কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানাই। আজ ২৫ জানুয়ারী, বৃহস্পতিবার,২০১৮, সকাল ৮.১৫ মিনিটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শওকত আলীর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। প্রদোষে প্রাকৃতজন, দক্ষিণায়নের দিন,কুলায় কাল স্রোত, শেষ বিকেলের রোদ ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাসের লেখক শওকত আলী বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের সাবেক সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে তিনি একুশে পদক অর্জন করেন। তাঁর শেষ যাত্রা কল্যাণময় হোক।
লণ্ঠনের আলোর নিচে লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। হাতে তখনো রক্তাক্ত ছুরিখানা। ওই অবস্থাতেই সে দুহাতে সদ্য-ছাড়ানো গোসাপের চামড়াখানা মেলে ধরে। বলে, তুই সদাগরের ব্যাটা সদাগর লখিন্দর বাবু, বহুত জান-বুঝ তোর, কহ রক্তই তো জানোয়ারের জান, নাকি?
লক্ষ্মীকান্ত স্বীকার করেন—হ্যাঁ, রক্তই জন্তু-জানোয়ারের বেঁচে থাকবার প্রধান অবলম্বন। বলেন, হ্যাঁ বাবা গুপীনাথ, রক্ত ছাড়া কি প্রাণ বাঁচে?
হ্যাঁ—গুপীনাথ যেন খুশি হয় কথাটা শুনে। বলে, তুই খুব ভালো মাহাজন-হামার কথাটা তুই বুঝিস, কিন্তুক রক্ত দেখে তুই ঘিন করিস ক্যানে কহ?
লক্ষ্মীকান্ত বিব্রত হন গুপীনাথের কথা শুনে। বলেন, না ঘেন্না করব কেন, ঘেন্না করি নি–কিন্তু অন্যের ঘর, এই ঘরের ভেতরে তুই সাপখোপ কাটা-ছেড়া করবি—এটা কি ঠিক?
নাহ, ঠিক নহে–হামি জানি ঠিক নহে, কিন্তুক যেখুন কসিমুদ্দিন মাহাজন হামার জান লিয়ে এই ঘরের ভিতর কাটাকাটি করে, তেখুন? তেখুন কামটা ঠিক হয়, না সদাগরের ব্যাটা?
লক্ষ্মীকান্ত বিব্রত বোধ করেন। হারামজাদা কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যাচ্ছে। ছাল-ছাড়ানো গোসাপটা তখনো মেঝেময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মেঝেতে থিকথিকে কাদার এত রক্ত জমছে জায়গায় জায়গায়। জানোয়ারটা হেঁটে বেড়াচ্ছে আর তার চামড়াটা গুপীনাথের হাতে-কী বীভৎস ব্যাপার! লক্ষ্মীকান্তের গা বিজ বিজ করতে লাগল। বললেন, ওটাকে বাপু বাইরে ফেলে আয়।
লষ্ঠনের আলোয় ল্যাজে-মুড়োয় বাঁধা গোসাপের স্পপটার দিকে নজর ফেলে গুপীনাথ বেশ একচোখ হেসে নেয়। তারপর বলে, এই আড়তের ঘরত বসে কসিমুদিন মহাজন কুন কাম করে তুই কহ? হামার জানটা কাটা-ছিড়া করে না? চাউলটা কী? গহমটা কী? মকইটা কী? উগিলা তো মানুষের রক্তই, ঠিক কি না কহ?
হাঁ, হিসাব ত মিটাবি–তুই বড়া সদাগর, তোর বহুত পাইসা, সি হামি জানি, চান্দো সদাগরের গুষ্টি না তুই? হিসাব মিটাবা পারিস তুই— কিন্তুক হিসাবটা তো বাবু মসয় বহুত লাম্বা। কতকালের হিসাব, কেহ জানে না—তুইও জানিস না
লক্ষ্মীকান্ত নজর করে দেখেন গুপীনাথের মুখের দিকে। দাড়িগোফ আর ঝাঁকড়া এলো চুলে গোটা মুখ এমনভাবে ঢাকা, যে সে মুখের কোনো ভাবই আন্দাজ করা যায় না। –
যেখুন আকাল হয় তেখুন সদাগরের ব্যাটা কী করে? হামার জান লিয়ে কাটা-ছিড়া করে না এইঠে বসে? সিটা খুব ঠিক কাম, হয় না মাহাজন?
লক্ষ্মীকান্ত জবাব দেন না। এই বদ্ধ পাগলের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। তিনি চুপ করে থাকেন।
গুপীনাথ গোটা মেঝেটা পায়চারি করে আসে একবার। তারপর সদ্য-ছাড়ানো লৎপতে চামড়াখানা, একেবারে মুখের সামনে এসো দোলায়ই মাল তোর পছন্দ হয় না, কহ?
আহা কেন বাপু দিকদারি শুরু করেছিস? লক্ষ্মীকান্ত বিরক্ত হন। বলেন, বললাম তো, চামড়ার ব্যবসা আমি ছেড়ে দিয়েছি—ওকাজ আর আমি করি না, লক্ষ্মীকান্ত প্রায় মিনতি করতে থাকেন।
গুপীনাথ চামড়াখানা তখন মেঝেতে নামিয়ে রাখে। তারপর আরেকটা গোসাপ নিচ থেকে টেনে তোলে। গলার বাধন আলগা হয়ে যাওয়াতে সাপটা ভয়ানক ফোঁসে, শরীর মোচড়ামুচড়ি করে, ল্যাজ দিয়ে বাড়ি মারার চেষ্টা করে। গুপীনাথ নিপুণ হাতে সামাল দেয় সব এবং সামাল দেওয়ার সময় সাপটার সঙ্গে সে আলাপ করে। শেষে একহাতে মাথা আর অন্যহাতে ল্যাজ টানটান লম্বা করে সাপটার দৈর্ঘ্য দেখায় লক্ষ্মীকান্তকে। বলে, এইটা পসন্দ হয় তোর? কহ, হয় না?
লক্ষ্মীকান্ত স্থির করেছেন হারামজাদার সঙ্গে কোনো কথাই বলবেন না। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
অ্যাই চোপ। হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠল লোকটা। ধমক যে কাকে দিল, বোঝা গেল না। বলতে লাগল, হামার লখিন্দরের পসন্দ হয় না— হামা’র কাহাকো পসন্দ্ হয় না।
ওই কথা বলতে বলতেই সে একপায়ে গোসাপটার লেজ এবং একহাতে মাথা ধরে ধারালো ছুরি দিয়ে গলার কাছে আঁচড় দেয় দুবার। তারপরই দেখতে-না-দেখতে চড় চড় করে ছাল ছাড়িয়ে নেয়। তারপরই দেয় সাপটকে ছেড়ে। ছালহীন গোসাপটা মেঝেতে মোচড়ামুচড়ি করে, ফোঁসে এবং মেঝেময় রক্ত ছিটিয়ে ছুটে বেড়াতে আরম্ভ করে। আর এদিকে তখন গুপীনাথ হাসে–এই দ্বিতীয় চামড়াখানও দুহাতে সে মেলে ধরে লক্ষ্মীকান্তের মুখের সামনে। বলে, এইখান দেখ লখিন্দর বাবু, পসন্দ্ হয় এইখান, কহ? ই সাপ সাপ নহে, সাপের বাপ-ইয়ার নাম সনা গুই, কহ পসন্দ হয়?
লক্ষ্মীকান্তের অসহ্য বোধ হয়। ঘড়ির দিকে তাকান, মোটে ৯টা, কিন্তু মনে হচ্ছে, যেন নিশুতি রাত। শেষে বললেন, হয়েছে বাপ, আর জ্বালাস নে, গত বছরের পাওনার টাকাটা চাস তো, পাবি। এখন তোর এই কাটাকাটির কাজটা বন্ধ কর—ভগবানের জীব তো—
হ্যাঁ ভগমানের জীব, গুপীনাথ মাথা দোলায়, কিন্তুক কুন্ ভগমানের জীব সিটা কহ ? হামার ভগমান মা বিষহরি—হামরা সান্তাল, কালিনাথ হামার ভাই, হাঁ। বুঝে দেখিস, এই বলে সে মেঝেতে রাখা মুখবাধা থলের গায়ে একটা খোঁচা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস করে শব্দ হয়। থলের ভেতরকার জীবটা নড়াচড়া আরম্ভ করে দেয়। গুপীনাথ ধমকে ওঠে, চোপ সালা, তুই কুছু কহিস না, হামার সঙ্গে সদাগরের ব্যাটা লখিন্দরের হিসাব-নিকাশ—তোর কী?
লক্ষ্মীকান্ত লক্ষ করে দেখলেন, থলের মধ্যেও সাপ নিয়ে এসেছে হারামজাদা। তিনি জানতে চান, ওটাকে আবার থলের মধ্যে কেন গুপীনাথ?
গুপীনাথ হাসে। বলে, উটি হামার লতুন কইনা বাবু মসয়, ভারী রূপসী—কালি গহমা দেখিছিস? দেখিস নাই? কালা দেওয়ার এতন বন্নখানি, বুকখান ফকফকা ধলা আর লয়ন দুটি দীঘির পানির মতন টলটল টলটল করে—দেখিস নাই, দেখে লে তা হইলে—
গুপীনাথ ঝুকে পড়ে থলের মুখের বাঁধন খুলতে যায়।
না না, আরে পাগল নাকি-লক্ষ্মীকান্ত ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কাতরস্বরে বলতে থাকেন, তুই ওই সাপ-টাপ বার করিস না বাপ—তোর সব হিসেব আমি মিটিয়ে দেব।
হাঁ, হিসাব ত মিটাবি–তুই বড়া সদাগর, তোর বহুত পাইসা, সি হামি জানি, চান্দো সদাগরের গুষ্টি না তুই? হিসাব মিটাবা পারিস তুই— কিন্তুক হিসাবটা তো বাবু মসয় বহুত লাম্বা। কতকালের হিসাব, কেহ জানে না—তুইও জানিস না।
এ কেমন কথা বলছে পাগল? লক্ষ্মীকান্ত ঠিক বুঝতে পারেন না। বলেন, ও বাবা গুপীনাথ—হিসেবে তো গোলমাল কিছু নেই, মাত্র এক বছরেরই তো হিসেব-মাত্র গতবছরই তো মোট দুই দফা মাল দিয়েছিলি। ওইসময় বাপু ভারি ঝামেলা যাচ্ছিল আমার। আমি কোনোদিকে খেয়াল রাখতে পারি নি। পরে শুনেছি, শালা দাজুটা নাকি তোকে ঘাড় ধরে বার করে দিয়েছিল—আমি ও-বিষয়ে কিছু জানি না বাপ, দাজুটাকে আমি আগে কিছু বলি নি–বিশ্বাস কর।
উসব হামার ফম নাই। গুপীনাথ ভারি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। বলে, উপার তোর বহুত লোক, বহুত বড়া সদাগর তুই—সি হামি জানি—নাই হে সদাগরের ব্যাটা—উসব হামি মনত রাখি না—হামার বিষহরি মায়ীর কথা বুঝে দেখ। চান্দো সদাগরের মাহাতটা কুন কাম করিল ফম ভাঙ্গে দিলে—আহা কী কষ্ট, সন্তানের কষ্ট দেখে মায়ী কান্দে, কিন্তুক কিছু করে না—কিছু করিবা পারে না। কারণ উ যে মা জননী। যদি মায়ের রাগ হয়, তা হইলে যে দংশাবে মা—মা কিছু করে না সেই তানে—খালি সইয্য করে যায়। হামিও সইয্য করিছি, হামার রাগ সইয্য করার কুনো ক্ষমতা যে কাহারো নাই, সেই তানে হামি কিছু করি নাই—বুঝে দেখ মহাজন।
গুপীনাথ ওইসময় কেমন বিচিত্র ভঙ্গিতে ডাইনে-বায়ে দোল খায়। একবার এ পায়ে ভর রাখে, একবার ও-পায়ে। হাতে তখন গোসাপের চামড়াখানা ধরা। লোকটাকে ক্লান্ত মনে হয়। লক্ষ্মীকান্ত সিগ্রেট বার করে ধরান। তারপর আরেকটা সিগ্রেট বার করে গুপীনাথের দিকে এগিয়ে ধরেন, লে বাপু, সিগ্রেট খা।
মাথা ঝাকুনি দেয় গুপীনাথ। তারপর মুখখানা উপরে তোলে, চোখের পাতা টানটান করে তাকায়। তারপর মাথা ডাইনে বায়ে দুলিয়ে—থু করে থুতু ফেলে মেঝেতে। তারপর বলে, উ বান্দরের চ্যাট হামি খাই না, তুই খা।
কথাটা বলে সে মেঝেতে উবু হয়ে বসে। এবং চুপচাপ মাথা নিচু করে কোমরে গোঁজা একটি ছোট থলে বার করে। থলেটা উপুড় করে ঢালে মেঝেতে। থলের ভেতর থেকে বার হয় ভাঙা বেঁটে একটা ছিলিম আর দলা-পাকানো শুকনো ভাঙপাতা। বোঝা যায়, গুপীনাথ এখন ভাঙের আসর বসাবে ।-
গুপীনাথ মাথা দোলায়, না হে লখিন্দর, সি নহে, মাও বিটির কথা নহে। দেওতা হইল দেওতা। কিন্তুক বিষহরি মায়ীক দেওতা মানিবা চাহে নাই কেহ। বুঝে দেখ বাবু মসয়। জনমের পর হামার বিষহরি মায়ীক বাড়িত নিয়ে গেল মাহাদেব শিবোনাথ। কিন্তুক দেবীমায়ী উমহাক মারিল ক্যানে, কহ?
লক্ষ্মীকান্ত একবার ভাবেন, পালিয়ে যাবেন এই ফাঁকে। কিন্তু সাহস হয় না তার শেষপর্যন্ত। কারণ ঘরের ভেতর থেকেও দিব্যি শুনতে পাচ্ছেন দূরে মোটরগাড়ি চলাচলের আওয়াজ। একেকবার আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। পালিয়ে যাওয়ার চিন্তাটা তাকে মগজ থেকে ঠেলে রিয়ে দিতে হয়। কোনো উপায় নেই, লম্বা নিশ্বাস বার হয় তার। কোনো উপায় নেই, এই উন্মাদ সাওতাল সাপুড়ের সঙ্গেই তাকে রাতটা কাটাতে হবে।
এই গুপীনাথকে দেখেছিলেন দুপুরবেলা—তখন যদু রায়ের বাড়ি থেকে এই বটতলির হাটে আসছিলেন। লোকটা বাবা রোদে কান্দরের ওপর দিয়ে লম্বা একখানা লাঠি হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছিল তীরবেগে। তারপর হঠাৎ দেখা গেল, লোকটা দাড়িয়ে পড়েছে—পায়ের নিচে লাঠিচাপা এবং লাঠির নিচে গুইসাপ। এবং দেখতে—না-দেখতে, সাপটকে ল্যাজে, মুড়োয় গিট দিয়ে পাকানো বিড়ার এত করে বেঁধে ফেলল। গুইসাপ ধরার ওইটিই কৌশল। কিন্তু লোকটার দ্রুততা দেখে তার সন্দেহ হয়েছিল, এ নিশ্চয়ই গুপীনাথ। সঙ্গে ছিল দাইমুদ্দিন, সে হারামজাদা হল স্মাগলারদের আড়কাঠি। সে বলল, সাহা মশাই—ও গুপীনাথ নয়, আপনার ভুল হচ্ছে—গুপীনাথ তো সেই কবে থেকে লাপাত্তা। ও কোথেকে আসবে এখানে?
ওই সময় যদি পকেট থেকে চশমাখানা বার করে পরে নিতেন তাহলে এই হেনস্থা হয় তার? তিনি দাইমুদিনের কথা বিশ্বাস করলেন আর তারপর ওই বটতলির হাটখোলায় অহেতুক শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিলেন দুপুরটা। ভাবলেন, এই তো মাইল পাচেক রাস্তা, একটা ছুট লাগাবেন, তারপরই ওপার। ঘণ্টাদুয়েকের মামলা। ও নিয়ে কখনো দুশ্চিন্তা করেন নি, আজ কেন করতে যাবেন? তখন কি জানতেন, বর্ডারের হাঙ্গামাটা ঠিক সন্ধেবেলাতেই লেগে যাবে। ছিছি, একেই বলে বেকুবি। ১১ নং ১২ নং ১৩ নং–একসঙ্গে তিন বি-ও-পি জুড়ে গোলমাল। দাইমুদ্দিন খবর জানাল, বর্ডারের দিকে মানুষ যেতে দেখলেই দড়াম্ দড়াম করে গুলি চালিয়ে দিচ্ছে। আর ওই হাঙ্গামা আরম্ভ হতে-না-হতেই আড়তদার কসিমুদ্দিন, তার সাগরেদ বসির মুনশি, আর তাদের যত চাকর নফর, সব হাওয়া হয়ে গেল। তিনি কোথায় যান তখন? ভয়ানক দুশ্চিন্তা হয়েছিল তার। কিন্তু ভাগ্য বলতে হবে, যে দাইমুদ্দিনস পালায় নি। দাইমুদিনই রাতের খাবার জোগাড় করে দিয়েছে, লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে, শোবার ব্যবস্থাটিও তারই হাতে করা। কিন্তু শেষ আহাম্মুকিটা করলেন তিনি নিজেই। দাইমুদ্দিন বারবার করে বলে দিয়েছিল, সাহামশাই, খবরদার দরজা খুলবেন না। যে-ই আসুক, বলবেন, সকাল হোক, তারপর দরজা খোলা হবে। তিনি বেশ ভালো করে শুনে রেখেছিলেন দাইমুদিনের কথাটা। কিন্তু কী-যে হল, দরজায় দিলেন। এমন আহাম্মুকির কাজ কেউ করে ? কপালে দুঃখ থাকলে খন্ডাবে কে?
গুপীনাথের তখন কয়েক দম ভাঙ্টানা হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরটা ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার। পোড়া ভাঙের উৎকট বুনো গন্ধ বাতাসে ভাসছে। বুঝলেন, এবার নেশা হবে পাগলাটার এবং তা হলেই সে শান্ত হয়ে যাবে। একবার ঘুমিয়ে গেলে তিনি নিশ্চিন্ত। সকাল হওয়ার পর কি আর তিনি বসে থাকবেন? বয়ে গেছে তার। এখন নেশাগ্রস্ত লোকটা ঘুমিয়ে পড়লেই হয়।
কিন্তু ঠিক ওইসময়ই গুপীনাথ ফের উঠে দাঁড়াল। মেঝে থেকে গুইসাপের ছাল দুখানা হাতে তুলে নিয়ে জানতে চাইল, হাঁ বাবু মসয়— মাল গিলা তাইলে পসন্দ্ হইছে তোর—ঠিক না?
সে একটা কিছু হবে গুপীনাথ,—সকাল হোক, এবার তুই ঘুমো, আর আমাকেও একটু জিরোতে দে।
গুপীনাথ হো হো করে হেসে উঠল। যেন হাস্যকর একটা প্রস্তাব দিয়েছেন লক্ষ্মীকান্ত। বলল, নিন্দ হামার আসে না লখিন্দর—সদাগর নিন্দায়, তার বহু সনকা নিন্দায়, ব্যাটা লখিন্দর নিন্দায়, পুতোহু বেহুলা নিন্দায়—জগৎসংসার নিন্দায়—কিন্তুক জাগে কে ? না মা বিষহরি । মা বিষহরি নিন্দায় না, তার সন্তানেরা নিন্দায় না। আসমানের দেওয়া নামে—গাছ বিরিক্ষ উলটপালট করে—ডরে কেহ বাহার থাকে না–কিন্তুক ওইসময় কে থাকে বাহার ? কহ লখিন্দর–কে থাকে বাহার ? বাহার থাকে বিষহরি মায়ী আর তার সন্তানেরা। হামি বিষহরির সন্তান, বিষহার মায়ী যেমন দুনিয়ার পাপ-তাপ জ্বালা-যাতনার বিষ নিজের ভিতর ধরে রাখে আর নিজে নিজে জ্বলে, হামারও আমন। হামিও বিষ ধরে রাখি আর জ্বলি। বুঝে দেখ, সওদাগরের বেটা লখিন্দর-গহমা হামার ভাই, আলাদ হামার ভাই, বোরাও হামার ভাই—হামরা সবাই বিষ ধরে রাখি—তাতে দুনিয়াটা শান্তিতে থাকে। কিন্তুক যুদিন হামার শান্তি না থাকে, হামাক যদি মারে ফালাবা চাহেন—তেখুন? মাহাজন বুঝে দেখ, তেখুন হামার আর উপায় নাই—হামরা তেখুন দংশাই।
লক্ষ্মীকান্ত দেখছিলেন লোকটাকে। ভারি স্নিগ্ধ আর কোমল একটি ভাব ধরা পড়েছে এখন তার ভঙ্গিটিতে। মনে হচ্ছিল, একহাত ওপরে তুলে কোনো গায়েন যেন পালাগান গাইছে। লক্ষ্মীকান্তের মনে হতে লাগল—এ একরকমের পালাগানই—যে পালাগানে ভদ্রমানুষ চাঁদ সওদাগরের দাম নাই, লখিন্দরের দাম নাই, বেহুলার দাম নাই শুধু মনসার গুণগান। বললেন, গুপীনাথ আমিও তো মা-মনসার পূজা করি, কিন্তু কই, আমি তো মনে করি না সাপখোপেরা আমার ভাই বন্ধু।
মনে করিস না, না? গুপীনাথ হাসে আর মাথা দোলায়। বলে, না বাবু মসয়, উট মিছা কথা—ওই পূজাটা তোর মিছা। মনসার পূজা তোরা করিস না। চান্দো সদাগর যেমন বাঁও হাতের আঙ্গুল দে’ পূজা দিছিল, তোর পূজা ওইরকম। কহ দেখি, দেবীপূজা যেমন করে করিস, অমন করে কি বিষহরি মায়ীর পূজা করিস?
আহা তা কেন করব, লক্ষ্মীকান্ত বোঝাতে চেষ্টা করেন। বলেন, বড় ছোট থাকবে না ? মা আর মেয়ে এক হল? মানীর মান বেশি হবে না?
গুপীনাথ মাথা দোলায়, না হে লখিন্দর, সি নহে, মাও বিটির কথা নহে। দেওতা হইল দেওতা। কিন্তুক বিষহরি মায়ীক দেওতা মানিবা চাহে নাই কেহ। বুঝে দেখ বাবু মসয়। জনমের পর হামার বিষহরি মায়ীক বাড়িত নিয়ে গেল মাহাদেব শিবোনাথ। কিন্তুক দেবীমায়ী উমহাক মারিল ক্যানে, কহ? দেবী মায়ী জগতের খবর রাখে আর ওই খবরটা রাখিবা পারে নাই যে বিষহরির জনমটা ক্যামনে হইল, কুষ্ঠে হইল, ক্যানে হইল? আর মায়াদয়া নাই কনে, অ্যা? মারতে মারতে মায়ের হামার চোখটা কানা করে দিলে? ই কুনদেশি বিচার কহ? ইটা কি দেওতা ভগমানের কাম? অমন মার দিলে, কিন্তুক কুনো দেওতা আগাইল নাই। ক্যানে আগাইল নাই বিচার কর ইবার? উ যে মাটির সন্তান, সেই তানে, না ? সব দেওতার পূজা আছে, কিন্তুক মা বিষহরি পাবে নাই—কহ ই কেমন বিচার? বিষহরি মায়ীক ঘরের বাহার করে দিলে। মায়ের তেখুন কী কষ্ট—আহা রে, কেহ নাই, মায়ের সোয়ামি নাই, সন্তান নাই, মা-বাবা নাই। সঙ্গী হইল ধূপীর বেটি নেতা। মা বিষহরি এখুন কুনুঠে যায়? কারঠে যায়? চিন্তা করে দেখ মহাজন। মাটির সন্তান বিষহরি মায়ী গেল মাটির সন্তানের বগলত। ছোট জাতের মানুষ হইল বিষহরি মায়ীর সন্তান। এই কথাটা হিসাব করে বুঝিস লখিন্দর, চান্দো সদাগর কে—আর বিষহরি মায়ী কে? ই তোর মানুষ আর দেওতার নাঢ়াই নহে বাবু মসয়ই হইল গরিব আর ধনীর নাঢ়াই। জিরাত নাই—আর তুই হইলো ধনী চান্দো সদাগরের সন্তান। তোর সব আছে। হিসাব করে দেখ বাবু মসয়, কথাটা হামার ঠিক কি না।
দেখতে দেখতে অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠল চারদিকে। ঝুলন্ত বাতিটার নিশানা পর্যন্ত চোখের সামনে থেকে মুছে গেল। গুপীনাথ শুয়ে, না বসে—ঘুমিয়ে, না জেগে–কিছুই বোঝা যায় না
লক্ষ্মীকান্ত শুনছিলেন। লোকটা একই ভাবে অনেকক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছে আর ভারী ভাঙা ভাঙা জংলি স্বরে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। তার মনে হয়েছিল বোধহয় অসংলগ্ন প্রলাপ | কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তা নয়। তার অসংলগ্নতার ভেতরে ভেতরে ভারি সূক্ষ্ম এবং শক্ত একটি যোগসূত্র রয়েছে। কোথাকার জিনিশ কোথায় এনে ফেলল। কিন্তু যোগাযোগটা ঠিক বোঝা যায়। গোটা প্রসঙ্গটা হালকা করার জন্য হাসতে হাসতে বললেন, এ কিন্তু ভালো পালাগান হবে গুপীনাথ। তুই বাপু গায়েন হয়ে এবার বিষহরির পালা বাঁধ্।
চোপ, গুপীনাথ হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠল। এবারও বোঝা গেল না কাকে সে ধমক দিল । লক্ষ্মীকান্ত আন্দাজ করলেন গুপীনাথকে লোকে যে পাগল বলে, তা বোধহয় এই কারণেই—যখন-তখন এই বেমক্কা চিৎকার করে দেওয়া ধমকটাই ওর পাগলামি। হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে গুপীনাথ-গুনিন এবার গুপীনাথ-গায়েন হবে, কী বলিস?
না হে সওদাগরের বেটা, হামি গাওনা করি না, হামি মন্তর পঢ়ি । যে মন্তরে সাপের রাগ ঠান্ডা হয়, সেই মন্তর হামার। বিষটা তো আর কিছু নহে, বিষ হইল রাগ। রাগ হইলেই সাপ দংশায়। হামার মন্তর রাগ থামায়, ফির রাগ জাগায়।
আচ্ছা গুপীনাথ, বহুত হয়েছে বাপ–এবার একটু ঘুমোতে দে, লক্ষ্মীকান্ত হাই তুললেন এবার। বললেন, তুই ঘুমো, আমিও ঘুমোই।
গুপীনাথ জোরে হাসে হো হো করে। বলে, এক কথা ঘুরে ঘুরে কহিবা ভালো লাগে না মাহাজন, নিন্দ হামার আসে না, রাইতে হামার নিন্দ হয় না কুনোদিন। কহ ইবার, আসল কথাটা—এই মাল গিলা তুই লিবো কি না?
এ তো মহাজ্বালা, লক্ষ্মীকান্ত দেখলেন, ভবি কিছুতেই ভুলছে না। বললেন, ঠিক আছে বাপ, নেব তোর মাল, কাল সকালেই নিয়ে নেব, কথা দিলাম।
গুপীনাথ হাসে, তোর কথার কুনো ঠিক নাই বাবু মসয়, সদাগরের কথা আর ব্যাঙের মাথা–তুই টাকা দে।
লক্ষ্মীকান্ত দুখানা দশ টাকার নোট এগিয়ে ধরলেন—এই নে, এবার গিয়ে বসে থাক চুপচাপ, আর দিক করিস না।
গুপীনাথ নোট দুখানা হাত বাড়িয়ে নেয়। বলে, লখিন্দর হে। তু বড়া ভালো সদাগর। মায়ী বিষহরি তোর ভালো করবে।
টাকাটা কোমরে গুজে সে আবার হাসে। বলে, হামার পুরানা হিসাবটা কর ইবার।
লক্ষ্মীকান্ত আর পারলেন না। এবার ধমকে উঠলেন। কিসের হিসেব ? আমার কাছে টাকা চাইলেই পাবে, অ্যা? এইমাত্র টাকা দিলাম, এখনই ফের হিসেব?
চোপ, গুপীনাথও ধমকে ওঠে।
লক্ষ্মীকান্ত এতক্ষণ উপেক্ষা করছিলেন এবার আর পারলেন না। বললেন, কাকে ধমকাস তুই গুপীনাথ? তুই আমাকে ধমক দিতে চাস? আমাকে—
না না সদাগরের বেটা। তোক কি হামরা ধমক দিবা পারি ? তুই কেমনু লোহার ঘরত বাস করিস, বাহার দিক লোকের পহরা, কত গুনিন, কত মাহাত জড়িবুটি লিয়ে ঘুরে বেড়াছে। তোক হামরা ধমক দিমো, এমন ক্ষমতা হামার—ছি!
গুপীনাথের গলার স্বর বদলে যেতে থাকে। বলে, হিসাবটা যে বহুত দিনের লখিন্দর। কতদিন আর ঘুরে ঘুরে যামো হামরা সান্তালী পাহাড়ত হামার দাদা, পরদাদার বাস ছিল। কালিনাগের রক্ত হামার শরীলে বহে যাছে। কতকালের পুরানা হিসাব, ফম করে দেখ তুই। কত আকাল গেল, ব্যারাম গেল, বানবরিষা গেল—কিন্তুক হামরা খোরাকি পাই নাই। সদাগরের বেটা, সেই হিসাবটা ইবার দিবা হবে।
রাগে না লোকটা—রক্তাক্ত মেঝেতে ছায়া ফেলে ভারি ধীর স্বরে কথা বলে যেতে থাকে। ছায়াটা একেবার ডাইনে-বায়ে দোলে। মনে হয়, যেন প্রকাণ্ড একটা ফণা-তোলা সাপ ছোবল দেওয়ার আগের মুহুর্তে ডাইনে-বায়ে দুলছে। হিসেবের কথা শুনে লক্ষ্মীকান্ত প্রায় কাতরে ওঠেন। বলেন, বাপ, তোর হিসেব তো আমি বুঝতে পারছি না।
চিন্তা করে দেখ। চিন্তা করলেই হিসাবটা বুঝিবো। গুপীনাথ বলতে বলতে ফের যেন দোল খায়। বলে, আকালের সময় কত চাউল তুই হিসাবটা, তারপর ফের গহমের হিসাবটা। এইরকম করে করতে থাক হিসাবটা।
বাপ, আমি তো ওপারের লোক, এদিকের আকাল হলে আমি কেন দায়ী হব ?
গুপীনাথ এবার হাসে, ইপার উপার হামি বুঝি না—এইপার হামরা দুই ভাই তো ওইপার হামরা চার ভাই! আর ইপারের কসিমুদিনটা কে? তোরই সাগরিদ নয়? কহ, লখিন্দর বাবু হামার, কহ কসিমুদ্দিন তোর সাগরিদ কিনা? যদু রায় কার সাগরিদ?
গুপীনাথ ঝুঁকে পড়ে ওইসময় কিছুটা। বুকে বোধহয় লক্ষ্মীকান্তকে ভালো করে দেখে নিতে চায়—ওইসময় সে আবার ডাইনে বায়ে একটু একটু দোলে! লক্ষ্মীকান্ত কী দেখেন, তিনিই জানেন—ভয়ানক জোরে চিৎকার করে ওঠেন হঠাৎ ৷ বলেন, আসবি না, কাছে আসবি না, খবরদার!
গুপীনাথ পিছিয়ে আসে। বলে, ডরাইস না লখিন্দর। হামি তো মানুষ। সাপ নহওঁ। দংশামো ক্যামনে হামি—তুই হিসাবটা মিটা এইবার। পরথমে মোর দুইশ’ খালের টাকা বাহার ক্।
লক্ষ্মীকান্ত গুপীনাথের চোখমুখের দিকে আর তাকাতে পারেন না। অজানা একটা ভয় মনের খুব ভেতরে কোথায় যেন শিরশির করে ওঠে। বলেন,—বাপ তোর পায়ে পড়ি—আমার কাছে টাকা নেই এখন, ওপারে চল্, আমার গদিতে। পাই পয়সাটা পর্যন্ত বুঝিয়ে দেব।
গুপীনাথ হাসে। বলে, লখিন্দর তোর হিসাব তোরঠে আর হামার হিসাব হামারঠে। তুই কী করবো সে হামি জানি। ইবার দুইজন নেপালী দাজু হামাক ঘাড় ধাক্কা দে খেদাবে—হা, সি হামি বুঝি। হিসাবটা তুই এইঠে মিটায় দে।
বাবা, বুঝতে চেষ্টা কর, আমি কেমন করে পয়সা দেব এখান থেকে ? এখানে তো আমার টাকাপয়সা নেই।
ওদিকে লণ্ঠনের আলো স্নান হয়ে এসেছে। সম্ভবত তেল নেই। লক্ষ্মীকান্ত কাতর আর্তনাদ করে ওঠেন। বাবা গুপীনাথ, বাতিটাকে তেল দে বাপ—অন্ধকারে থাকলে আমার ভয় করে।
লখিন্দর, হামরা কিন্তু অন্ধকারে থাকি। আন্ধারে জনম, আন্ধারে বাঁচন, আন্ধারে মরণ গুপীনাথ হাসতে হাসতে এবার বসে পড়ে।
লষ্ঠনের শিখা ওদিকে ছোট হয়ে আসে আর গুপীনাথ বলতে থাকে, লখিন্দর শুনে রাখ। ইবার হামি নিন্দামো, এক চোখ হামার নিন্দাবে, অন্য চোখ থাকবে সজাগ। বিষহরি মায়ীর এক চোখ, সেই চোখটা হামি আর যে চোখ কানা, সিটা হইল হামার ভাই কালি গহমা। কালি গহমার বস্তার মুখ হামি খুলে দিনো। হামার হিসাবটা মিটায় দে তুই।
দেখতে দেখতে অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠল চারদিকে। ঝুলন্ত বাতিটার নিশানা পর্যন্ত চোখের সামনে থেকে মুছে গেল। গুপীনাথ শুয়ে, না বসে—ঘুমিয়ে, না জেগে–কিছুই বোঝা যায় না। খানিক পর লক্ষ্মীকান্ত একবার সরে বসতে চেষ্টা করলেন। আর তাতেই ভয়ানক শব্দে ফুসে উঠল একটা সাপ। সেটা নির্বিষ গোসাপ—না বস্তা থেকে সদ্য ছেড়ে দেওয়া গুপীনাথের সেই কালিগহমা—লক্ষ্মীকান্ত বুঝতে পারলেন না। তার চারদিকে অন্ধকার এবং ওই অন্ধকারের ভেতরে হিংস্র কালিগহমা নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল।