যদি মনে করেন ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সফরকে ভারতের সব মত ও পথের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে তাহলে আপনি ব্যাপক ভ্রান্তিতে আছেন। ইসরায়েল ও ভারতের মিডিয়া কেবল দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীদের অফিস থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিগুলোর ওপর ভিত্তি করে তাদের সাজানো-গোছানো প্রোপাগান্ডায় যা ইচ্ছা যোগ-বিয়োগ করে তারা প্রচার করে। আসলে ওই সফরে কিছু সাধারণ ব্যাপার ছিল। যেমন- তাজমহল পরিদর্শন, গান্ধীর সবরমতি আশ্রমসহ গান্ধীর সমাধিতে হাজির হওয়া। ওই তালিকায় আরো ছিল একটি প্রযুক্তি কেন্দ্র উদ্বোধন ও নানান ব্যবসায়ী নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ। কিন্তু গণমাধ্যমগুলো নেতানিয়াহুর ভারত সফরের মূল উদ্দেশ্য বিষয়ে কোনো কথা তো তারা বলেইনি, উপরন্তু নেতানিয়াহুর ভারত সফরটিকে যারা বিরোধিতা করে ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন তাদের বিষয়েও এই গণমাধ্যমগুলো ছিল মূক ও বধির।
অস্ত্র চুক্তি
ফিতা কাটা আর ধুমধাম অনুষ্ঠানের আড়ালে গণমাধ্যম যে আলোচনা আমাদের নজরে আনতে ব্যর্থ হয়েছে তা হচ্ছে দু’দেশের মধ্যে আলোচিত অস্ত্র চুক্তি। লক্ষণীয় যে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ভারত তার মোট অস্ত্রের ৪১ শতাংশ আমদানি করেছে ইসরায়েল থেকে। মিডিয়ায় যে আলোচনা ’ব্যবসায়ী নেতা’দের বলে প্রচার করা হচ্ছিল সেটি ছিল অস্ত্র প্রস্তুতকারক ও ঠিকাদারদের মধ্যেকার আলোচনা এবং নীল সুট ও সিল্ক টাই পরা যুদ্ধ ব্যবসায়ীদের ওই বৈঠক তো কোনো ব্যবসার ছিল না, ছিল যুদ্ধের। ওই বৈঠকে কী কী আলোচনা হয়েছে তাও আমাদের জানা জরুরি।
‘১৭ সালের এপ্রিলে ভারত-ইসরায়েলের মধ্যে দুই বিলিয়ন ডলারের সামরিক অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এই ২ জানুয়ারি ভারত সরকার ৫০০ মিলিয়নের ট্যাংকবিধ্বংসী মিসাইল কিনতে অস্বীকৃতি জানায় ইসরায়েলের অস্ত্র কোম্পানিগুলোর কাছে। নেতানিয়াহুর এই সফরে তিনি ওই চুক্তি আবার আলোচনার টেবিলে আনতে চেয়েছেন। মনে হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদিও হয়তো ২ জানুয়ারির নোটিশ ভুলে যেতে ইশারা করেছেন নেতানিয়াহুকে। এ কারণেই হয়তো মোদিকে ভারতের সরকারি সামরিক প্রতিষ্ঠান ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের বিপক্ষে এসে কথা বলতে হয়েছে। এখানে এই সামরিক প্রতিষ্ঠান ভারত সরকারের ’নিজ দেশে বানাই’ নীতির পক্ষে কাজ করছে। ভারত ওই ট্যাংকবিধ্বংসী মিসাইল তৈরিতে নিজেদের প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পারতো। এর বদলে তাদের এখন ইসরায়েলের প্রযুক্তি কিনতে হচ্ছে। তাই বলা যায়, অস্ত্রই ওই দুই দেশের সম্পর্কের প্রাণ, বাকি সব গৌণ। না হলে শুধু অস্ত্রের চুক্তি হওয়াটা দৃশ্যত সবার কাছে খারাপ ঠেকতো। মোদি ও নেতানিয়াহু- দু’জনই বেশ প্রদর্শনপ্রিয়। প্রোপাগান্ডার শিল্পকলা তাদের কাছে দুধভাত। হয়তো অস্ত্র চুক্তির জন্য তাদের সম্পর্কেতোরা কোনাে ভাটা দেখতে চাননি। নিজেদের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে তাদের দেশকে এক সঙ্গে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান তারা।
সামরিক প্রতিষ্ঠান ভারত সরকারের ‘নিজ দেশে বানাই’ নীতির পক্ষে কাজ করছে। ভারত এই ট্যাংকবিধ্বংসী মিসাইল তৈরিতে নিজেদের প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পােরতো। এর বদলে তাদের এখন ইসরায়েলের প্রযুক্তি কিনতে হচ্ছে। তাই বলা যায়, অস্ত্রই ওই দুই দেশের সম্পর্কের প্রাণ, বাকি সব গৌণ। না হলে শুধু অস্ত্রের চুক্তি হওয়াটা দৃশ্যত সবার কাছে খারাপ ঠেকতো। মোদি ও নেতানিয়াহু- দু’জনই বেশ প্রদর্শনপ্রিয়। প্রোপাগান্ডার শিল্পকলা তাদের কাছে দুধভাত
গান্ধী ও ফিলিস্তিন
সম্ভবত পুরো ভারতে সবচেয়ে অপব্যবহৃত চরিত্র হচ্ছে মহাত্মা গান্ধী। যিনি অর্থবিত্তকে সর্বদা নগণ্য ভাবতেন এবং অবাধ পুঁজিবাদের বিপক্ষে ছিলেন সরব সেই গান্ধীর ছবি এঁকে দেয়া হেলো ভারতের সব নোটে। ১৯৩১ সালে গান্ধীকে একবার ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর বিষয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে ভারতকে দুনিয়ার সবচেয়ে ‘ছোট সেনাবাহিনীর দেশ’ হিসেবে দেখতে চান বলে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন তিনি। আজ ভারতের সেনাবাহিনী রিজার্ভের দিক দিয়ে সারা বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। আর সেনাবাহিনীতে বছরে প্রায় ৫৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের মধ্য দিয়ে ভারত সারা বিশ্বের সেনাবাহিনীতে ব্যয়ের তালিকায় পঞ্চম স্থান দখল করে নিয়েছে। এছাড়া অস্ত্র আমদানিকারক হিসেবে দুনিয়ায় ভারত এক নম্বর। এরপর আছে সৌদি আরব।
নেতানিয়াহুকে সেই মোদি নিয়ে গেছেন সবরমতি নদীর পাশে গান্ধীর মূল আশ্রমে। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় উপনিবেশবাদ বিরোধী নেতা গান্ধীর সমাধিতে। নেতানিয়াহুকে সেখানে নেয়ার মাধ্যমে গান্ধীকে কেবল দৃশ্যত অসম্মানিতই করা হলাে। গান্ধীর সম্মানার্থে নেতানিয়াহুর ওই আশ্রম ও সমাধিস্থল পরিদর্শন করার মতাে ভয়ানক সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে কারণ কেবল তাদের অস্ত্র চুক্তিটি পর্দার আড়ালে নিয়ে আসা নয়, এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনের প্রতি গান্ধীর সহমর্মিতা জনগণের চোখের আড়াল করে দেয়া।
১৯৪৮ সালে গান্ধী লিখেছেন, ‘ফিলিস্তিন আরবদের ভূখণ্ড, ইহুদিদের এখানে জোর করে আনা অমানবিক ও ভুল’। তিনি এই কথাগুলো বলেছিলেন যখন উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলনরত ছিলেন। তার মতে, ইউরোপ চাইলেই নিজের মতাে করে ফিলিস্তিনিদের নিজেদের আবাস থেকে তাড়িয়ে ইহুদিদের সেখানে বসতি গড়তে দিতে পারে না। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের দু’বছর আগেই গান্ধী লিখেছে, ‘ইহুদিরা কেন আমেরিকার টাকা আর ব্রিটেনের অস্ত্রে এমন এক জায়গায় বসতি গড়তে যায় যেখানে তারা অনাহূত? আর কেনই বা তারা সেখানে সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়ে এই দখলদারিত্ব করছে?’ এই আলাপের সময় হয়তো গান্ধীর মাথায় হাগানাহ ও ইরগুনের মতাে সংগঠনের নাম মাথায় ছিল যারা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ও ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের দখলদারিত্ব বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল। গান্ধীর এই ফিলিস্তিন বিষয়ক দর্শনের ব্যাপারে মোদি কোথাও মুখ খোলেননি। আসলে তো দুটি দেশ অস্ত্র চুক্তি করার পথে বেশ দূর এগিয়ে গেছে।
প্রতিবাদমুখর ভারত
নেতানিয়াহুর ভারত সফর কেন্দ্র করে সারা দেশে নানান বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক ও ফিলিস্তিনপন্থী নানান সংগঠন মিলে নতুন দিল্লিতে বিরাট র্যালির আয়োজন করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নেতা প্রকাশ কারাত বলেন, ”নেতানিয়াহুকে দাওয়াত করার মধ্য দিয়ে মোদি ‘ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনে দখলদারিত্বকে হালাল করবার চেষ্টা করেছেন’।” এমনকি ট্রাম্প পর্যন্ত ইসরায়েল সফরের সময় পশ্চিমতীর সফর করেছিলেন বলে তিনি জানান। কিন্তু মোদি যখন ইসরায়েল সফরে গেলেন তখন তিনি ফিলিস্তিনকে এক রকম ভুলেই গেলেন। ফিলিস্তিনিদের প্রতি মোদির এই সচেতন নীরবতা আসলে ভারতের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা থেকে ফিলিস্তিনকে মুছে দেয়ারই নামান্তর।
নেতানিয়াহু মুম্বাইয়ে বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে এক সাক্ষাতে মিলিত হন। ওই অনুষ্ঠানে হঠাৎ করে একটি সেলফিতে দেখা গেছে, নেতানিয়াহুর সঙ্গে অমিতাভ বচ্চন, অভিষেক বচ্চন, বিবেক ওবেরয়, প্রযোজক রাজনায়েক ও রনি স্ক্রুয়ালাসহ অনেককে। ওই ছবিতে সবাই ছিলেন বেশ হাসি-খুশি। একজন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলতে কারো কোনাে দ্বিধাবোধ ছিল না। তবে বলিউডের সবাই ওই বাতাসে পাল ওড়াননি। ভারতের পুরস্কারজয়ী তথ্যচিত্র নির্মাতা আনন্দ পতবর্ধন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাতের পরিবর্তে ইসরায়েল বিরোধী র্যালিতে অংশ নিয়েছেন। তাকে ওই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করায় তিনি কম কথায় যা বলেন তা হলো, ‘সব হিসাবেই বলিউডের হর্তাকর্তাদের অনেকেই ফিলিস্তিনের পায়ে পিষে নেতানিয়াহুর দাওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই হাজির হবেন। তবে যেটি দেখার মতাে তা হলাে, এর মধ্য দিয়ে এক নির্মম সম্পর্কের সূচনা হলাে।ওেই সম্পর্কের একপাশে আছে উগ্রবাদী সশস্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজন আরেকপাশে সিনেমা জগতের হর্তাকর্তা যারা তাদের অঢেল অবৈধ সম্পত্তি পানামার মতাে জায়গায় বিভিন্ন সময় সরায়। তাই তাদের কাছ থেকে ফিলিস্তিনে আশ্রয়হীনদের পক্ষে ইনসাফের লড়াই করার আশা করাটা একেবারেই অরণ্যে রোদন।’
লেখক : বিজয় প্রসাদ, প্রধান সম্পাদক, লেফটওয়ার্ড বুকস। লেখাটি আলজাজিরা ইংরেজি ভার্শনের মতামত বিভাগে প্রকাশিত হয়