতিটি গ্রহই নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণশীল।” এখানে মৌলিক একটি কথা বলা হয়েছে,খুবই সংক্ষেপে।অথচ কোরানের এই বাণীরই ভুল অর্থা করে ও মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে অনেকে ‘মুক্তমনা’ কোরানকে ভ্রান্ত প্রমাণের কতো কসরতই না করেছেন।

২. আমাদের বিজ্ঞান যে কোন বিষয়ে প্রথমে অনিশ্চিত থাকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সূত্র ও প্রমাণাদির মাধ্যমে তা নিশ্চিত ও প্রমাণিত হলে বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেয়। এর আগ পর্যন্ত তা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃতিবিহীন থাকে। অন্যদিকে কোরান হলো নিশ্চিত সত্যের বর্ণনা। প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগের কথা মনে পড়ছে আমার। একদিন নামাজে সূরা মাআরেজ তেলাওয়াত করতে গিয়ে চমকে উঠলাম। সূরাটির ৩ নং আয়াতটি হলো, “আল্লাহ সমুন্নত মর্যাদার অধিকারী, ফেরেশতাগণ ও জিবরাঈল তার নিকট উর্ধ্ব ভ্রমণ করেন এমন একদিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশহাজার বছর।” আয়াতে সমুন্নত মর্যাদার জন্য যে শব্দটি আনা হয়েছে তা হলো: ذوا المعارج আর মাআরিজ শব্দটি ‘উরুজ’ থেকে, যার প্রসিদ্ধ অর্থ হলো- ‘উর্ধ্বগমণ’। আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী এর আরেকটি অর্থ হয়: উর্ধ্ব গমনের সিঁড়ি বা লিফট। আর আয়াতের পরবর্তী বক্তব্য অনুযায়ী এটা একটি সংক্ষিপ্ত পথ ও বুঝায়। যদি এভাবে অর্থ করা হয়, তাহলে বর্তমান বিজ্ঞানের প্রসিদ্ধ দুটি থিওরির মাঝে উক্ত আয়াতের ছাপ অনুধাবিত হয়।

ক) সময়ের আপেক্ষিকতা (theory of relativity)   খ) ওয়ার্মহোল বা আইনস্টাইন রোজেন সেতু তত্ত্ব।

এ তত্ত্ব দুটিই আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের অন্তর্গত। একটি (সময়ের আপেক্ষিকতা)আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে স্বীকৃত ও প্রমাণিত বা নিশ্চিত। কিন্তু ওয়ার্মহোল (তত্ত্বীয়ভাবে পাওয়া এমন একটি সংক্ষিপ্ত গমন পথ, যা স্থান ও কালের ভেতর দিয়ে মহাবিশ্বে এক স্থান থেকে দীর্ঘ দূরত্বের অন্য স্থানে ভ্রমণের অনুমোদন করে) এর থিওরিটি অপ্রমাণিত হওয়ায় এটা কেবল একটি তত্ত্বীয় প্রকল্প ও সম্ভাব্য। কিন্তু আমাদের মুসলিমদের কাছে এই তত্ত্বের নিশ্চয়তা আছে, তা সেটা যে কোন প্রক্রিয়ায় হোক না কেন। কারণ আল্লাহ নিজে ওই আয়াতে বলছেন, আল্লাহর কাছে যেতে একটি শর্টকাট পথ বা টানেল আছে ফেরেশতাদের জন্য, যে পথে তারা সময়ের আপেক্ষিকতায় অতিদ্রুততম গতিতে মহাবৈশ্বিক আন্তঃভ্রমণ করেন। এখন থিওরিটি হুবহু ও সামগ্রিকভাবে না মিললেও মূল ব্যাপারটা আমাদের কাছে নিশ্চিত। কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে অনিশ্চিত। বিজ্ঞান অনেক ব্যাপারেই অনিশ্চিত, এটা বিজ্ঞানের অপর্যাপ্ততা ও অক্ষমতা। আল্লাহ যদি সক্ষমতা দেন তবে বিজ্ঞানীরাও হয়ত একদিন নিশ্চিত হতে পারবে সেসব বিষয়ে। এরপরেও সেটা কোরানে থাকা বা কোরানের সাথে মিলে যাওয়া অপরিহার্য নয়। কারণ কোরান ও বিজ্ঞান আলাদা ব্যাপার। এক নয়। আর আয়াতটির ব্যাখ্যাও এভাবে করা উচিত হবে না।

৩. মহান আল্লাহ পবিত্র কোরানে আমাদেরকে উপদেশ দেয়ার জন্য তার সমগ্র সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন বিষয়াদির উপমা ও উদাহরণ দিয়েছেন। উপস্থাপন করেছেন নানা দৃষ্টান্ত। তিনি যেমন পশুপাখি ও পোকামাকড়ের দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ দেখিয়েছেন, তেমনি দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ উল্লেখ করেছেন মহাকাশ ও তারকারাজির। এখানে একটি ব্যাপার স্পষ্ট- তিনি তার সৃষ্টিজগতের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এবং তা আমাদের উপদেশ গ্রহণের জন্য। এ কথাটিই সূরা যুমারের ২৭ নং আয়াতে বিবৃত আছে: “আমি (আল্লাহ) এই কোরানে মানুষের জন্য সকল প্রকারের দৃষ্টান্তই বর্ণনা করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।” অতএব, একটি ব্যাপার পরিষ্কার যে মহাজাগতিক ও অন্যান্য সকল দৃষ্টান্ত এবং বাণী কেবল আমাদের উপদেশ প্রদানের জন্য; বিজ্ঞানের তথ্য ও তত্ত্ব জানান দিতে নয়। যে কারণে কোরানের আয়াতগুলো উপদেশের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু এবং সে পন্থায়ই বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এই বিবরণগুলো বর্ণনার মূল উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে পাঠ করাটাই বাঞ্ছণীয়।

সর্বশেষ কথা হলো, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক- এরা সকলেই কোরান থেকে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শনের যথেষ্ট স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে। কিন্তু কোরানের উপকারিতা একমাত্র মুমিন ব্যক্তিই অর্জন করতে সক্ষম। কারণ কোরান অবতীর্ণ হয়েছে মানুষের জীবনবিধান হিসেবে; ব্যক্তিজীবনে, চলার পথে, পরিবার, সমাজ ও পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রে কোরানের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য। ব্যস এতটুকুই। আর একমাত্র মুমিনই তা মান্য করে থাকে এবং এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তৎপর হয়। কারণ কোরানের উপরই তার বিশ্বাস ও নির্ভরতা।

এদিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহ সুরা যুমারের ৩৩ নং আয়াতে বলেছেন, “অবশ্যই এই কোরানে বিশ্বাসী (মুমিন) সম্প্রদায়ের জন্য রহমত ও উপদেশ রয়েছে।”

এছাড়াও সূরা আল বাক্বারার দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “এই কোরানে রয়েছে মুত্তাকীদের জন্য পথপ্রদর্শন।”

তাই সকলের কাছে বিনীত নিবেদন, কোরানকে পাঠ করুন, বুঝুন ও গবেষণা করুন জীবন পরিচালনার লক্ষ্যে এবং এটাই কোরান নাযিলের একমাত্র কারণ। কোরানের যে বাণীগুলোর সাথে আজকের বিজ্ঞানের যেসকল থিওরি খাপ খেয়েছে কিছুদিন পর বিজ্ঞানীরাই তাতে পরিবর্তন আনতে পারে এবং বর্তমান মতকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। কিন্তু কোরান সর্বদাই অপরিবর্তণীয় চূড়ান্ত মহাসত্য। বিজ্ঞানের উপর এর কোন নির্ভরতা নেই।