আগামীকাল শনিবার ‘নিলাম’ এর মধ্য দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে আসন্ন আইপিএল এর কার্যক্রম। ক্রিকেট কম, ব্যবসা বেশি রীতিতে চলা আইপিএল এর অন্দরে একটু ঢু মারবো।
মূলত সম্প্ররচার স্বত্বকে কেন্দ্র করে জি মিডিয়া গ্রুপের সাথে দ্বন্দ, এবং সে দ্বন্দের রেশ ধরে জন্ম নেয়া আইসিএলকে থামাতেই জন্ম আইপিএল এর। আইপিএল অাদৌও আলোর মুখ দেখতো না, যদি আইসিএল এ খেললেই জাতীয় দলের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে এই সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে ক্রিকেটাররা ভয়ে নিজেদের আইসিএল থেকে গুটিয়ে নিতো তাহলে। সেটি তো হয়ই নি। সাবেক কিছু বিশ্ব তারকা এবং স্থানীয় ভারতীয়দের নিয়ে গড়া দলগুলো দিয়ে শুরু আইসিএল সবচেয়ে বড় চমকটা দেখায় সাবেক এবং সেই সময় জাতীয় দলে খেলা কিছু খেলোয়াড়দের নিয়ে লাহোর বাদশাহ নামের পুরো একটি পাকিস্তানি দল গঠন করে। তবে, সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি দেয় বাংলাদেশ। হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে তৎকালীন জাতীয় দলের সাত ক্রকেটার সহ ঢাকা ওয়ারিয়র্স নামের এক দল গঠন করে আলোচনার টেবিলে ঝড় তোলেন বেঙ্গল টাইগাররা। সে ঝড় সামাল দিতে অনোন্যপায় বিসিসিআই বাধ্য হয় আইপিএল এর জন্ম দিতে। বোঝাই যাচ্ছে ক্রিকেটের স্বার্থ বা উন্নয়ন নয়, বরং আইসিএলকে রুখতেই জন্ম আইপিএল এর। এর সাথে যুক্ত হয় লোলিত মোদির ব্যবসায়িক চিন্তা। ফলস্বরুপ এইটা আর ক্রিকেট না, পরিণত হয় এক জগা খিচুড়িতে।
প্রথমেই আসেন ‘অকশন’ তথা আধুনিক কালের দাসত্বের ক্রিকেটিভ সংস্করণে। পুরো জাহান থেকে দাস প্রথা যখন ঠাই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায় তখনই আইপিএল ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটে এ প্রথাটিকে পুনরায় উজ্জাবিত নতুন করে। বিভিন্ন টেবিলে মালিকদের কপাল কুঁচকানো ফেক অনুভুতি তাতে লালাগো বাহারি রং। একজন করে খেলোয়াড়ের নাম ঘোষণা করছেন উপস্থাপক আর বিভিন্ন মালিক পক্ষ তাকে নিয়ে দর কষাকষি করছে। অন্ধকার যুগের গল্প উপন্যাসে বহুবার পরে যারা এই দাস কেনাবেচাটা কিভাবে হতো তা নিয়ে চিন্তায় সময় পার করছেন তারা চাইলে কালকে টিভির পর্দায় চোখ রাখতে পারেন। দেখবেন, ক্রিকেটের দাসদের নিয়ে মালিক বেশের বাদশাহরা কিভাবে কাড়াকাড়ি করছে।
বাদশাহ থেকে ইয়াদ আসলো এদের ভদ্রস্থ নাম হচ্ছে ফ্রাঞ্চাইজি। এইটাও কঠিন এক চিজ। ক্রিকেট খেলাটার সাথে দুরদুরান্তেও এদের কোনো সম্পর্ক নাই। আচমকাই দুমাসের জন্য এরা হয়ে যায় ক্রিকেটের নিবেদিত প্রাণ। খেলোয়াড়দের হর্তা কর্তা। এতে ক্রিকেটের কতটুক লাভ হয় খোদা মালুম, তবে এই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যে দু মাসে ফুলে ফেপে লাল হয়ে যায় সেটা বোধয় না বললেও চলে।
ফ্রাঞ্চাইজি নামক আপদের সাথে রয়েছে বলিউডি মাসালা। তিনটা দলের মালিকানায় আছেন তিন বলিউড তারকা। আবার লিগ শুরুর আগের দিন পুরো বলিউডকে মাঠে এনে নাচানোটাও আইপিএল এর বড় কৃতিত্ব। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়। কাজ যাই হোক তাতে একটু বলিউড সুন্দরীদের কোমর না দুললে ভারতে কোনো কিছুই যেন ঠিক জমে না। এইটা একটা অদ্ভুৎ দেউলিয়াপানা বৈ আর কিছুই না।
এবার আসেন মূল খেলা ক্রিকেটে। যার জন্য এই আয়োজন তাতেও যেনো ঠিক ভরসা করতে পারছিলো না বিসিসিআই। কোনো ব্যাপার না। আসলো চিয়ার লিডার নামক বিনোদন দেয়ার আরেক অনুষঙ্গ। বিনোদন দেয়ানোর উদ্দেশ্যে আনা এ চিয়ার্স গার্লদের বসন আবার কর্তাদের ভালো লাগেনি। তাই কেটে ছেটে যতটুকুতে না হলেই না ওইটুক রেখে মাঠে নামিয়ে দেয়া হলো এদের। বলিউডের মশলা, স্বল্পবসনা চিয়ার লিডার্সেও মন ভরলো না। এইবার নজর গেলো সুঠাম দেহী নায়িকাদের ওপর। অ্যাম্বাসেডর করে আনার নামে আবারো শরনাপন্ন হতে হলো বলিউড সুন্দরীদের। বেশ একটা ব্যবস্থা হলো বটে। লাস্যময়ীদের হাসিতে যদি মনে ভিন্ন কিছুর জন্ম দেয় তাতে আর কিছু না হোক অন্তত চোখের শান্তি দেয়ার জন্য স্বল্পবসনাদের বসিয়ে দেয়া হয়েছে একদম চোখে সামনে। আপাত দৃষ্টে এটিকে রাজাদের রংমহলের বাইজি নৃত্যের পুনরমঞ্চায়ম বলা যায়।
এরসাথে যোগ হলো উদ্দাম নৈশ জীবন। সবখানে যখন ক্রিকেটারদের নৈশ জীবনের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকে তখন আইপিএল হাটলো ভিন্ন পথে। ম্যাচ শেষ হওয়া মাত্রই উদ্দাম পার্টি, তাতে স্বল্প বসনা চিয়ার গার্লদের অবাধে প্রবেশের সুযোগ যোগ করলো ভিন্ন মাত্রা। সুরার গুনে বেহাল অবস্থায় ক্রিকেটারদের বহু ছবি বহু সময় সময় আমরা দেখেছি বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রবল সমালোচনার মুখে চিয়ার্স গার্লদের প্রবেশের মুখে লাগাম তো পরিয়েছে কিন্তু তাতে যে অবস্থা আমূল বদলে গিয়েছে এমনও না।
এবার নজর দেই সবচেয়ে মজার দুটি বিষয়ে দিকে। জুয়া এবং ম্যাচ পাতানো। চারিদিকে যখন অর্থের ছড়াছড়ি তখন জুয়া প্রেমীরাই চুপচাপ বসে থাকেন কি করে? এ মধুর স্বাদ জুয়াড়িরা না চেখেই চলে যাবেন এমনটা ভাবাও তো অন্যায়। আর এদের হাত ধরেই শোনা গেলো স্পট ফিক্সিং, ম্যাচ ফিক্সিং এর মুখোরচক কাহিনী। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে একটি দল নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও সে দলের দলপতি নির্দোষ প্রমাণ হয়ে গেলেন যাদুমন্ত্রের বলে। ধরণীতে বোধয় তিনিই একমাত্র ভাগ্যবান যে, পুরো দলের বিপক্ষে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ উঠলেও দলের মাথা বিনা অভিযোগে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেরাচ্ছেন। মরহাবা!
এতটা সময় চলে গেলো অথচ মূখ্য চরিত্র ক্রিকেটের কথাই আসলো না। আইপিএল প্রচারকরা বলে থাকেন যে সবচেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দিতা নাকি হয় আইপিএল এ। কথাটা হজম করতে একটু সমস্যা হয়। কারণ, ইতোমধ্যেই যে লিগের গায়ে পাতানো ম্যাচের তিলক লেগে গিয়েছে এবং সেটির সমাধার বদলে বরং পুরো বিষয়টাই ধামাচাপা দেয়া হয়েছে তাতে প্রতিদ্বন্দিতাটাও যে লোক দেখানো না সেটি বিশ্বাস করা কিছুটা কষ্টসাধ্যই।
একটু নজর দেই আইপিএল এ বাংলাদেশিদের অংশ্রহণ মামলায়। আব্দুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ আশরাফুল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল এবং মোস্তাফিজুর রহমানকে দেখা গিয়েছে এ রঙ্গমঞ্চের অংশ হতে। এক সাকিব আর মোস্তাফিজকে বাদ দিলে বাকিরা যেনো শুধু ছিলেন পাপেট হয়েই। বাংলাদেশ এর সর্বকালের সেরা অধিনায়ক মাশরাফি, রাজ্জাক, আশরাফুলদের আইপিএল অভিযান শেষ হয়ে গিয়েছে এক ম্যাচেই। তামিমের বিষয়টা তো ছিলো আরো প্রহসনমূলক। বাদশাহ সাহারা তামিমকে খেলানোর নির্দেশ দিলেও তা ছিলো নেহায়েত ফাকা বুলি। বাকি রইলেন সাকিব আর মোস্তাফিজ। সাকিব সাত বছর ধরে আইপিএল এর অংশ হলেও তার প্রতি উপেক্ষার দৃশ্যটা স্পষ্টই দেখা গিয়েছে বহুবার। বিশেষ করে শেষ আইপিএল এ সাকিব যেনো ছিলেন শুধুই দলের শোভা বর্ধনের জন্য। আর প্রথম আসরেই মোস্তাফিজ চমক দেখালেও, নিলাম মঞ্চে প্রভুদের কাছে বিক্রি হয়ে নিবেদিত প্রজা হিসেবে নিজেকে নিংঢ়ে দিয়ে তার মূল্য চুকিয়েছেন দীর্ঘস্থায়ী এক ইনজুরিতে পড়ে।
আপনি যদি বলেন এসব আসরে খেলে খেলোয়াড়দের মান বাড়বে, তবে তা যুক্তিতে টিকবে না। কারণ, একই আদলে আমাদেরও একটা রঙ্গমঞ্চ আছে। সেখানে প্রভু ভারতের দেব দেবতারা বাদে টি টোয়েন্টি জগতের প্রায় সব বড় নামই খেলেন। শিখতেই যদি হয় তবে ঘরে শেখাই ভালো, বিশেষ করে সে অবস্থা যখন রয়েছে। আর বিপিএল আমাদের খেলোয়াড়েরাও নিয়মিত সুযোগ পেয়ে থাকেন। সুতরাং, সে সুযোগের পরেও কেনো অবহেলিত হয়ে সময় কাটানোর এমন অদ্ভুত মনোবাসনা?
ক্রিকেট এমন একটি খেলা যেটি দেখানোর জন্যে মানুষকে জবরদস্তি করা লাগে না। ক্রিকেটের নিজস্ব আবেদনেই মানুষ ক্রিকেট দেখে। এটা কোনো ‘বাঈজি’ নৃত্য না, যে স্বল্প বসনাদের প্রকাশ্যে নামিয়ে কোমর দুলিয়ে যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে দর্শকদের মাঠমুখো করতে হবে।