নেপাল স্বাধীন হচ্ছে কি?

নেপাল স্বাধীন হচ্ছে কি?

উপরের শিরোনাম দেখেই অনেকে চমকে উঠতে পারেন। কিন্তু নেপাল যে দেশ হিসেবে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে না তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

‘স্বাধীনতা’র অর্থ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দিক থেকে মোটা দাগে একটি ‘স্বাধীন দেশ’ বলতে যা বোঝায়, নেপাল যে তা নয় সেটি স্বীকার না করে উপায় থাকে না নেপাল ও ভারতের মধ্যকার ১৯৫০ সালের চুক্তিটি পড়লে। প্রায় আট দশক আগে করা ওই চুক্তির প্রভাব ও ফল এখনো নেপাল-ভারতের সম্পর্কে কার্যকর। বস্তুত ওই চুক্তি কারণেই দুই দেশের সম্পর্ক পরিচালিত হয়ে চলেছে সমমর্যাদাহীন এক পথে। তবে সাম্প্রতিক দিনগুলোয় ওই চুক্তি পরিবর্তনের আওয়াজ উঠছে।

দীর্ঘ দিন মৃদুলয়ে ওই বিষয়ে কথাবার্তা শুরু হলেও এখন এতে বাড়তি গতি এসেছে। ভূরাজনীতির পরিমণ্ডলে এটিকেই বলা হচ্ছে ‘হিমালয়কন্যার স্বাধীনতা’ হিসেবে। অবশ্য চুক্তিটির ভাগ্যে কী ঘটবে- ‘পরিবর্তন’, নাকি ‘সংশোধন’ তা এখনো ফয়সালা হয়নি।

স্বৈরাচারী অতীতের জের সংশোধনের সুযোগ এলো যেভাবে

১৯৫০ সালের ৩১ জুলাই ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অবশ্য প্রায় ৬৮ বছর আগে নেপাল-ভারতের নীতি-নির্ধারকরা চুক্তিটির নাম রেখেছিলেন ‘শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি’। কিন্তু এতে অসাম্য ছিল স্পষ্ট। এ কারণেই ওই চুক্তি নিয়ে নেপালের সচেতন মানুষের মধ্যে গভীরতর মানসিক বেদনা আছে। ওই চুক্তি করেছিলেন নেপালের স্বৈরতান্ত্রিক রানা বংশের শেষ প্রধানমন্ত্রী শমসের বাহাদুর রানা। পুষ্পলাল শ্রেষ্ঠার নেতৃত্বাধীন নেপালের তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যুত্থানের হাত থেকে নিজেদের রাজবংশের নিরাপত্তা গ্যারান্টি হিসেবে ভারতকে অনেক অমর্যাদকর সুবিধা দিয়ে চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিলেন রানারা। কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও প্রকাশ্য বিরোধিতার সুযোগ না থাকায় খুব সহজে রানা বংশ এমন একটি চুক্তি করতে পেরেছিল তখন। অবশ্য চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাসের মধ্যে শমসের বাহাদুর রানার পতন ঘটে।

ইপিজি অবশ্য জানায়, তারা গত ছয়টি বৈঠকের একটি সুপারিশমালা নেপাল ও ভারত সরকারকে দেবে। এক্ষেত্রেও কিছু মুশকিল রয়েছে। নেপাল ও ভারত সরকার (একদিকে কমিউনিস্টদের সরকার, অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদীদের সরকার!) আদৌ ইপিজি’র সুপারিশের প্রতি গুরুত্ব দেবে কি না তা অনিশ্চিত

রক্তাক্ত বহু সংগ্রামের পথ বেয়ে আজকের নেপাল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে নিজেকে রূপান্তর করে নিচ্ছে ক্রমাগত। ফলে অতীতের যে কোনাে সময়ের চেয়ে কয়েক দশক ধরে রানাদের করা চুক্তিটি নিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে। ওই বিরোধিতা সম্প্রতি অনেকটা প্রবলভাবেই দু’দেশের সম্পর্কে ছায়া ফেলছে। এর কারণও অবোধগম্য নয়। দেশটিতে জাতীয়তাবাদী-কমিউনিস্টরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পথেই ব্যাপকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠায় এবং সর্বশেষ নভেম্বরের নির্বাচনে কেন্দ্রে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পাশপাশি সাতটি প্রদেশের ছয়টিতে বিজয়ী হওয়ায় ১৯৫০ সালের চুক্তির বিরোধিতার রাজনীতিও কোমরে জোর পেয়েছে।

আগামী মাসেই কে পি ওলি ও পুষ্প কুমার দাহালের নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব নেবে নেপালে। ওই দু’জন যে দুই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই কর্মী বাহিনীর প্রধানতম এক রাজনৈতিক স্বপ্নই হলো ১৯৫০ সালের চুক্তি বাতিল। ফলে সর্বশেষ নির্বাচনের ফল নেপালের জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিস্টদের সামনে নতুন এক ‘অর্জন’-এর সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

চুক্তিতে কী আছে?

কেন নেপালীরা ওই চুক্তির বন্ধন থেকে মুক্তি চাইছে তা বুঝতে হলে আমাদের চুক্তিটির কয়েকটি অনুচ্ছেদের দিকে একটু মনোযোগ দিতে হবে। তবে ওই আলোচনায় যাওয়ার আগে এও উল্লেখ করতে হয়, ১০টি অনুচ্ছেদ সংবলিত চুক্তিটিতে নেপালের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করলেও ভারতের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন দেশটিতে থাকা তখনকার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নারায়ণ সিং!

এক বছরের নোটিশ দিয়ে যে কোনাে পক্ষ ওই চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে। তবে কোনাে শাসকেরই এখনাে ওই সাহস হয়নি। নেপালের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মূলত মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম ওই চুক্তি সংশোধনের পক্ষে জনমত গঠন শুরু করে। বর্তমানে তারা এক্ষেত্রে আগের মতো সোচ্চার না হলেও তাদের পূর্বতন অবস্থান নিয়েছে দেশটির প্রধান দল ইউনাইটেড মার্কসিস্ট পার্টি (ইউএমএল) যারা ২০১৭ সালের তিনটি নির্বাচনেই (স্থানীয়, পৌর ও জাতীয়) প্রথম স্থান অধিকার করেছে

 

এই চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬ ও ৭-এ নেপালে ভারতীয় নাগরিকদের পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই প্রবেশ, সম্পদের মালিকানা অর্জন, ব্যবসায় ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ করে দিয়েছে। একই রকম সুবিধা চুক্তিতে নেপালের নাগরিকদেরও দেয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যত এমন বিধানের অর্থনৈতিক ফল বেশি ভোগ করছে ভারতীয়রাই। অবশ্য ভারতের প্রচারমাধ্যমে বরাবর উল্টো চিত্রই তুলে ধরা হয়।

নেপালের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ক্রয়ের ক্ষেত্রেও ওই চুক্তি (অনুচ্ছেদ ৫) ভারতের প্রভাব বাড়িয়েছে। বলা যায়, সাত দশক ধরেই নেপালের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের স্থায়ী বিক্রেতা একমাত্র ভারত। অনুচ্ছেদ ২-এর আলোকে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও ভারতের কাছে নেপালের বিশেষ দায়বদ্ধতা রয়েছে।

চীনের তিব্বত অভিযান ওই চুক্তির পটভূমি হিসেবে কাজ করলেও প্রকৃতপক্ষে কাঠমান্ডুতে রানাবংশ তাদের ক্ষমতা সুরক্ষিত করতেই চুক্তিটি করে। এর ফলস্বরূপ দেখা গেছে, বৈশ্বিক প্রটোকলের ব্যত্যয় ঘটিয়ে রানা প্রধানমন্ত্রী নির্দ্বিধায় প্রতিপক্ষ দেশের এক রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এমন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।

ওই চুক্তির অনেক ধারাই নেপালের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। চুক্তিটি যেভাবে সীমান্তকে উন্মুক্ত ঘোষণা করেছে, স্থানীয় আইন অনুযায়ী এর সুযোগ নেই। তবে দেশটির পাহাড়িদের মধ্যে চুক্তিটি অজনপ্রিয় হলেও ভারত সীমান্ত সংলগ্ন তরাইয়ের মধেসিদের মাঝেওিই চুক্তি অভিনন্দিত হয়। কারণ তারা সাংস্কৃতিকভাবে বিহার ও উত্তর প্রদেশের সঙ্গে নৈকট্য বোধ করে থাকে।

এক বছরের নোটিশ দিয়ে যে কোনাে পক্ষওেই চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে। তবে কোনাে শাসকেরই এখনাে ওই সাহস হয়নি। নেপালের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মূলত মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম ওই চুক্তি সংশোধনের পক্ষে জনমত গঠন শুরু করে। বর্তমানে তারা এক্ষেত্রে আগের মতো সোচ্চার না হলেও তাদের পূর্বতন অবস্থান নিয়েছে দেশটির প্রধান দল ইউনাইটেড মার্কসিস্ট পার্টি (ইউএমএল) যারা ২০১৭ সালের তিনটি নির্বাচনেই (স্থানীয়, পৌর ও জাতীয়) প্রথম স্থান অধিকার করেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থান থেকে ইউএমএল-এর প্রথম স্থানে উঠে আসার ক্ষেত্রে ১৯৫০ সালের চুক্তির বিরোধিতা বিশেষ জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। এর সঙ্গে ছিল আন্তঃদেশীয় নদীগুলো থেকে পাওয়া জলবিদ্যুতের হিস্যা ও ভারতের সেনাবাহিনীতে নেপালের গুর্খাদের রিক্রুটমেন্টের প্রসঙ্গ।

ভারত বাস্তবতা বুঝতে পারছে। কিন্তু নেপালকে হারাতে চাইছে না

অবশ্য অতীতে নেপালের শাসক-এলিটরা তীব্র জনমত সত্ত্বেও রানা বংশের আত্মসমর্পণমূলক চুক্তিটির বিরুদ্ধে দিল্লির কাছে প্রবল আপত্তি উত্থাপন করেনি। কিন্তু এটা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই, স্থলবেষ্টিত হওয়া সত্ত্বেও নেপাল আগের মতো ভারতনির্ভর নিরুপায় অবস্থায় নেই। গত ৬৮ বছরে কোশি, কর্নালি কিংবা গান্ধকী নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। ভারত যে এই অবস্থা উপলব্ধি করছে সেটিও স্পষ্ট।

নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারত আলোচ্য চুক্তিটির কোনো সংশোধনে আগ্রহী নয় বলে প্রচারিত হলেও ২০১৪ সালে নেপাল সফরকালে নতুন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ওই চুক্তি সংশোধন করার বিষয়ে ভারতীয় সম্মতির কথা জানান। মুশকিল হলো, এই চুক্তি বাতিল করার প্রক্রিয়া চুক্তিতেই বর্ণিত থাকলেও সংশোধনের বিধান চুক্তিতে রাখা হয়নি। তবে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ফোরামে নিজে থেকেই বৃহৎ প্রতিবেশী এখন ১৯৫০ সালের চুক্তির ‘পর্যালোচনা’, ‘সংশোধন’ ও ‘উন্নয়ন’-এর কথাই বলে যাচ্ছে।

ভারত এও চাইছে, দুই দেশের সম্পর্কে ভারতের ‘বিশেষ ভূমিকা’ নেপাল যেন ভবিষ্যতেও মেনে নেয়। বস্তুত ভারতীয় প্রত্যাশার ওই অধ্যায়েই জটিলতার গ্রন্থিগুলো।

অতীতে নেপালকে কোনাে বিষয়ে বাধ্য করার প্রয়োজন হলেই ভারত যেভাবে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে তাদের প্রত্যাশা পূরণ করেছে, নেপালিরা ওই অবস্থার অবসান চায়। চীন এক্ষেত্রে নেপালকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। উত্তর সীমান্তে চীনের উদার সহায়তার আহ্বানের মুখে নেপাল সত্তরের দশকের দাসোচিত সম্পর্কের স্মৃতি ভুলতে চাইছে। কে পি ওলি ও পুষ্প কুমার প্রচন্ড নেপালের ওই প্রত্যাশার ভাষা দিতে এখন ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত।

একটি সিভিল সোসাইটির উদ্যোগ ও এর ভবিষ্যৎ

যেহেতু নেপাল ও ভারত- দু’দেশের জন্যই ওই চুক্তি এবং এর পরিবর্তন অতি স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ সেহেতু উভয় দেশের নাগরিক সমাজের একাংশ এক্ষেত্রে নিজ নিজ দেশের রাজনীতিবিদদের সহায়তাও করতে আগ্রহী। ওই লক্ষ্যে অপ্রচলিত এক কূটনীতিক উদ্যোগে শামিল হয়েছেন তারা এখন। এর অংশ হিসেবে নেপাল ও ভারতের ‘বিশিষ্ট নাগরিক’দের একটা ফোরাম গড়ে উঠেছে এই বিষয়ে আলোচনার জন্য। এই গ্রুপের নাম দেয়া হয়েছে ‘এমিনেন্ট পারসন গ্রুপ’ বা সংক্ষেপে ‘ইপিজি’। ওই গ্রুপে নেপালের পক্ষে রয়েছেন চার সদস্য এবং ভারতের চারজন। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ওই গ্রুপের কার্যক্রম শুরু হয় এবং দুই বছর মেয়াদ শেষে আগামী জুলাইয়ে এর মেয়াদ শেষ হবে বলে নির্ধারিত হয়ে আছে। এ মাসেই ইপিজি ফোরামের ষষ্ঠ বৈঠক হয় দিল্লিতে। সেখানে এই মর্মে ঐকমত্য হয়েছে, ১৯৫০ সালের চুক্তিটি আর কার্যকর থাকার যৌক্তিকতা নেই। তবে যথারীতি ইপিজি’তেও এই মর্মে ঐকমত্য হয়নি, চুক্তিটি সংশোধন হবে, নাকি বাতিল হবে। ইসিজি অবশ্য জানায়, তারা গত ছয়টি বৈঠকের একটি সুপারিশমালা নেপাল ও ভারত সরকারকে দেবেন। এক্ষেত্রেও কিছু মুশকিল রয়েছে। নেপাল ও ভারত সরকার (একদিকে কমিউনিস্টদের সরকার, অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদীদের সরকার!) আদৌ ইপিজি’র সুপারিশের প্রতি গুরুত্ব দেবে কি না তা অনিশ্চিত। ইপিজি-নেপাল ও ইপিজি-ভারতের সমন্বয়ক হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা উভয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ইপিজি-নেপালের সমন্বয়ক হলেন রাজতন্ত্রের আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বি বি থাপা এবং ইপিজি-ভারতের সমন্বয়ক বিজেপি সমর্থক ভগত সিং কোশারি। এমন একটি রাজনৈতিক চরিত্রের ইপিজির সুপারিশ ওলি ও প্রচন্ড-এর নেতৃত্বাধীন নেপালের আসন্ন সরকার কতটা শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

প্রথম সভায় ইপিজি সদস্যরা -ছবি : দি হিমালয়ান টাইমস

 

নেপালি সমাজের আহত মর্যাদাবোধ

ভারতের রাজনীতিবিদরা এটি বিশ্বাস করেন না, কে পি ওলি’র দল ক্ষমতাসীন হয়েই একতরফাভাবে চুক্তি অবসানের নোটিশ দেবে। তবে সর্বশেষ নির্বাচনে মার্কসবাদী ইউএমএল এবং মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টার জোট প্রায় চার-পঞ্চমাংশ আসনে বিজয় লাভ করায় স্বভাবত আলোচ্য চুক্তি নিয়ে ভারতের তরফ থেকে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে পরাজিত নেপালি কংগ্রেস ছিল ওই চুক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল একমাত্র স্থানীয় রাজনৈতিক দল। তাদের সঙ্গে ভারতের সখ্য ছিল। ভারতের জন্য বিশেষ উদ্বেগের দিক হলো, নেপালের নতুন সরকার স্থিতিশীলতা পেলে আগামী পাঁচ বছর দেশটিতে চালকের আসনের থাকবেন কে পি ওলি। তার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ। ২০১৫ সালে ওলি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন নেপালকে ভারত অবরোধ করে রেখেছিল দীর্ঘদিন। ওই তিক্ত অভিজ্ঞতা যে নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভোলেননি তা বোঝা গেছে যখন জাতীয় নির্বাচনের প্রচারকালে বার বার স্পষ্ট করেই বলেছেন, তারা পুনরায় সরকার গঠনের সুযোগ পেলে তথাকথিত শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি বাতিল করবেন। বলা বাহুল্য, নির্বাচনে ওলির দলের প্রথম স্থান অধিকারের এটি ছিল অন্যতম জাদু। এই নির্বাচন বলে দিচ্ছে- ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির বিপুল ঐক্য থাকার পরও ভারত সম্পর্কে নেপালিদের গোপন বিরাগ কত গভীর! তবে নেপালি সমাজের এই আহত মর্যাদাবোধ এখন একই সঙ্গে চীন-ভারত ভূরাজনীতিরও অনেক বড় একটি পণ্যও বটে।

নেপাল ঘিরে চীন-নেপাল ঠাণ্ডাযুদ্ধ

চীন এক্ষেত্রে সচেতনভাবেই কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ভারতের অবরোধের মুখে নেপাল চীনের সঙ্গে ওলি অনেক চুক্তি করেছেন বাণিজ্য ও ট্রানজিট বিষয়ে। এসব চুক্তি কার্যকর হলে নেপালে ভারতের বাণিজ্যিক একচেটিয়াত্ব কমে যাবে। এছাড়া ওলি ও বেইজিং উভয়ে তিব্বত এবং কাঠমান্ডুর মধ্যে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ গড়ে তুলতে আগ্রহী। ক্ষমতা গ্রহণের জন্য অপেক্ষমাণ অবস্থাতেই গত ১৯ ডিসেম্বর হঠাৎ করে কে পি ওলি তিব্বত নিকটবর্তী রাশুওয়াদি এলাকা সফরে গিয়ে আবারও দু’দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য তার ভাবনার বিস্তারিত বিবরণ দেন। চীন ইতোমধ্যে জানিয়েছে, রাশুওয়াদি-কিরাং (তিব্বত) পয়েন্ট হবে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন গেইটওয়ে! ইতিহাসের এক বড় কৌতুক হলো এই যে, রাশুওয়াদি সীমান্তপথেই ১৮৫৫ সালে নেপালের রানারা তিব্বত দখল করেছিলের! সময়ের সঙ্গে পাল্টে যাওয়া ভূরাজনীতির পথ ধরে এখন ওই পথেই চীন আসতে চাইছে নেপালে। আর রাশুওয়াদি-কিরাংয়ের পথ ধরে নেপাল পৌঁছাতে চাইছে চীনের ইংহাই অঞ্চলের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার রেল নেটওয়ার্কে। নিশ্চিতভাবেই এসব হলে নেপাল-ভারত বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র বীরগঞ্জের গুরুত্ব কমিয়ে ফেলবে। কৌতূহল উদ্দীপক দিক হলো, গত ১৯ ডিসেম্বরের ওই সফরকালে ওলি তাৎক্ষণিক অনুমতি নিয়ে চীনের সীমান্তের ভেতরে তিব্বতের ভূমিতেও কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ান। স্পষ্টত এটি নেপালের দক্ষিণ প্রতিবেশীর জন্য একটা রূঢ় বার্তা।

অন্যদিকে কে পি ওলি আগে যিনি নেপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (এখন যিনি ওলির প্রধান মিত্র) সেই দাহাল তার আমলে চীনের সঙ্গে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বুড়ি গান্ধকী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি করেছিলেন। চীন পরে ওই প্রকল্পটিকে তার ‘ওয়ান বেল্ট-ওয়ান রোড’ উদ্যোগে যুক্ত করে নেয়। ভারত প্রকাশ্যেই চীনের ‘ওয়ান বেল্ট-ওয়ান রোড’ উদ্যোগের প্রতি চরম বৈরী। এর ফল হয়েছে, ভারত সমর্থক নেপালি কংগ্রেস ক্ষমতায় এসে বুড়ি গান্ধকী প্রকল্প স্থগিত করে দেয়। কিন্তু ওলি প্রকাশ্যেই বলে রেখেছেন, তিনি ক্ষমতায় এসে ওই প্রকল্প পুনরুজীবিত করবেন।

কাঠমান্ডুতে প্রধান রাজনীতিবিদদের দ্বিমুখী ওইসব তৎপরতায় যে দিল্লি ও বেইজিংয়ের প্রভাব রয়েছে এ বিষয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এক প্রকার নিশ্চিত। ওই পটভূটিতেই আগামী মাসে নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হবে নেপালে। তখনই বস্তুত ক্ষণ গণনা শুরু হবে কবে ও কীভাবে ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল চুক্তির বিষয়ে কে পি ওলি তার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করেন বা আদৌ করেন কি না?

এক্ষেত্রে যাই ঘটুক, এর একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে দক্ষিণএশিয়া জুড়ে, বিশেষত নেপালের কাকরভিটা থেকে মাত্র ৫৪ কিলোমিটার দূরে থাকা বাংলাদেশের আঞ্চলিক সম্পর্ক জালেও।