• দুটি করে গোল করেছেন নাচো, বেল ও রোনালদো
• ২৭৩ দিন পর একত্রে দেখা গেল বিবিসি ত্রয়ীকে
রিয়াল মাদ্রিদ ৭-১ দেপোর্তিভো
নাচো ৩২*, ৮৮* আদ্রিয়ান লোপেজ ২৩*
বেল ৪২*, ৫৮*
মদ্রিচ ৬৮*
রোনালদো ৭৮*, ৮৪*
’চাইলে রোনালদোর রক্ত ঝরানো গোলে জয় পেল রিয়াল’- শিরোনামটা এভাবে করা যেতাে। কিন্তু সেটি বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। যে গোলটি করতে গিয়ে রক্ত ঝরালেন রোনালদো এর বহু আগেই জয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল রিয়ালের। ঘরের মাঠে ৭-১ গোলে জয়টি জিদানের কাছে কতটা স্বস্তিদায়ক তা বোধহয় আলাদা করে উল্লেখ না করলেও চলবে।
৪-৩-৩ : চেনা ছন্দে রিয়াল
মৌসুমের প্রায় শুরু থেকে মূল একাদশের নিয়মিত খেলোড়ারদের অফ-ফর্ম ও ইনজুরির কারণে ভিন্ন ফর্মেশনে খেলতে দেখা গেছে ব্লাংকোসদের। কখনো ৪-৪-২, কখনো বা ৪-২-৩-১ গোলে দলকে খেলিয়েছেন জিদান। আলাদা ওইসব ফর্মেশনে খেলানোর মূল কারণ যতটা না পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল এর চেয়ে বেশি ছিল উপযুক্ত পজিশনগুলোয় সঠিক খেলোয়াড়ের অভাব। মধ্যমাঠ ও আক্রমণভাগের মূল সৈনিকদের দলে পাওয়া মাত্রই জিদান ফিরে গেছেন ৪-৩-৩ গোলে। এ ফর্মেশনটিতে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে রিয়াল। আর এ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে খেলতে পারা রিয়াল কতটা ভয়ানক হতে পারে তা কাল তার এক অনুপম প্রদর্শনী অসহায়ভাবে অবলোকন করেছে দেপোর্তিভো। ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই গোলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া রিয়াল মাঠের দু’প্রান্ত কাজে লাগিয়ে প্রায় পুরো ৯০ মিনিটই ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল দেপোর্তিভোর রক্ষণকে। একই সঙ্গে অসাধারণ ছিলেন মধ্যমাঠের দুই জাদুকর- মদ্রিচ ও ক্রুসও।
ফিরে পাওয়া হার না মানার মানসিকতা
গত মৌসুমে বহুবার পিছিয়ে পড়েও হাসিমুখে ম্যাচ শেষ করেছে রিয়াল, বিশেষ করে বার্নাব্যুতে তো ছিল অদম্য। কিন্তু এ মৌসুমের শুরু থেকেই ওই চেহারা বদলে যেতে থাকে। কালকেও দেপোর্তিভোর প্রথম গোলের পর বিস্ময় প্রকাশ করে ভাষ্যকাররা বলেছিলেন, অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হচ্ছে যে, কেউ চাইলে এখন বার্নাব্যু থেকে পয়েন্ট নিয়ে ফিরে যেতে পারে। তা গত মৌসুমের সম্পূর্ণ বিপরীত, এমনকি রিয়ালের ইতিহাসেই এমনটি দেখা যায়নি। ভাষ্যকারের ওই তিক্তভাষ্য রিয়ালের খেলোড়ারদের কানে হয়তো পৌঁছায়নি। তবে নিজেদের মধ্যেই বোধহয় ফিরে পেয়েছিলেন রিয়ালের রয়াল তকমার প্রতি সুবিচার করার তাগিদ। তাই প্রথমে গোল খেয়েও দমে না গিয়ে আক্রমণের পর আক্রমণের ঢেউ তুলতে থাকে মেরেঙ্গুয়েজরা। ওই ঢেউয়ের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় দেপোর্তিভোর রক্ষণ। নাচোর গোলে নাচের ছন্দ ফিরে পাওয়া রিয়াল এরপর থেকে প্রতিমুহূর্তে শুধু মুগ্ধতাই বাড়িয়ে গেছে।
সাদামাটা প্রথমার্ধ ও দ্বিতীয়ার্ধের ক্ষুধার্ত রিয়াল
প্রথমার্ধের শেষ দিকে বেলের অসাধারণ বাকানো শুটে লিড নিলেও ঠিক যেন রিয়ালীয় ধাঁচটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছি না খেলায়। দ্বিতীয়ার্ধেই বদলে গেল দৃশ্যপট। যে রিয়ালকে দেখার জন্য হা-পিত্যেশ করে মরছিলেন সমর্থকরা ওই রিয়ালকেই দেখা গেল এবার। কর্নার থেকে বেলের দারুণ হেডে ৩-১। এরপর রোনালদোর জাদুকরী ছোঁয়া থেকে পাওয়া বলে নিখুঁত ফিনিশিংয়ে মদ্রিচের গোল মুগ্ধতার রেশ বাড়িয়েই যাচ্ছিল। তখনো যদি সমর্থকদের মনে কোনো অপূর্ণতা থেকে থাকে তাহলে তা ছিল পুর্তগিজ যুবরাজের গোলশূন্য থাকাটা। চেনা ছন্দের রিয়ালের রাতে রোনালদোর গোল তো এক অলিখিত রাওয়াইয়্যাত। এর ব্যতিক্রম না ঘটিয়ে দলের পঞ্চম গোলটির মধ্য দিয়ে অবেশেষে গোলক্ষরা কাটালেন ‘টি বেস্ট’। এরপর এলো ওই গোলটি যেটিকে জালে পাঠাতে গিয়ে রক্ত ঝরালেন রোনালদো। নিখুঁত ও ঝুঁকিপূর্ণ এক হেডে বল আছড়ে পড়লো দেপোর্তিভোর জালে- ৬-১। মুখে রক্ত নিয়ে রোনালদো মাঠের বাইরে চলে গেলেও গোলক্ষুধা যেন কমছিল না হোয়াইটসদের। শেষটা করলেন যার পায়ে রিয়াল ফিরে পেয়েছিল ম্যাচে ফেরার আত্নবিশ্বাস সেই নাচো। চিন্তার ভাঁজ সরে গিয়ে জিদানের মুখে তখন স্বস্তির ছাপ।

মৌসুমজুড়েই জিদানের জন্য ভরসার এক নাম হয়ে উঠেছেন নাচো। দলের প্রয়োজনে কখনো মার্সেলোর জায়গায়, কখনো রামোসের জায়গায়, কখনো বা কার্ভাহালের জায়গায় খেলেছেন তিনি। মোদ্দা কথা, যখনই কোনো শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়েছে তখনই সেটি পূরণে নিজের পুরোটা ঢেলে দিয়েছেন নাচো। গতকাল রিয়াল-কে ম্যাচে ফেরানো অসাধারণ গোলটি দিয়েই শুধু নয়, রক্ষণেও দারুণ ভূমিকা রেখে রিয়ালের সাহায্য করেছেন ছন্দ ধরে রাখতে। মাঝমাঠেই দারুণ চার্জে প্রতিপক্ষকে রুখে দেয়া কিংবা গোললাইন থেকে অসাধারণ ক্লিয়ারেন্স- কোথায় ছিলেন না নাচো? তিনি যদি রক্ষণের রক্ষাকর্তা হন তাহলে আক্রমণে ওই দায়িত্বে ছিলেন বেল। প্রায় প্রতিটি আক্রমণেই ওই ওয়েলস তারকার অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। অসাধারণ ফিনিশিং, হৃৎস্পন্দ বাড়িয়ে দেয়া সব ক্রসে বেল ছিলেন অনন্য। ফিটনেস ঘাটতি ও পড়তি ফর্মের জন্য সমালোচনার স্বীকার হওয়া ওই ওয়েলস উইজার্ড গতকাল দেখিয়ে দিয়েছেন পূর্ণ ফিট অবস্থায় তিনি এখনো অপরিহার্য।
একরোখা জিদান ও স্বরূপে ‘দি বেস্ট’
ক্লাসিকো-য় বার্সার কাছে বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকেই সমালোচকদের প্রিয় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন ফরাসি কিংবদন্তি জিদান। এর মাত্রা আরো বেড়ে যায় যখন তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ট্রান্সফার মার্কেটে এবারও নীরব থাকবে রিয়াল অর্থাৎ নতুন কোনো মুখ আনবেন না। তার বদলে ভরসা রাখবেন নিজের খেলোয়াড়দের ওপরই। গতকাল যেন জিদান-এর স্থির ভরসার প্রতিদান দেয়ার প্রত্যয় নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন তার শিষ্যরা। ম্যাচ শেষে বিশ্লেষকরাও বলেছেন, আপাতদৃষ্টিতে ওই সময় জিদানের অনড় অবস্থানটিকে গোয়ার্তুমি বলে মনে হলেও ম্যাচ শেষে এটিই প্রমাণিত, পূর্ণ শক্তির দল পেলে ওই রিয়ালই প্রতিপক্ষকে নিয়ে ছেলেখেলা করার ক্ষমতা রাখে। জিদানের সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনার মুখে ছিলেন ‘দি বেস্ট’ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও। গোলক্ষরায় ভুগতে থাকা পাঁচবার ব্যালনজয়ী ওই তারকার রিয়াল অধ্যায়ের সমাপ্তিও দেখে ফেলেছিলেন অনেকেই। কিন্তু হার না মানা মনোভাবের জন্য যিনি বিশ্ব দরবারে পরিচিত তিনি এত সহজেই পরাজয় মেনে নেন কী করে! গতকাল শুরু থেকেই গোলের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিলেন তিনি। একটা সময় মনে হচ্ছিল, ভাগ্যও বোধহয় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়লেন না। একটি নয়, দুটি গোল করে পুনরায় জানিয়ে দিলেন, তার বিদায় যে ৭০ শতাংশ সমর্থক চাইছিল তারা কতটা ভুল।