• ১৬৩ রানের ব্যাবধানে শ্রীলংকাকে হারালো বাংলাদেশ; রানের ব্যাবধানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়।
• প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১১ হাজার রানের মালিক হলেন তামিম।
• যুগ্মভাবে সবচেয়ে কম ইনিংস খেলে ১ হাজারি ক্লাবের সদস্য হলেন এনামুল; অপরজন শাহরিয়ার নাফিস। লেগেছে ২৯ ইনিংস।
• দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসাবে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১০ হাজার রানের মালিক হলেন সাকিব। চলতি টুর্নামেন্টে টানা দ্বিতীয় বারের মতো ম্যাচ সেরা হলেন তিনি।
• তৃতীয়বারের মতো একই ইনিংসে অর্ধশতক পেলেন তামিম, সাকিব, মুশফিক। তিনবারই জয়ের হাসি হেসেছে বাংলাদেশ।
• প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে সব ফরম্যাট মিলিয়ে ৩০০ ম্যাচ খেললেন মুশফিক।
• ২০ তম বাংলাদেশি হিসাবে ১ হাজারি ক্লাবের সদস্য হলেন সাব্বির।
রুবেলের বলে ধনাঞ্জয়ার ক্যাচটি নিতেই উল্লাসে মেতে উঠলো সাকিবসহ পুরো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আফ্রিকা সফরের আগে ছুটি নেয়া সাকিবের নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন নব্য দায়িত্বপ্রাপ্ত লংকান কোচ হাথুরু। কাল পুরোটা ম্যাচ জুড়েই সে সাকিবের হাতে অসহায় ভাবে দেখলেন নিজের নতুন শিষ্যদের নাস্তানাবুদ হবার দৃশ্য। ব্যাট হাতে ৭ চারে ৬৩ বলে ৬৭ রান; বল হাতে ৪৭ রানে ৩ উইকেট; সরাসরি থ্রোতে চান্দিমালকে রান আউট এবং ম্যাচের সমাপ্তিটানা সে ক্যাচ; কোথায় ছিলেন না সাকিব? লংকান ক্রিকেটাররা যদি ঘুমের ঘোরেও সাকিবকে স্বপ্নে দেখে থাকেন অবাক হবার কিছু থাকবে না।
বদলে যাওয়া ব্যাটিং লাইন-আপ
গত দু ম্যাচে বাংলাদেশ দলের সাফল্যের পিছনে অন্যতম মূল ভুমিকা ব্যাটসম্যানদের। আর এই সাফল্যের পিছনের অন্যতম কারণ ব্যাটিং লাইন-আপ এ বদল এবং সঠিক কম্বিনেশনটি খুজে পাওয়া। তিন নাম্বারে সাকিবকে খেলানোর সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের ব্যাটিং গভীরতা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। সবচেয়ে লক্ষনীয় বিষয় যেটি তা হলো জবরদস্তি কাউকে কোনো পজিশনে খেলানোর বদলে যিনি যে জায়গার জন্য উপযুক্ত তাকে সেখানে খেলানোর বিষয়টি। তিন নাম্বারে সাব্বিরের মতো পিঞ্চ হিটারকে খেলানো ছিলো আত্মঘাতি। তিন নাম্বারের একজন ব্যাটসম্যানের মূল ভুমিকা থাকে দলকে একটি শক্ত ভিত্তির উপরে দাড়াতে সাহায্য করা। এ পজিশনে একজন পিঞ্চ হিটার না বরং পার্টনারশিপ গড়তে সক্ষম এমন খেলোড়াররাই হন প্রথম পছন্দ। স্বাভাবিক নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে তিনে সাব্বিরকে খেলানো যেমন দলের কোনো কাজে আসেনি তেমনি তার নিজের ক্যারিয়ারও চলে যাচ্ছিলো হুমকির মুখে। কালকে সাতে নেমে ছোট্ট কিন্তু কার্যকর ক্যামিওটি ভুমিকা রেখেছে একটি চ্যালেঞ্জিং সংগ্রহ দাড় করাতে। একই সাথে দলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওপেনিং এর অপরিহার্য হয়ে পরা পরিবর্তনটিরও সুফল দেখা গিয়েছে এ ম্যাচে। দীর্ঘদিন রানক্ষরায় ভোগার পরেও সৌম্যকে খেলানো; এবং তার দ্রুত বিদায় শুরুতেই চাপে ফেলে দিত বাংলাদেশকে। হ্যা, কালকের ছোট ইনিংসটিতে এনামুল স্বাচ্ছ্যন্দের সাথে খেলতে পারেননি ঠিকই। তারপরও ওপেনিং এ আসা ৭১ রানের জুটিটি সাহায্য করেছে পরের ব্যাটম্যানদের নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে। দীর্ঘদিন উপেক্ষিত থাকা এনামুলকে নিয়ে সমালোচনা করার জন্য এটি এখনও উপযুক্ত সময় না। অন্তত এই সিরিজটিতে তাকে তার স্বাভাবিক খেলাটা খেলার স্বাধীনতা দেয়া উচিত ম্যানেজম্যান্ট এর। ইতিবাচক সবকিছুর ভীড়ে নেতিবাচক যদি কিছু থাকে তা হলো তামিম-সাকিবদের বড় ইনিংস খেলার সম্ভাবনা জাগিয়েও তা কাজে লাগাতে না পারা। তবে, নিয়মিত রানের মধ্যে থাকলে এ সমস্যাটিও দ্রুতই কেটে যাবে বলে আশা করা যায়।
নাসিরের সঠিক ব্যবহার
বহু সম্ভাবনা জাগিয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নিলেও নানাবিধ কারণে এতদিন উপেক্ষিত ছিলেন নাসির হোসেন। প্রশ্নাতীত ভাবে বাংলাদেশের সেরা ফিল্ডার নাসির। সাথে বোলিং এ ব্রেক থ্রু এনে দেয়ার ক্ষমতা তাকে আরো কার্যকর করে তুলেছে। সেই সাথে যদি দ্রুত রান তোলার কায়দাটা কব্জা করতে পারেন নিঃসন্দেহে তিনি হয়ে উঠবেন এক দারুণ সম্পদ। বহুদিন ধরেই একজন মানসম্পন্ন অফ স্পিনারের খোজে রয়েছে বাংলাদেশ। মেহেদী মিরাজকে দিয়ে চেষ্টা করা হলেও সবদিক মিলিয়ে নাসির তার চেয়ে বেশ এগিয়ে। এখন, শুধু যদি আবারো কর্তাদের খামখেয়ালির কোপে না পরেন তাহলে বাংলাদেশ শুধু একজন কার্যকর বোলারই পাবে না ব্যাটিংয়ের গভীরতাও বাড়বে বহুগুণ।
যোগ্যতার ভিত্তিতে দল বাছাই
মাঝে ফর্ম বা যোগ্যতা আমলে নেবার বদলে ম্যানেজমেন্ট এর পছন্দের মুখদের নিয়ে গড়া দলকে নিয়েই মাঠে নামতে দেখা গিয়েছে বাংলাদেশকে। দেখা গিয়েছে পছন্দের খেলোড়ারদের সুযোগ দিতে যোগ্যদের দিনের পর দিন বাইরে বসিয়ে রাখার দৃশ্য। যেমন, একই পজিশনের খেলোড়ার হলেও লিটন এবং এনামুলের মধ্যে ক্রমাগত ব্যার্থ লিটনকেই বারবার সুযোগ দেয়া হলেও উপেক্ষিত থাকতেন এনামুল। একই অবস্থা দেখা গিয়েছে নাসিরের বেলায়ও। ঘরোয়া লিগে নিয়মিত পারফর্ম করলেও নাসিরের জায়গায় কখনো দেখা গিয়েছে শুভাগতকে কখনো বা মোশাররফ রুবেলকে। অথচ, অজানা কারণে, উপেক্ষিত থেকে গিয়েছেন নাসির। শুভাগত ঠিক কোন যোগ্যতায় জাতীয় দলে খেলেছেন এ প্রশ্ন এখনো ঘুরে ফিরে সমর্থকদের মাঝে। এবার বহুদিন পর ব্যাতিক্রম দেখা গেলো। ঘরোয়া আসরে নৈপুণ্যের পুরষ্কার স্বরুপ দলে ফিরেছেন এনামুল-নাসিররা। ডাক পেয়েছেন ঘরোয়া আসরে আলো ছড়ানো সানজামুলও। স্বেচ্ছাচারিতার বদলে যোগ্যদের দিয়ে দল গড়লে তার সুফল যে হাতেনাতেই মিলে তা দেখা যাচ্ছে চলতি টুর্নামেন্টেই।
প্রতিপক্ষ মাথায় রেখে একাদশ নির্বাচন
স্পিনে দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দু প্রান্ত থেকেই স্পিনার ব্যবহার করে সফল হবার পরেও পরের ম্যাচেই সানজামুলকে বসিয়ে সাইফুদ্দিনকে খেলানো ছিলো কার্যকর এক সিদ্ধান্ত। যদিও শ্রীলংকার অসহায় আত্মসমর্পণ মাশরাফিরা আগেই নিশ্চিত করে ফেলায় সাইফুদ্দিন দলের জয়ে ভুমিকা রাখার তেমন সুযোগ পাননি, কিন্তু প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে দল সাজানোর এই সিদ্ধান্তটি ছিলো প্রশংসার যোগ্য। হ্যা, হয়তো নিয়মিতই এমন বড় জয় বাংলাদেশ পাবে না, সবাই সবদিন সফলও হবে না; কিন্তু এতদিন পর এই যে অনুধাবনটা, এটা বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে সাহায্য করবে বেশ ভালোভাবেই।
অধিনায়ক মাশরাফি এবং বোলারদের ছন্দ
অধিনায়ক হিসাবে মাশরাফির গুণগান বহুবার বহুভাবে করা হয়েছে। শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচটিতেই তার বোলিং পরিবর্তন এবং ফিল্ডিংয়ের সময় আক্রমণাত্বক মনোভাব আবারো যেন নতুন করে প্রমাণ করলো যে এখনো মাশরাফির বিকল্প কেউ নেই। টানা আট ওভারের স্পেলে টপ অর্ডারকে ধসিয়ে দেয়া, বোলার নাসিরের সঠিক ব্যবহার, প্রয়োজনীয় সময়ে কার্যকর বোলিং চেঞ্জ, এবং টেল এন্ডারদের ভরকে দেয়ার মতো আক্রমণাত্বক ফিল্ডিং সাজিয়ে শ্রীলংকান দলে পুরোটা সময়ই রেখেছিলেন ম্যাচের বাইরে। বাংলাদেশের বোলিং ভবিষ্যত ভাবা হচ্ছিলো যাকে সেই মোস্তাফিজের ফর্মে ফেরাটাও সুফল বয়ে আনছে বাংলাদেশের জন্য। সাথে রুবেলের তূণে নতুন তীর; ফলার মতো ধেয়ে যাওয়া ইয়র্কার বাংলাদেশের বোলিং শক্তিকে করে তুলেছে আরো শক্তিশালী।
অবাধে খেলার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে সাবেক কোচ হাথুরুকে নিয়ে কিছু বলতে চাননি সাকিব। কিন্তু তার একটি মন্তব্যতেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে চলতি সিরিজে দুর্দান্ত বাংলাদেশ এবং গেলো বছরের শেষে আফ্রিকা সফরের মধ্যকার পার্থক্য। সে সফরে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করা প্রসঙ্গে তৎকালীন বাংলাদেশ টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম বলেছিলেন এটা কোচের সিদ্ধান্ত। কালকে সাকিব বললেন খেলোড়ারা আগের চেয়ে বেশী স্বাধীনতা নিয়ে খেলছেন এবং সময়মতো নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। এর আগে মাশরাফিও বলেছেন দীর্ঘদিন পরে দলে ফেরা এনামুল যেরকম স্বাধীনতা নিয়ে খেলেছেন এমনটিই চাওয়া। মূল কথা হচ্ছে, জেকে বসা অদৃশ্য চাপ থেকে মুক্ত বলয়ে বেড় হয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন খেলোড়াররা আর এটিই বদলে দিয়েছে বাংলাদেশকে।