প্রায় সময়ই দলের সবার জার্সির রং ডিজাইন একই রকম হওয়ার কারণে গ্যালারিতে থাকা দর্শকদের কাছে খেলোয়াড়দের চেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। শুধু দর্শক নয়, খেলা পরিচালনাকারী, কোচ সবার জন্যই দূর থেকে চেহারা দেখে খেলোয়াড়ের পরিচয় নির্ণয় করাটা প্রায় দুঃসাধ্যকর কাজ। সেই সমস্যার সমাধানের জন্যই শুরু হয় জার্সিতে নাম্বার ব্যবহারের রীতি। নাম্বার ব্যবহারের প্রথম প্রচলন ঘটে ১৮৮৭ সালে ১৭ জুলাই কুইন্সল্যান্ড -নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার রাগবি ম্যাচের মধ্য দিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় জার্সিতে নাম্বারের ব্যবহার শুরু হয় ফুটবল, বাস্কেটবল, বেসবল, হ্যান্ডবল, ক্রিকেট, সাইক্লিং, কার রেসিং, আ্যাথলেটিকসহ প্রতিযোগিতামূলক খেলাগুলোতে।
জার্সি নাম্বারের উৎপত্তি বা জন্মলগ্ন
শুরুতে দলীয় খেলায় দুই দলের খেলোয়াড়দের পৃথক করার জন্য নির্ধারিত জার্সি পরা বাধ্যতমূলক করা হয়। প্রথম দিকে এটি সফল এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত মনে হলেও আলাদা করে কোনো খেলোয়াড়কে চিনতে না পারা বিশাল বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। দলের সকলের জার্সি এক রকম হওয়ার কারণে কোনো খেলোয়াড়কে নির্দিষ্ট করে চেনা সম্ভব হচ্ছিলো না। তখন রাগবি খেলায় প্রথম জার্সি নাম্বার ব্যবহার করে এ সমস্যার সমাধান করা হয়। ১৮৮৭ সালে তাদের এই অবিষ্কৃত পদ্ধতিটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
* তার সূত্র ধরেই ১৯০৩ সালে “অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবল”(AFL) জার্সিতে নাম্বার ব্যবহার শুরু করে।
* ১৯১১ সালে ফুটবলে জার্সি নাম্বার ব্যবহারের প্রথম ব্যবহার হয়।
ফুটবল জগতে জার্সি নাম্বারের ইতিহাস
বর্তমান বিশ্বসহ আমাদের দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। ফুটবলে জার্সি নাম্বার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জার্সি নাম্বার দেখে বলে দেয়া যায় কোন খেলোয়াড় কোন পজিশনে খেলে থাকেন।
* ১ নাম্বার জার্সি গোলকিপারের জন্য
* ২ থেকে ৬ নাম্বার জার্সি রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা ব্যবহার করেন এবং ৭ থেকে ১১ পর্যন্ত মাঝ মাঠ ও আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা ব্যবহার করে থাকেন।
১৯১১ সালে যখন ফুটবল জার্সিতে নাম্বার ব্যবহার শুরু করা হয় তখন ফুটবল নিয়ন্ত্রণকারীরা সিদ্ধান্ত নেন ১ থেকে ১১ নাম্বার পর্যন্ত জার্সি পরা খেলোয়াড়রা ম্যাচের মূল একাদশে থাকবে এবং বদলি যারা নামবে তাদের জার্সি নাম্বার ১১ এর বেশি হবে। তখন সেরা একাদশ সাজাতে গিয়ে প্রতি ম্যাচেই খেলোয়ারদের জার্সি নাম্বার বদলাতে দেখা যাচ্ছিলো।
পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপে ফিফা এ নিয়মে পরিবর্তন আনে। ১ থেকে ১১ নাম্বার জার্সি পরিহিতরা প্রথম একাদশে ম্যাচ শুরু করবেন আর বাকিদের জন্য বরাদ্দ থাকবে ১২ থেকে ২২ পর্যন্ত। এ নিয়ম অপরিবর্তত থেকে যায় অনেকদিন। ১৯৯৩ সালে ইংল্যান্ড ফুটবল নিয়ন্ত্রকরা ১ থেকে ১১ নাম্বার জার্সিতে ম্যাচের মূল একাদশ সাজানোর বাধ্যবাধকতা তুলে দেন। এবং ১৯৯৩-১৯৯৪ সালের প্রিমিয়ার লিগে এ নিয়মের প্রথম ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীতে ইউরোপের অন্য লিগগুলো এ নিয়ম অনুসরণ করা শুরু করে।
ফুটবলে ১১, ১০, ৭, ৯ এগুলো আক্রমণভাগের সেরা খেলোয়ারদের জার্সি নাম্বার বলে বিবেচনা করা হয়। তবে এর কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন ইংলিশ কিংবদন্তি জেভিড বেকহাম ২৩ নাম্বার জার্সিটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। এবং ক্লাব ভেদে জার্সি নাম্বারের গুরুত্বও আলাদা।
ক্রিকেট জগতে জার্সি নাম্বার ইতিহাস
ক্রিকেটে জার্সি নাম্বারের প্রচলন শুরু হয়ে অনেক পরে। ১৯৯৫-৯৬ সালে “ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপ” এ অষ্ট্রেলিয়া সর্বপ্রথম ক্রিকেটে জার্সি নাম্বার ব্যবহার শুরু করে। প্রথম দিকে ক্রিকেটাররা চাইলে প্রতি টুর্নামেন্ট শেষে জার্সি নাম্বার পরিবর্তন করতে পারতো কিন্তুু কয়েক বছর পরেই সিংহভাগ ক্রিকেটাররা তাদের পুরো ক্যারিয়ার নির্দিষ্ট একটি জার্সি নাম্বার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। তবে চাইলে যে কোনো সময় ক্রিকেটার বোর্ডের সাথে কথা বলে তার জার্সি নাম্বার বদলে নিতে পারেন। বিশ্বকাপে জার্সিতে নাম্বারের প্রচলন শুরু হয় ‘৯৯ এর বিশ্বকাপে। সে বিশ্বকাপে ১ নাম্বার জার্সিটি বরাদ্দ ছিলো অধিনায়কের জন্য এবং ২ থেকে ১৫ নাম্বার জার্সি স্কোয়াডের বাকি সদস্যরা ব্যবহার করতো। যদিও এর ব্যতিক্রম ঘটান তৎকালীন আফ্রিকান অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রোনিয়ে। ১ এর বদলে তিনি বেছে নেন ৫ নাম্বার জার্সি আর। ১ নাম্বার জার্সিটি গায়ে তুলেন ওপেনার গ্যারি কার্সস্টেন। কিছুদিন পর কিছু পরিবর্তনের সাথে ক্রিকেটাররাও ০ থেকে ৯৯ পর্যন্ত যে কোনো জার্সি নাম্বার ব্যবহারের স্বাধীনতা পেয়ে যান। ক্রিকেটে ৩ সংখ্যার জার্সি নাম্বারও ব্যবহৃত হতে দেখা গিয়েছে। যেমন, ক্রিস গেইল ৩৩৩, মুরালিধরন ৮০০।
অবসরপ্রাপ্ত জার্সি নাম্বার
প্রতিটি খেলোয়াড় অবসর নেয়ার মাধ্যমে তার পেশাদারি জীবনের ইতি টানেন। আর জার্সি নাম্বার তুলে রেখে কোনো ক্লাব বা দল তাদের সেরা খেলোয়াড়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। ফুটবলে খেলোয়াড়দের প্রতি সম্মান দেখাতে অনেক দলই তুলে রেখেছে সে খেলোয়াড়ের ব্যবহৃত জার্সি নাম্বার।
* নাপোলি তাদের ইতিহাসের সেরা ফুটবলার ম্যারাডোনার সম্মানে ১০ নাম্বার জার্সি আজীবনের জন্য তুলে রেখেছে।
* এসি মিলান পাওলো মালদিনির সম্মানে ৬ নাম্বার জার্সি তুলে রেখেছে। তবে মিলানের যুবা ক্লাবে তার দুই ছেলে ক্রিষ্টিয়ান বা ড্যানিয়াল চাইলে ভবিষ্যতে এই নাম্বার ব্যবহার করতে পারবে।
* ইন্টার মিলান জাভিয়ের জেনেত্তির সম্মানে ৪ নাম্বার জার্সিটি তুলে রেখেছে।
* আয়াক্স তাদের ইতিহাসের সেরা খেলোয়ার ক্রুফের সম্মানে ১৪ নাম্বার জার্সিটি তুলে রেখেছে।
* নিউইয়র্ক কসমস ক্লাব ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার পেলের সম্মানে ১০ নাম্বার জার্সিটি আজীবনের জন্য তুলে রেখেছে।
তাছাড়া বার্সার সাবেক ফুটবলার ও কোচ লুইস এনরিকের সম্মানে ২ বছর ২১ নাম্বার জার্সি তুলে রাখা হয়েছিলো। সালকে জিরো ফোর রাউলের সম্মানে ১ বছরের জন্য ৭ নাম্বার জার্সিটি তুলে রেখেছিলো। উল্লেখ্য, ম্যারাডোনাই ইতিহাসের একমাত্র ফুটবলার যার সম্মানে ক্লাব এবং জাতীয় উভয় দলই তার ব্যবহৃত ১০ নাম্বার জার্সিটিকে অবসরে পাঠিয়েছিলো। কিন্তু, ফিফার নিয়মের কারণে এএফএ তাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়। বর্তমানে আর্জেন্টিনার হয়ে ১০ নাম্বার পরে খেলেন ম্যারাডোনার যোগ্য উত্তরসরী লিওনেল মেসি।
ফুটবলে জার্সি নাম্বার অবসরের বা তুলে রাখার ঘটনাটি অনেক বেশি হলেও ক্রিকেটে এটি বিরল।
ক্রিকেট ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ২ টি জার্সি নাম্বার ক্রিকেটারদের সম্মানে তুলে রাখা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছেন অষ্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ফিলিপে হিউজ। ম্যাচ চলাকালীন সময় ৬৩ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় বলের আঘাতে মৃত্যু হয় এ ক্রিকেটারের। তারপর অষ্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড তার সম্মানে ৬৩ নাম্বার জার্সি তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্য আরেকটি হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটের লিটল মাষ্টার খ্যাত শচীন টেন্ডুলকার। তার প্রতি সম্মান দেখাননোর জন্য ২০১৭ সালে ভারত ক্রিকেট বোর্ড ১০ নাম্বার জার্সিটি তুলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে।