তামিম-সাকিবের আশা জাগানিয়া শুরুর পরও পথ হারানো বাংলাদেশের রক্ষা করলেন টেল-এন্ডাররা। সানজামুল, মোস্তাফিজ ও রুবেলের ছোট কিন্তু কার্যকর ইনিংসগুলোর সুবাদে শেষ পর্যন্ত দুইশ’র কোটা পার করে বাংলাদেশ, বোর্ডে জমা হয় লড়াই করার ন্যূনতম পুঁজি। তা কাজে লাগিয়ে বল হাতে দুর্দান্ত বোলিং করে জিম্বাবুয়েকে ৯১ রানে হারিয়েছে টাইগাররা।
বিশ্লেষণ : এ ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটিংটিকে ভাগ করা যায় তিন ভাগে।
- তামিম-সাকিবের পার্টনারশিপ ও সাকিবের বিদায়ের আগ পর্যন্ত;
- মিডল অর্ডারের ধস; এবং
- টেল এন্ডারদের দৃঢ়তা।
তামিম-সাকিবের পার্টনারশিপ
দীর্ঘদিন পর দলে ফেরা এনামুল এ ম্যাচে হয়েছেন চূড়ান্ত ব্যর্থ। আগের দুটি ম্যাচে কিছুটা সম্ভাবনা জাগালেও এ ম্যাচে ফিরেছেন একদম শুরুতেই- মাত্র ১ রানে। ফলে মাত্র দ্বিতীয় ওভারেই জুটি বাঁধতে হয় তামিম-সাকিবকে। চলতি সিরিজের আগের দু’ম্যাচেই অর্ধশতক হাঁকানো তামিম এ ম্যাচেও ছিলেন সপ্রতিভ। মন্থর ও টার্নিং উইকেটে দলের দাবি মেনে শট খেলার বদলে উইকেট আঁকড়ে ধরে ছিলেন ওই বাঁহাতি। শট খেলার স্বাধীনতা কমে আসায় সিঙ্গল ও ডাবলস-এর ওপর ভর করে রানের চাকা সচল রাখা তামিমকে পুরোটা সময়ই মনে হয়েছে আগের চেয়ে বেশ পরিণত। শুরুতে কিছুটা শট খেলার ঝোঁক দেখালেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটে লাগাম পরান বিশ্বের এক নাম্বার অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। প্রিয় বন্ধুর দেখানোর পথে তিনিও রানের চাকা সচল রাখতে নির্ভর করেন সিঙ্গল-ডাবলসের ওপরই। দু’জনের চমৎকার বোঝা-পড়া ও পরিণত ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের দলীয় স্কোর পার করে ১০০ রানের কোটা। জুটিতে আসে ১০৬ রান।
ওই সময়টুকু ইতিবাচক এবং পুরোটা সময়ই পাওয়া যাচ্ছিল পরিণত বোধের পরিচয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যে একটি কঠিন অঙ্গন এবং এখানে যে শেখার শেষ নেই তা স্পষ্ট হয়ে যায় দু’জনের আউটের ধরন দেখেই। এটি অনস্বীকার্য, দলের রানের গতি বাড়াতে তখন শট খেলার বিকল্প ছিল না। তবে প্রশ্নটি তখনই ওঠে যখন শট খেলার প্রচেষ্টায় দু’জনই দৃষ্টিকটুভাবে স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার হন। ‘দৃষ্টিকটু’ শব্দটি ব্যবহার করতে হচ্ছে এই জন্য যে, অনেকটা সময় ক্রিজে কাটানোর পর দু’জনই বুঝতে পারছিলেন পিচের বাউন্স সমান নয়। একই সঙ্গে বল যথেষ্ট টার্নও করছিল। এমন সময় ক্রিজ থেকে বের হয়ে শট খেলার প্রচেষ্টা আত্মহত্যারই নামান্তর। অবশ্য দু’জনেরই নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা যথেষ্ট প্রমাণ করার জন্য যে, তারা প্রতিনিয়তই ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন।
এটিকে ধস না বলে আসলে বিরূপ পরিস্থিতিতে দ্রুত রান তোলার অক্ষমতাই বলা উচিত। তামিম-সাকিব উইকেটে ২৫ ওভারের বেশি সময় কাটালেও রানের গতি ছিল প্রত্যাশার চেয়ে কম। ফলে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দেখা গেছে দ্রুত রান তোলার তাগিদ। ওই সময় দ্রুত রান তোলা ছিল সময়ের দাবি। তা মেটাতে গিয়েই একে একে ড্রেসিংরুমের পথ ধরেন মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ, সাব্বির ও নাসির। তাদের মধ্যে সাব্বিরকে বলা যায় দুর্ভাগ্যের শিকার। ঝাঁপিয়ে পড়ে এক হাতে যেভাবে আরভিন তার ক্যাচটি ধরেছেন সেটিকে অনায়াসেই সিরিজের সেরা ক্যাচ বলা যায়। এমন একটি ক্যাচের পর ব্যাটসম্যানের দায় না খুঁজে বরং ফিল্ডারকেই প্রাপ্য কৃতিত্ব দেয়া উচিত। কিন্তু মুশফিক ও নাসিরের আউট দুটি ছিল একদমই বাজে শটে। সুইপ খেলতে গিয়ে টাইমিংয়ের গড়বড়ে ক্যাচ আউট হন মুশফিক এবং জায়গায় দাঁড়িয়ে উইকেটের অনেক বাইরের বল তাড়া করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন নাসির। তার খেলায় ফুটওয়ার্কের চরম অভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। ম্যাচের এই মুহূর্তগুলোয় গ্যাপ খুঁজে রান বের করা, দ্রুত রানিং বিটুইন দি উইকেট এবং ডট বল করার সুযোগ না দেয়া প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার অন্যতম কার্যকর কৌশল। ওই কৌশল রপ্ত করা থেকে এখনো বেশ দূরে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে ছিল বলে হয়তো ওই পুঁজিতেই রক্ষা পাওয়া গেছে। কিন্তু ভালো কোনো দলের বিপক্ষে যে ওই পুঁজিতে পার পাওয়া যাবে না তা সহজেই অনুমেয়।
এ সিরিজের আগে থেকেই টিম ম্যানেজমেন্ট বিশেষ নজর রাখছিল টেল এন্ডারদের ব্যাটিংয়ের দিকে। এর সুফলও দেখা গেল এ ম্যাচেই। সানজামুল, মোস্তাফিজ ও রুবেলের মিলিত সংগ্রহ ৪৬ রান। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই ৪৬ রান অন্য যে কোনো সময়ের ১০০ রানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চোখে লেগে থাকার মতো ছিল সাইট স্ক্রিনে আছড়ে ফেলা রুবেলের ছয়ের মারটি।
এবার নজর দেয়া যাক বোলিংয়ের দিকে। অনুমিতভাবেই জিম্বাবুয়ের স্পিন দুর্বলতা মাথায় রেখে পেসার সাইফুদ্দিনের বদলে সানজামুলকে নিয়ে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। স্পিন ফাঁদে রীতিমতো আটকা পড়েছে জিম্বাবুয়ে। সাকিব-সানজামুলের স্পিন বিষে নীল হয়ে পাঁচটি উইকেট হারিয়ে খেলা থেকেই ছিটকে যায় জিম্বাবুয়ে। বিশেষ করে শুরুতেই সাকিবের জোড়া আঘাতে টপ অর্ডারের দুই ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে পথ হারানো জিম্বাবুয়ে আর ম্যাচেই ফিরতে পারেনি। স্পিনারদের যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন পেসাররাও। মাশরাফি, মোস্তাফিজ ও রুবেলত্রয়ী মিলেও শিকার করেছেন সমান পাঁচ উইকেট।
গুরুত্বের দিক দিয়ে নেহাত সাদামাটা একটি ম্যাচ হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে নানান কারণেই অক্ষয় হয়ে থাকবে ম্যাচটি। প্রথমে দলীয় অর্জনের কথাই উল্লেখ করি- প্রথমবারের মতো কোনো দলের বিপক্ষে টানা দশটি জয় পেল বাংলাদেশ।
এবার নজর দেয়া যাক ব্যক্তিগত অর্জনের দিকে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে তামিমের দিকে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এ ম্যাচে ছুঁয়েছেন গর্ব করার মতো কিছু মাইলফল।
- প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে একদিনের ক্রিকেটে ছয় হাজার রান পূর্ণ;
- পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজারে পৌঁছাতে সবচেয়ে কম ইনিংস খেলা ব্যাটম্যান : পেছনে ফেলেছেন ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে। পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজারে পৌঁছাতে তামিমের লেগেছে ১৭ ইনিংস, কোহলির ২২।
- একটি নির্দিষ্ট ভেনুতে সার্বাধিক রান : মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তামিমের সংগ্রহ দুই হাজার ৫৪৯ রান। পেছনে ফেলেছেন সাবেক লঙ্কান অধিনায়ক সনাৎ জয়সুরিয়াকে। প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে জয়সুরিয়ার সংগ্রহ দুই হাজার ৫১৪ রান।
তামিমময় এ ম্যাচে গর্বের রেকর্ড ছুঁয়েছেন বদলে যাওয়া বাংলাদেশের মূল নায়ক মাশরাফি। বাংলাদেশ জাতীয় দলকে সার্বাধিক জয়ে নেতৃত্ব দেয়ার গৌরব এখন মাশরাফির। পেছনে ফেলেছেন সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান নির্বাচক হাবিবুল বাশারকে। এর আগে ২৯টি জয় নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ২৯টি জয় এসেছিল ৬৯ ম্যাচে। মাত্র ৫৩তম ম্যাচেই হাবিবুলকে ছাড়িয়ে গেলেন ম্যাশ। জয়ের হারও ঈর্ষণীয়- ৫৮ দশমিক ৮২ শতাংশ।