• শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৮২ রানে অল–আউট বাংলাদেশ
• নিজেদের নবম সর্বনিম্ন স্কোর গড়লো বাংলাদেশ
স্বপ্নের মতো শুরু করা সিরিজের শেষ পথে এসে লজ্জায় লাল হলো বাংলাদেশ। রকেট ত্রিদেশীয় সিরিজের গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৮২ তে অল–আউট টাইগাররা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে গর্বের সব রেকর্ড করা বাংলাদেশ এবারো ম্যাচ শেষ করলো রেকর্ড দিয়েই। তবে এবার আর গর্ব করার মতো কিছু না, নিজেদের নবম সর্বনিম্ন রানের স্কোরটা নতুন করে লিখিয়ে। ৮৩ রানের টার্গেট মাত্র ১১ দশমিক ৫ ওভারেই টপকে গিয়েছে লঙ্কানরা। ললাটে জুটলো দশ উইকেটের বিশাল পরাজয়।
বিপর্যের শুরু
দীর্ঘদিন পর দলে ফেরা এনামুলের আরো একবার ব্যর্থতায় ইনিংসের শুরুতেই পথ হারায় বাংলাদেশ। আগের ম্যাচে ১ রান করা এনামুল এবার বিদায় নিয়েছেন রানের খাতা খোলার আগেই লাকমালের বলে বোল্ড হয়ে। সিরিজে চলে আসা চিত্রনাট্যানুযায়ী আশা করা হচ্ছিলো এবারো বোধয় তামিম–সাকিবেই সামলে উঠবে বাংলাদেশ। কিন্তু সে অনুমানকে ভুল প্রমাণ করে ঝুকিপূর্ণ একটি রান নিতে গিয়ে গুনাথিলাকের সরাসরি থ্রোতে রান আউট হয়ে ড্রেসিংরুমের পথ ধরেন সাকিব। অবাক করার মতো ছিলো তার শরীরের ভাষাটা। ক্রিজে পৌছানোর চেষ্টা না করে অনেক আগেই যেভাবে হাল ছাড়লেন সেটি আর যাই হোক সাকিবের সাথে বেমানান। এরপর সিরিজে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান তামিম ইকবালও টিকেননি বেশিক্ষণ। লাকমালের লাফিয়ে উঠা বলে গুনাথিলাকার চমৎকার একটি ক্যাচ হয়ে বিদায় নেন তিনি। মাত্র ৪ দশমিক ৫ ওভারে ১৬ রানেই তিন উইকেট হারিয়ে শুরু হয় দুঃস্বপ্নের দিন।
ভুল থেকে শিখলেন না কেউই
গত ম্যাচে মিডল অর্ডারে যে অস্থিরতা দেখা গিয়েছিলো একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটলো এই ম্যাচেও। তবে সেদিন ব্যাটসম্যানদের রক্ষাকবচ ছিলো দ্রুত রান তোলার তাড়নাটা। এ ম্যাচের পরিস্থিতি ছিলো সম্পুর্ণই ভিন্ন। দ্রুতই তিন উইকেট হারিয়ে যখন চাপে দল তখন মিডল অর্ডারের ব্যাটম্যানদের কাছে প্রত্যাশা ছিলো ক্রিজে টিকে থাকাটা। সেটি তো কেউ করেনই নি, উল্টো কে কতটা সহজে উইকেট দিয়ে আসতে পারেন তার এক প্রতিযোগিতা যেন প্রত্যক্ষ করলো মিরপুর। লাকমালের শর্ট বলে আলতো করে ব্যাট ছুইয়ে নিজের উইকেটটা উপহার দিয়ে আসেন মাহমুদুল্লাহ। একে একে তার দেখানো পথে হাটেন সাব্বির, মুশফিক, নাসিররা। এদের মধ্যে এক মুশফিকই যা একটু প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
কি যাদু ড্রেসিংরুংমে!
ব্যাটসম্যানদের আসা–যাওয়ার মিছিল দেখে একটা সময় মনে হচ্ছিলো দ্রুত ড্রেসিং রুমে ফিরতে পারলে বোধহয় কোনো পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে বিসিবি ! সাব্বির, আবুল, নাসির, মাশরাফি এবং রুবেল মিলে খেলেছেন মাত্র ৩৮ বল! আশ্চর্য শোনালেও এটিই ঘটেছে আজকে। আরো বিস্ময়কর বিষয় হলো ২২ ওভার ৩ বল থেকে ২৪ ওভার; এই সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ ৩ রানেই হারিয়েছে শেষ চার উইকেট!
টেলিফোন নম্বর নাকি স্কোরকার্ড?
মুশফিক আর সাব্বিরকে আলাদা করে রাখলে আপনার মনে হতে পারে আপনি কোনো দলের স্কোর কার্ড না, বরং কোনো দেশের টেলিফোন নম্বর মেলাচ্ছেন। তামিম, এনামুল, সাকিব, মাহমুদুল্লাহ, আবুল, নাসির, মাশরাফি, রুবেল এবং মোস্তাফিজের রান যথাক্রমে; ৫, ০, ৮, ৭, ৭, ৩, ১, ০, ১*
পিচ বুঝতে ভুল নাকি আত্মহত্যা?
স্কোরকার্ড দেখে আপনার যদি মনে হয় মিরপুর আচমকাই বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিলো দোষ দেবার কিছু নেই। এবং বাংলাদেশ দল এই পিচে কেনো টসে জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নিলো সে প্রশ্নটি উঠাও স্বাভাবিক। কিন্তু এ স্বাভাবিক কথাটাই অস্বাভাবিক ঠেকবে যদি আপনি বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানদের আউট হবার ধরণগুলো দেখে থাকেন। এটা সত্য যে পিচে বল চমৎকার সুইং করেছে, বাউন্সও ছিলো বেশ ভালো। কিন্তু তার কোনো জবাবই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা দিতে পারবে না এটা অস্বাভাবিক। এনামুলের সেই পুরোনো সমস্যা, জায়গা দাড়িয়ে শট খেলার প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে এ ম্যাচেও। আর সেটি করতে গিয়েই উইকেটে বল টেনে এনে বোল্ড হয়েছেন। রিয়াদ, সাব্বির, মুশফিক, মাশরাফি বা রুবেলদের আউটে যতটা কৃতিত্ব বোলারদের তার চেয়ে বেশী দায় নিজেদের। নাসির তো শট খেলবেন নাকি ছাড়বেন সে দ্বিধাতেই উইকেট কিপারের গ্লাভসে বল জমা দিয়ে ফিরলেন। সুতারাং, পিচের ওপর দায় চাপানোর বা টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ এ ম্যাচে অন্তত নেই।
অসহায় বোলাররা
গত ম্যাচের স্বল্প পুজিতে জিম্বাবুয়েকে আটকে রেখে বোলাররা ম্যাচ জিতালেও আমরা বলেছিলাম এরকম পুজিতে বড় দলের বিপক্ষে পার পাওয়া যাবে না। এ ম্যাচে স্কোর বোর্ডে যে রান জমা ছিলো, তা নিয়ে লড়াই করার আশাটাও এক প্রকার বিলাসিতা। সুতরাং, মাত্র ১২ ওভারেই খেলা শেষ হয়ে যাওয়া জন্য বোলারদের দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই। এ রকম রান তাড়া করতে নেমে কোনো পেশাদার দল আত্মসমর্পণ করার নজির খুব কম। লঙ্কানরাও তাই কোনো সুযোগ না দিয়ে শুরু থেকেই চওড়া ছিলেন বাংলাদেশের বোলারদের উপর। মাশরাফি, সাকিব, মোস্তাফিজদের কেউই পাত্তা পাননি গুনাথিলাকে এবং থারাঙ্গার কাছে।
আবুল নাকি সাইফুদ্দিন?
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আগের ম্যাচে বাংলাদেশ নেমেছিলো তরুণ পেসার সাইফুদ্দিনকে নিয়ে। বাকি বোলারদের দারুণ নৈপুণ্যের কারণে সাইফুদ্দিন সেদিন সুযোগ পাননি কিছু করে দেখানোর। তাই, এ ম্যাচে সাইফুদ্দিনের জায়গায় আবুলের অন্তর্ভুক্তি যতটা তার সাইফুদ্দিনের ব্যার্থতার জন্য তারচেয়ে বেশি ছিলো দলের বাকিদের বাজিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত। স্কোর বোর্ডে এ রান নিয়ে আবুল অস্বাভাবিক কিছু করে দেখাবেন এমনটা কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না। তাই, নৈপুণ্য বিচার করে পরবর্তী ম্যাচে এদের মধ্য থেকে কাউকে বেছে নেয়াটা কঠিনই হবে টিম ম্যানেজম্যান্টের জন্য।
উদাস বিসিবি
বিপিএল এর পঞ্চম আসরে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলো বিসিবি। তার মধ্যে অন্যতম ছিলো খেলা প্রচারকারী চ্যানেলের মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন এবং নিম্নমানের ধারাভাষ্য। চলতি রকেট ত্রিদেশীয় সিরিজেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ দর্শকরা। বিশেষ করে কোনো ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার সাথে সাথেই বিজ্ঞাপন সম্প্রচার হচ্ছে। নিম্নমানের ধারাভাষ্যের অভিযোগও উঠেছে এ সিরিজে। এ ম্যাচেই একটি ওভারে ওয়াইড সহ চার রান দেয়ার পরেও বাংলাদেশের এক ভাষ্যকার সে ওভারটিকে উল্লেখ করেছেন উইকেট মেডেন হিসেবে। এর জন্য পরবর্তীতে ভুলও স্বীকার করেন তিনি। এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল নাকি অজ্ঞতা; এই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। কারণ, এর আগেও বহুবার তাকে এমন ভুল করতে দেখা গিয়েছে।
যে শিক্ষা পেলো বাংলাদেশ
এটা সত্য যে, বর্তমান শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের মধ্যে তুলনামূলক শক্তিশালী বাংলাদেশই। এ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে আগের ম্যাচগুলোতেই। কিন্তু লঙ্কানদের ক্রিকেট ঐতিহ্য রয়েছে; দলটিতেও রয়েছে বেশ কিছু প্রতিভাবান খেলোয়াড়। পুরোনোদের মধ্যে থিসারা পেরেরা, চান্দিমাল এবং থারাঙ্গা নিয়মিতই রাখছেন দারুণ ভুমিকা। বিশেষ করে চলতি সিরিজে থিসারা রয়েছেন দারুণ ছন্দে। ফাইনালেও যদি ব্যাটসম্যানরা এমন আত্নহত্যার মিছিলে যোগ দেন তাহলে বছরে শুরুটা যে হতাশা দিয়েই হবে তা বলা বাহুল্য। আশার জায়গা হচ্ছে দলের মূল খেলোয়াড়দের প্রায় সবাই রয়েছেন দারুন ছন্দে। বাংলাদেশ যে সত্যিই একটি দারুন দল হয়ে উঠছে, সেটি প্রমাণ করতে হলে এবার শুধু দক্ষতা না, দেখাতে হবে মানসিক শক্তিও। এমন বিপর্যয়ে ঠিক পরের ম্যাচেই ফিরে আসাটা বেশ কঠিন, বিশেষ করে ম্যাচটি যদি হয় ফাইনাল।