আপনার বহুল পঠিত উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ কীভাবে লেখা হল?
শওকত আলী: আমি ইতিহাস পড়তে ভালোবাসি। ইংরেজি সাহিত্য পড়াতাম। হিন্দি সাহিত্য পড়তাম। আর বাংলা সাহিত্যতো পড়তামই। তখন মনে হয়েছিল বাংলা ভাষায় যে সমস্ত গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে, তার মধ্যে ধর্মীয় ভাবটা বেশি। প্রেম-ভালোবাসার ভেতরেও ধর্ম টেনে আনা হয়।
আমার কাছে মনে হয়েছিল যে লোকটি শ্রমজীবী, সে ঠাকুরের কাছে কখন যায়? সে শুধু যায় নিজের কষ্ট দূর করার জন্য। ধর্মের কাছে গেলে টাকা পয়সার মালিক হবো এরকম চিন্তা করে কেউ দেবতার কাছে যেতো না। এই অবস্থার মধ্যে চরিত্ররা বড় হয়েছে।
ছাত্ররাজনীতি ও জেলজীবন…
শওকত: ৫৩-এ ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম। তখন ছাত্র ইউনিয়ন তৈরি হল। ওর ভেতের ঢুকে পড়লাম। আমি সহসম্পাদক ছিলাম। দশ মাস জেলখানায় ছিলাম। জেলবন্দীরা সবাই গল্প করতো একত্রে। আমি ওসব পছন্দ করতাম না। নিজের মতো বই পড়তাম আর কবিতা লিখতাম।
দেশভাগ নিয়ে কিছু বলেন…
শওকত: এসব নিয়ে তো আগেও বলেছি। আমার বাবা ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি আমাকে নিয়ে নামাজ পড়তেও নিয়ে গেছেন। কিন্তু মুসলমানদের আলাদা দেশ হবে এটা মানতে পারেননি। মুসলমানরা আলাদা জাত এসব ব্যাপারে আপত্তি ছিল ঘোরতর। উনি কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। এরকম অবস্থা থেকে দেশভাগ হল।
আপনার প্রথম বই প্রকাশ…
শওকত: তখন গল্প-ঠল্প লেখা শুরু করেছি। বাবা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ও সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। বাবার এক বন্ধু নানান রকম বই নিয়ে যেতেন। আমি তা পড়তাম। তিনিই আমাকে লিখতে উৎসাহ জোগান।
আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে…
শওকত: প্রথমে শিক্ষকতা। দিনাজপুরে শুরু। বীরগঞ্জ হাইস্কুলে। ওরা আমাকে হেডমাস্টার বানিয়েছিল।
আপনার বন্ধুদের সম্পর্কে?
শওকত: ইলিয়াস মানুষ হিসেবে ভালো ছিল। খুবই ভালো। তার ভেতরে আধুনিকতার ব্যাপারটা প্রবল ছিল খুব। কিন্তু মানুষের কিসে মঙ্গল সে বিষয়টি সবসময় ক্রিয়াশীল ছিল তার মধ্যে। ইলিয়াস ভালো লিখতেন।
শোনা যায় আপনার বাবা আলখিল্লা পরে বেরিয়েছিলেন? আপনার বাবার স্মৃতি শুনতে চাই?
শওকত: আমার বাবা অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী লোক। সে কারণে হয়তো সন্ন্যাসীর বেশে আলখিল্লা পরে ভ্রমণে বের হতেন। পায়ে হেঁটে রায়গঞ্জ থেকে এলাহবাদ পর্যন্ত পৌঁছান। এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ধর্ম নিয়ে আপনার অভিমত শুনতে চাই?
শওকত: ধর্মকে যদি জীবনবিরোধী করে বানিয়ে নেওয়া হয় তখন মানুষের বিকাশ কি সম্ভব? বরং ধর্মকে আমরা ভালো মতো ব্যবহারের ফলে মঙ্গলের দিকে যেতে পারি।
আপনার জীবনে কোনো প্রেম এসেছিলো? লেখালেখিতে প্রেমকে কীরূপে ব্যবহারের আপনি পক্ষপাতী?
শওকত: না, প্রেম বলে যেটা বুঝি সেটা আমি নিজের জীবন থেকে যা পাচ্ছি তাই। আমি সংসার করছি, সন্তানের বাবা হয়েছি, এগুলোই তো প্রকৃত প্রেম। আর নর-নারীর দেহের সম্পর্কটাই যদি বড়ো করে দেখা হয়, তাহলে আজকে যাকে ভালো লাগলো কালকে কি তাকে ভালো লাগবে?
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু আপনার দৃষ্টিতে কীভাবে বিষয়টা ধরেন?
শওকত: মুক্তিযুদ্ধ একটা স্বপ্নের মতো ব্যাপার। যেটা নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধটা কি? এটা নিয়ে খুববেশি বাড়াবাড়ি হয়েছে। উচ্চবাচ্য হয়েছে। কিন্তু ভালো লেখা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার নিজের মতামত কি?
শওকত: এটা পাকিস্তান বানানো হবে, ধর্মীয় রাষ্ট্র বানানো হবে, এটা আমরা চাই না। একবার ইংরেজ দাসত্ব করেছি, আবার পাকিস্তানের! এটা আমরা চাইনি। তাই যুদ্ধ করেছি। এখানে আবেগটাই প্রধান। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমরা নিজেরা নিজেদের মতো করে বাঁচবো।
কিন্তু আপনারা কেমন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন? এমন রাষ্ট্র কি আপনার কাম্য ছিল?
শওকত: আমরা যখন যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তখন বিষয়টা পরিস্কার ছিল না। হাজী দানেশ তখন বেঁচে ছিলেন। আমি তার সাথে মাঝে মাঝে বাসায় গিয়ে দেখা করেছি। উনি বলতেন, দেশ যদি হয়, পাকিস্তান যদি সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হয়, তখন এটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা যাবে। তখন আমি বললাম, তাইলে কি চীনের মতো বিপ্লব হবে? উনি বললেন, বিপ্লব হতে অনেক দেরি। আমাদের স্বপ্নের রাষ্ট্র বা দেশ আমরা যেমন চেয়েছিলাম তেমন তো পেলাম না।
আপনার লেখক জীবনের গল্প শুনতে চাই?
শওকত: সাহিত্যের জন্য আমি জীবনটা ব্যয় করতে পারিনি। করা উচিত ছিল। কিন্তু বড় ভাই দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিল। বাবাকে আর্মিরা মেরে ফেলল। বড় বোনটা স্কুলে মাস্টারি করত। তার আয় ইনকামে চলতো সংসার। আমি প্রাইভেট টিউশনি করি। তারপর আমি ঢাকায় আসি। জীবনের কতো টানাটানি থাকে। সেই ঘানি টেনে আর সাহিত্য কতোটা হয়? তবু যা পেরেছি, করেছি।
(বি: দ্র: সাক্ষাৎকারটি ‘গল্পকথা’ শওকত আলী সংখ্যা থেকে সংগৃহীত)