বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এই যুগ অনেক অসাধ্যকে সাধন করেছে। প্রতিনিয়ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। কিন্তু যদি এমন হয়, বিজ্ঞানীরা হাজার বছর আগের কোনো মানুষকে নিয়ে আসে আপনার সামনে? অবাক লাগলেও গত শুক্রবার এমনটাই দেখা যায় এথেন্স-এর এক্রোপোলিস জাদুঘরে। একদল গ্রিকওি সুইডিশ বিজ্ঞানী মিলে ৯ হাজার বছর আগের এক নারীর মুখের আকৃতি বা চেহারা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। বলছি, ‘আভগি’র কথা। অনুমান করা হয়, আজ থেকে প্রায় ৯ হাজার বছর আগে মেসোলিথিক পর্যায়ের শেষের দিকে মানে খ্রিস্টপূর্ব ৭ হাজার অব্দে আভগি ওই গ্রিসের থেসালিতে বসবাস করতেন। বিজ্ঞানীরা তার মুখাবয়বের পুনর্নির্মাণ ও শুক্রবার এক্রোপোলিস জাদুঘরে তা উপস্থাপন করেন।
উল্লেখ্য, তার মাথার খুলির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় ১৯৯৩ সালে গ্রিসের ‘থিওপেট্রা’ নামক গুহায়।
গ্রিক শব্দ আভগি (Avgi) অর্থ হচ্ছে সূর্যোদয়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা তাকে আভগি নামকরণ করেন। এর কারণ হলো, তাদের মতে, তিনি পৃথিবীতে আসেন মেসোলিথিক যুগের শেষের দিকে যে সময়কে ধরা হয় বর্তমান সভ্যতার গোড়াপত্তনের সময়। তখন মানুষ শিকার সংগ্রহের অর্থনীতি থেকে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দিকে ঝুঁকছে।
আভগি-র মুখাবয়বের পুনর্নির্মাণ মোটেও সহজ কাজ ছিল না। এর পেছনে ইউনিভার্সিটি অফ এথেন্স-এর একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ ছাড়াও নিরলস পরিশ্রম করেছেন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট, অর্থোপেডিস্ট, নিউরোলজিস্ট, প্যাথোলজিস। ওই দলটিকে পরিচালনা করেন বিখ্যাত অর্থডোন্টিস্ট ম্যানোলিস পাপাগ্রিগোরাকিস। তাদের সঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত সুইডিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ভাস্কর অস্কার নিলসন। এছাড়া কাজ করেন থিওপেট্রা গুহার খননকার্যের পরিচালক বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ নিনা ক্যাপারিসি-এপোসটোলিকা।
আভগির বয়স আনুমানিক ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হবে বলে ধারণা করা হয়। অর্থডোন্টিস্ট ম্যানোলিস পাপাগ্রিগোরাকিস বলেন, আভগির হাড় থেকে অনুমান করা যায়, ওই হাড় ১৫ বছর বয়সী কিশোরীর। কিন্তু তার দাঁত আনুমানিক ১৮ বছর বয়সী নারীর। এছাড়া ক্যাপারিসি-এপোসটোলিকার মতে, আভগির দেহাবশেষের পরীক্ষা থেকে অনুমান করা যায় আভগি খ্রিস্টপূর্ব ৮০৭০ অব্দে পৃথিবী তার অবস্থান ছিল।
অবশ্য আভগির দেহাবশেষ থেকে তার জীবনধারণ পদ্ধতি সম্পর্কে কমই জানা গেছে। তার মৃত্যু কীভাবে হয় তাও জানা যায়নি। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু হারিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও প্রত্নতত্ত্ববিদরা ৯ হাজার বছর আগের প্রাচীন নারীর অবয়ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন আভগির দেহাবশেষ থেকে। অনুমান করা হয় তার বয়স ছিল ১৮ বছর, উচ্চতা ১৫৭ সেন্টিমিটার। তার থুঁতনি ছিল লম্বা, টোলযুক্ত গাল ও পুরু কপাল। মেসোলিথিক যুগের শেষের দিকে থেসালির ওই সমাজ শিকার সংগ্রহ ছেড়ে খাদ্য উৎপাদন করতে শুরু করে সবেমাত্র।
গবেষক দল প্রথমে খুলির সিটিস্ক্যান করে থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে হুবহু নতুন নির্মাণ করে। এরপর খুলির গঠন অনুযায়ী মুখমণ্ডলের ওই রেপ্লিকায় মাংসপেশি বসায়। মাথার খুলি অনুযায়ী মুখের কিছু অংশ নির্মিত হয় এবং বাকি বৈশিষ্ট্য যেমন- ত্বক বা চোখের বর্ণ নির্ধারণ করা হয় থেসালির ওই নির্দিষ্ট এলাকার সাধারণ মানুষের ওপর ভিত্তি করে।
অবশ্য প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ থেকে মুখাবয়বে প্রাণ ফিরিয়ে আনার ওই কাজ এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০১০ সালে পাপাগ্রিগোরাকিস, নিলসন ও ইউনিভার্সিটি অফ এথেন্সের প্রত্নতাত্ত্বিক দল মার্টিস নামক ১১ বছর বয়সী এক বালিকার মুখাবয়ব পুনর্নির্মাণ করেন এবং গেত ডিসেম্বরে পুনর্নির্মাণ করেন ১ হাজার ২০০ বছর আগের প্রাচীন পেরুভিয়ান রানীর মুখাবয়ব। এথেনিয়ান মার্টিস খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে টাইফয়েডে মারা যান তিনি। তার মৃত্যু সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত থাকলেও আভগির মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, আভগি ও মার্টিস-এর মধ্যকার ৭ হাজার বছর ব্যবধানে মানুষের মুখাবয়বে কাঠামোগত পরিবর্তন দেখা যায়। এভাবে মুখের কাঠামো কোমলতর হয় ৭ হাজার বছরের ব্যবধানে।
থিওপেট্রার গুহায় এর আগেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন-এর দেখা পাওয়া যায়। যেমন- মানুষ নির্মিত প্রথম কাঠামো পাওয়া যায় ওই গুহায়। গ্রিসের মিটেওরা থেকে মাত্র ৪ কিলোমটিার দূরত্বে অবস্থিত ওই গুহার ভৌগােলিক অবস্থান এবং কাছেই বিশুদ্ধ পানির প্রবাহ প্রাচীন যুগের মানুষের জন্য সুবিধাজনক বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়। এ কারণেই ধারণা করা হয়ে থাকে, প্রাচীন যুগের অধিবাসীরা ওই জায়গা টানা ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর ধরে নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছিল।