রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কেন সহজ হবে না

শারমেইন মোহামেদ’র কলাম

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কেন সহজ হবে না

প্রশ্নটা আমার খুব সাধারণই ছিল, কিন্তু সেটির উত্তর দিতে গিয়ে পঞ্চাশোর্ধ মাইমুনার চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। বাংলাদেশের কুতুপালং ক্যাম্পে আমাদের মধ্যকার আলাপ চলছিল প্রায় আধাঘন্টার মত। আমি কেবল তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে বাড়ি ফিরে যেতে চায় কিনা। আর উত্তরে মাইমুনা তার ওড়নায় মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাদতে শুরু করল।

সে বলল, “আমি জানিনা, এখন এটা তো আল্লাহর উপর। কিন্তু মায়ানমারে শান্তি এলেই আমি সেখানে ফিরে যেতে চাই।”

তিনমাস হতে চলল, অথচ মাইমুনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আগের চেয়ে আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। গত সপ্তাহে মায়ানমার এবং বাংলাদেশ সরকার সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দুই বছরের মধ্যে ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম কিছুটা এগিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে। গত বছর মায়ানমারের সেনাবাহিনী গণহত্যা চালালে তারা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। গত সোমবার বাংলাদেশ জানায়, ‘প্রস্তুতির’ অভাবে এই ফেরত পাঠানোর কার্যক্রমে কিছুটা বিলম্ব হবে। কিন্তু যে আলাপটি এতে ঢাকা পড়ে যায় সেটা হল, এই ফেরত-কার্যক্রম বিষয়ে আলোচনার সময়ে খোদ রোহিঙ্গাদের কোন অভিমত বা বক্তব্য নেওয়া হয়নি।

এই প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের আওতায় স্বেচ্ছায় সবাই মায়ানমারে মানসম্মানের সাথে ফিরে যেতে কোনো আইনী সংকট নেই। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রতি মায়ানমারের নীতি পরিবর্তন না হলে এটি কিভাবে সম্ভব হবে সেটা বোঝা কঠিন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেদেশের সেনাবাহিনীর সংগঠিত হত্যা-রাহাজানি এবং তারপর তা অস্বীকার করে, নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের পর এটা এখন বিশ্বাস করা কঠিন যে মায়ানমারের অবস্থা সহসাই বদলাবে। হাজারের বেশি রোহিঙ্গা হত্যা করে সেনাবাহিনি মাত্র ১০জনকে হত্যার কথা স্বীকার করছে এবং এখনো অত্যাচারিত-হত্যাকৃত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে।

এসব মাথায় রেখে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার প্রশ্ন এখন অনেকটাই দুর্বিষহ এবং আবারও এটা তাদের জাতিবিদ্বেষের মুখোমুখি দাড় করাবে। ফিরিয়ে নেওয়ার সেই চুক্তিও সেরকমটাই আভাস দিচ্ছে। যেমন; এই চুক্তি বলছে যেকোন দাবিতে রোহিঙ্গাদের আন্দোলন অবশ্যই মায়ানমারের “বিদ্যমান আইন ও বিধি” অনুযায়ী হতে হবে। অন্যভাবে বললে, তারপর সবকিছু আগের মতই চলবে, রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যও থাকবে, থাকবে দরিদ্র-জেলাগুলোতে বিভেদ এমনকি দেশের বাইরে যেতে বাধাও।

তারা আসলে সবার কাছেই অনাকাঙ্ক্ষিত, হোক সেটা মায়ানমারে বা অন্য দেশে। অতঃপর তাদের কোন চাওয়া পাওয়াকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মতো করে প্রত্যাবাসন চুক্তির খসড়া তৈরি করার মধ্য দিয়ে সেই বার্তাই আবার তাদের কাছে যাচ্ছে। হয়ত তাদের ভাগ্যে সেরকমটাই ছিল

 

এই কারণে এসব ক্ষেত্রে শরনার্থীদের চাওয়া-পাওয়া শোনাটা বেশ জরুরি। গত শুক্রবার মাইমুনার ক্যাম্পে কিছু রোহিঙ্গা রয়টার্সের এক সাংবাদিককে একটা পিটিশনের খসড়া দেখিয়েছে। সেখানে তারা পূনর্বাসনের আগে কি কি চায় তার একটা তালিকা করা আছে। সেই পিটিশনে দাবি-আকারে আছে, নাগরিকত্বের সাথে তারা যেন তাদের নিজেদের বাড়িঘর ফিরে পায় এবং সেনাবাহিনীকে তার কর্মকান্ডের জন্যে যথাযথ জবাবদিহিতার অধীনে আনা হয়। এমনকি কিছুদিন ধরে তারা ক্যাম্পের ভেতরে নানা ব্যানার হাতে বিক্ষোভ করছে যাতে প্রত্যাবাসনের আগে যেন তারা তাদের অধিকার-সম্মানের নিশ্চয়তা পায়। এসব ব্যাপারগুলো প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের জন্যে যতটা জরুরি, দিন-তারিখ ততটা নয়।

কারণ মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের অনেকের বসতবাড়ি এখন আর নেই। দুই-দেশের সরকার তাদের নিজেদের দেশে প্রবেশ এবং অভ্যর্থনা ক্যাম্প স্থাপন করার প্রস্তাব করেছে। তার উপর ২০১২ সাল থেকে ১ লাখ ২০ হাজারের মত রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যের কিছু ‘অস্থায়ী’ ক্যাম্পে অবস্থান করছে। ফলে এই ফিরে যাওয়াদের ক্ষেত্রে মায়ানমারে ঢোকাটা আরো বেশি কালক্ষেপনের কারণ হবে।

তাড়াহুড়োর দরকার কী?

বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলির একটি। সেখানে প্রায় দশ লাখ শরণার্থীর সাথে নতুন করে অতি সম্প্রতি প্রায় লাখ খানেকের উপস্থিতি মিলিয়ে সেদেশের বিদ্যমান সেবাব্যবস্থা এবং অবকাঠামো বেকায়দায় পড়েছে। এই সমস্যার কোন আপাত সমাধান না হওয়ায় এখন এটি একটি বৈশ্বিক সংকট হয়ে দাড়িয়েছে।

গত বছরের ২৩শে অক্টোবর, জেনেভার গুরুত্ববহ এক সম্মেলনে মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের জন্যে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করা হলে যথেষ্ট অর্থ সংগ্রহ ব্যর্থ হয়। ফলে সেই অর্থ থেকে কেবল রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য-আশ্রয় চাহিদা পূরণ হবে, তাও সেটা মাত্র ছয় মাসের জন্য। ফলে তা দিয়ে বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত কোন সাহায্য দেওয়া যাবে না। যে কারণে অল্প দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ আবার নতুন সংকটে পড়বে। অন্যান্য দেশকে তাই আশ্রিতদের পক্ষে বাংলাদেশের পাশে এসে দাড়াতে হবে, অর্থ দিয়ে বা যেকোন ভাবে।

রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সমাজের অসহানুভূতিশীল আচরণ নতুন কিছু নয়। ২০১৫ সালে হাজার খানেক ভাসমান রোহিঙ্গাকে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হলে তারা কয়েকমাস আন্দামান দ্বীপে আশ্রয় নেয়। গত সেপ্টেম্বরে যখন মায়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার তুঙ্গে, তখন অষ্ট্রেলিয়ার মেনাস দ্বীপ থেকে ঘুষ দিয়ে রোহিঙ্গাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করা হয়।

ফলে বারবার একটি বার্তাই রোহিঙ্গারা পায় সেটি হল তারা আসলে সবার কাছেই অনাকাঙ্ক্ষিত, হোক সেটা মায়ানমারে বা অন্য দেশে। অতঃপর তাদের কোন চাওয়া পাওয়াকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মতো করে প্রত্যাবাসন চুক্তির খসড়া তৈরি করার মধ্য দিয়ে সেই বার্তাই আবার তাদের কাছে যাচ্ছে। হয়ত তাদের ভাগ্যে সেরকমটাই ছিল।

মায়ানমারে অক্ষত ফিরে যাওয়ার সর্বময় অধিকার রোহিঙ্গাদের আছে। এই চুক্তির অধীনে যে কেউ ইচ্ছা হলেই মায়ানমারে ফিরে যেতে পারবে। এধরনের প্রত্যাবর্তনে দুদেশের যথাযথ সহায়তা জরুরি। এবং বিশেষ করে মায়ানমারে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এই রাষ্ট্র-আয়োজিত প্রত্যাবর্তনের আগে মায়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মনোভাবে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের প্রতি জাতিবিদ্বেষ বন্ধ করতে হবে। নিরাপত্তাবাহিনীর সব অপরাধের যথাযথ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

এসব নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এই ধরনের প্রত্যাবর্তনকে স্বতস্ফূর্ত প্রত্যাবর্তন হিসেবে মানা যাবে না। এক্ষেত্রে মাইমুনা সহজে তার চাওয়াটা বলল, “যদি সরকার আমাদের মায়ানমারে নিতে না চায়, আমি সেখানে আর ফিরে যেতে চাই না।”


লেখক: শারমেইন মোহামেদ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের শরনার্থী ও অভিবাসন অধিকার বিষয়ক প্রধান। লেখাটি আলজাজিরা ইংরেজি ভার্শনের মতামত বিভাগে প্রকাশিত হয়।

১ thought on “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কেন সহজ হবে না

কমেন্ট বন্ধ।