গলি থেকে এভারেস্ট জয় করা প্রত্যেকের একটা গল্প থাকে, থাকে নিজস্বতা। কাঠখড় পোঁড়াতে হয়, চিনতে হয় নিজেকে। সবার প্রতিভা কি ঐশ্বরিক নাকি পরিশ্রমের ফসল? বিতর্ক হতে পারে। তবে কারো কারো প্রতিভার চূড়ান্ত বিকাশে আমরা হতাশ হই! প্রতিভার বিকাশে প্রফুল্লিত হবার কথা। নামটা যদি হয় ‘রোনালদিনহো গাউচো’, হতাশাই ভর করে। ইস! যদি আরেকটু দেখা যেত তার প্রতিভার ঝলক! রোনালদিনহোকে ঘিরে ভাবনাটা এমনই। তিনি এমন একজন যাকে বিংশ শতাব্দীর মহারথীদের সাথে তুলনা করা হত। তিনি এমন একজন যার সাথে একবিংশ শতাব্দীর বহু অতিমানবকে তুলনা করাটাও তুচ্ছ মনে হয়। তিনি এমন একজন যিনি ধুলো উড়িয়েছেন আকাশে, রূপান্তর করেছেন মেঘে, মেঘ ঝরেছে বৃষ্টি হয়ে। তৃপ্তির, স্বচ্ছতার।
দিন কয়েক আগে সবধরণের ফুটবল থেকে অবসর নেয়া দুইবারের ব্যালন ডি’অর ও বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল এবং বার্সার জীবন্ত কিংবদন্তি ‘দিনহোকে’ নিয়ে সামান্য চর্চা করা যাক। তার পাঁচটি দিক নিয়ে এগোবো যা আপনি জানলেও জানতে পারেন। ব্যক্তিটি যখন রোনি, তখন তাকে বারংবার পাঠে মুগ্ধতা বাড়ে।
ব্যক্তিত্ব
‘রোনালদো ডি অ্যাসিইস মোরেইরা’। একজন দুর্ধর্ষ ফুটবলার, একজন নিরেট ভদ্রলোক। ফুটবল মাঠের আগ্রাসী তারকা মাঠের বাইরে নিরব। খুনে চেহারার এক্সপ্রেশনে বিপক্ষের কপালে চিন্তার ভাঁজ তোলা রোনি খেলা শেষে হাস্যরসে ভাঁজ খুলতেও জানেন। তিনি একজন দানবীর, সমাজসেবী। নানান চ্যারিটি, ট্রাস্টে দান করেন হাত খুলে। ইউ এনএইডস এর শুভেচ্ছাদূত হিসেবে এইচঅাইভি সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেন, মানবতার জন্য খেটে যান নিরলসভাবে। খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে ভোলেননি অস্তিত্ব, যা তাকে নিয়ে গেছে আরো সুউচ্চে। গোটা ক্যারিয়ারের পাঁচ শতাধিক ম্যাচে মাত্র তিনটে লালকার্ড প্রমাণ করে তিনি কেমন!
ট্যারা রোনি
দেঁতো দিনহোকে চিনেন, ভাবছেন ট্যারাটা আবার কে? ভয়ের কিছু নেই। এ স্রেফ উপমা, প্রতীকী ব্যবহার। ট্যারা শব্দটি সবারই পরিচিত। যারা ট্যারা তারা একদিকে তাকালে মনে হয় অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন। ইতস্ততভাবে মাঝেমধ্যেই আমাদের খেই হারিয়ে যায়, হয়ে যাই হতভম্ব। অনুরূপভাবে, মাঠে রোনালদিনহোও ভড়কে দিতেন বিপক্ষকে। একদিকে তাকিয়ে অন্যদিকে সফল পাস দেয়ায় তিনি অনবদ্য। বিপক্ষ কিছু বুঝে উঠার আগেই সর্বনাশের উদ্দেশ্যে বন্ধুর কাছে বলটা পাঠিয়ে দিতেন তিনি।
ড্রিবলিং
লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। চলতি শতাব্দীর চলন্ত সময়ের জাদুকর। ড্রিবলিংয়ে অনন্য, সময়ের সেরা। কয়েক মৌসুম আগে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে বায়ার্নের জেরোম বোয়াটেংকে দেয়া নাটমেগ ফুটবলভক্তরা সহজে ভুলবে না। জানেন কি, মেসির আদর্শ রোনালদিনহো নামের ভদ্রলোক? বোধকরি এরপর আর কিছু বলার থাকে না। তবু বলতে হয়। ফুটবলটা যেমন তার পায়ে গেলে কথা বলতো। যেভাবে, যেদিকে, যখন চাইতেন চর্মগোলক লেগে থাকত পায়ে। যেন মমতা মাখানো পা বলছে, তুই তৈরি? মনিবের প্রশ্নে তৎক্ষনাত জবাবে বলটাও বলত, জ্বি হুজুর! তারপরও সন্দিহান মনের অভাব নেই। তবে প্রযুক্তির যুগে সার্চ ইঞ্জিন গুগলও সহজলভ্য। একবিংশ শতাব্দীর সেরা ড্রিবলার নিঃসন্দেহে রোনি, গুগলেও মিলবে সত্যতা।
দক্ষতা
মেসিকে আবার আনা যাক। বার্সার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলস্কোরারের প্রথম গোলের অ্যাসিস্টমেকার ছিলেন দিনহো। বেরসিক রেফারি তা অফসাইডে বাতিল করে দেন। বার্সার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলস্কোরারের প্রথম গোলের অ্যাসিস্টমেকার ছিলেন দিনহো। ইচ্ছে করেই লাইন রিপিট করা। কেননা, মেসির করা পরের গোল বাতিল হয়নি। আগেরটির মত এবারও বামপ্রান্ত ধরে এগিয়ে এসে পাস দেয়া ব্যক্তির নাম রোনালদিনহো’ই। মূহুর্তে স্টাইল পরিবর্তন, চকিতে চোখে হারানো, ঘোমটার আড়ালে নয়, প্রকাশ্যেই খেমটা নাচাতে সিদ্ধপুরুষ ছিলেন তিনি।
আইডল
সত্তরের দশকের রিভেলিনো থেকে নব্বইয়ের রোমারিও, সতীর্থ রোনালদো, রিভালদো হয়ে শত্রুশিবিরের ম্যারাডোনা সবাইকে একই মোহনায় মিলিয়েছেন রোনি। তার আদর্শ হিসেবে! এতজনকে আদর্শ মেনেছেন বলেই কি না কে জানে সকলের দোষগুণ মিলিয়ে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন বিধ্বংসীরূপে।
অথচ এমন ভয়ংকর চেহারাকেও আপন করে নিয়েছে এমনকি প্রতিপক্ষের তারকারা। বার্সার যে ক’জন চিরশত্রু রিয়াল মাদ্রিদের কাছ থেকে স্ট্যান্ডিং অভেশন পেয়েছেন তন্মধ্যে তিনি অন্যতম। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ত্রিফলা আক্রমণের ‘থ্রি আর অস্ত্রে’র একজন দিনহোর নিন্দুক খুঁজতে প্রয়োজন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের, তাতে যদি দুয়েকজন ধরা পড়ে! মাত্র ১৩ বছর বয়সে নিজ দলের ২৩-০ গোলের ব্যবধানে জয়ী হওয়া ম্যাচে সবকটা গোল করে পাদপ্রদীপের আলোয় আসা কিংবদন্তি রোনালদিনহো ফুটবল খেলাকে নিজের আপন পায়ে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে নিয়েছেন ক্যারিয়ারজুড়ে, সুমিষ্ট হাসিতে।