সিরিয়ায় উত্তরাঞ্চলীয় জেলা আফরিনে চালানো অভিযান মানবিজ শহর পর্যন্ত বাড়াতে চায় তুরস্ক। বুধবার দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান এমন সময়ে এই হুমকি দিলেন যখন দেশটির সশস্ত্র বাহিনী সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় জেলাটির বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখলে নিয়েছে। পাঁচ দিনের হামলায় দখলকৃত জায়গাগুলোকে নিজেদের নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক। পশ্চিমে মানবিজ শহরকে এবার লক্ষ্য বানিয়ে আগাতে চাইছে দেশটি।
গত বৃহস্পতিবার স্থল পথে অভিযান শুরু হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যেই শনিবারে আকাশ পথেও হামলা চালানো শুরু করে তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাপুষ্ট কুর্দি যোদ্ধাদেরকে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে তুর্কি সরকার। আলেপ্পোর পূর্বসীমান্ত ঘেষা মানবিজ শহরটিও কুর্দিদের দখলে রয়েছে।
অবস্থানগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মানবিজ পর্যন্ত কুর্দিরা রয়েছে এবং তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেছেন, “আমরা আমাদের সীমান্তে কোন সমস্যা জিইয়ে রাখতে দেব না, সব পরিস্কার করে ফেলা হবে।”
বৃহস্পতিবার মধ্য রাত থেকে কুর্দি গেরিলা সংগঠন পিপলস প্রটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি) এর বিরুদ্ধে ‘অপারেশন অলিভ ব্রাঞ্চ’ নামে তুরস্কের অভিযানের পাঁচ দিনে অর্থাৎ মঙ্গলবার পর্যন্ত তুর্কি স্বশস্ত্র বাহিনীর দাবিমতে, ২৬০ কুর্দি ও আইএস যোদ্ধা এবং ১ জন তুর্কি সেনা নিহত হয়েছে।
অন্যদিকে কুর্দি মিলিশিয়া বাহিনীর এক কমান্ডার হতাহতের এই সংখ্যাকে মিথ্যা প্রচারণা বলে প্রত্যাখান করেছেন।
তুর্কি প্রেসিডেন্টের এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, সিরিয়ার আফরিন থেকে তুর্কি বাহিনীকে হটিয়ে দিতে তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে কুর্দি যোদ্ধারা। কুর্দিদের ওই মিলিশিয়া বাহিনীটিকে তুরস্কের ভেতরে স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) বর্ধিতাংশ ও একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে তুরস্ক।
উল্লেখ্য, তুরস্ক পিকেকে কে নিজ দেশের জন্য হুমকি মনে করে এবং ইতোমধ্যে তারা সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সিরিয়ায় আইএস বিরোধী লড়াইয়ে ওয়াইপিজি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলো। এই হামলায় তুরস্কের সরকারি বাহিনীর সাথে সিরিয়ান বাশার বিরোধী ফ্রি সিরিয়ান আর্মির বিপুল সংখ্যক মিলিশিয়াও যোগ দিয়েছেন।
কিছুদিন আগে কুর্দিদের নিক্ষিপ্ত একটি রকেট কিলিস নামে একটি সীমান্ত শহরে গিয়ে পড়লে, তুরস্ক পাল্টা রকেট ছুড়ে তার জবাব দেয়। ওয়াইপিজি মিলিশিয়ারা বলছে, এর থেকেই তুরস্ক আফরিন এলাকার ওপর গোলা বর্ষণ করছিল। এরপর গত শনিবার থেকে স্থল হামলার পাশাপাশি বিমান হামলা শুরু হয়। রাশিয়ান বার্তা সংস্থা তাস জানায়, তুর্কি বিমান বাহিনী ১১৩ টি লক্ষবস্তুতে হামলা চালালে এর মধ্যে ১০৮ টিতেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ওয়াইপিজি সিরিয়ায় আমেরিকার প্রতক্ষ্য সহযোগিতা পেয়ে আসছিলো। তুরস্কের এই অভিযানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খর্ব করাও অন্যতম একটি কারণ। ওয়াশিংটনও হামলার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মধ্যে এ নিয়ে ফোনালাপ হওয়ার সম্বাবনা রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাংশের অধিকাংশ স্থান এখন ওয়াইপিজির নিয়ন্ত্রণে। সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিরোধী লড়াইয়ে কুর্দিদের এই বাহিনীটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান মিত্র। আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই শেষ হয়েছে, এই যুক্তি তুলে ধরে এখন ওয়াইপিজির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতার অবসান চায় তুরস্ক। কিছুদিন আগে আমেরিকা ওয়াইপিজিকে সামরিক সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো। তারা বেশ খোলাখুলিভাবেই ওয়াইপিজিকে সহযোগিতা করে থাকে। গত বছরের মে মাসে তুরস্কের প্রবল আপত্তি স্বত্বেও আমেরিকা সিরীয় কুর্দিদের অস্ত্র সহয়তা সংক্রান্ত একটি বিল পাশ করে।

এদিকে আফরিনে তুরস্কের অভিযানে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে ইরান। তুর্কি বাহিনীর সাথে বাশার বিরোধী গেরিলাদের যোগ দেয়াকে সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের নতুন করে মদদ দেয়া হিসেবেই দেখছে দামেস্ক। এর ফলে তুরস্কের সহযোগিতায় বাশার বিরোধী সামরিক শক্তিগুলো নতুন করে লড়াইয়ে ফিরে আসবে। অভিযানের ফলে সিরিয়ায় আসাদ সরকার ও অন্যান্য গ্রুপের মধ্যে ইরানের যে আধিপত্য বজায় ছিলো তাতে ভাটা পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে সিরিয়া ইস্যুতে ইরানের অবস্থানের কিছুটা হেরফের হতে পারে। প্রাথমিকভাব রাশিয়া এই অভিযানের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পরোক্ষভাবে এই অভিযানে রাশিয়ার সহযোগিতা আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। আল জাজিরা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আফরিনে তুর্কি অভিযান শুরু হবার আগেই রাশিয়া তার সৈন্য ঐ অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এটি আসলে তুরস্ক রাশিয়ার বর্তমান সময়ে বিদ্যমান সুসম্পর্কেরই ফসল। ফলে এ অঞ্চলে ইরানকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া তুরস্ক নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।