বছরখানেক হলো ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছেড়েছে ব্রিটেন। ভোটের মাধ্যমে নির্ণিত এই নিয়তির মাধ্যমে ব্রিটেন একটি নিঃসঙ্গ রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করেছিল অনেকে। কিন্তু ওই আশঙ্কা রাষ্ট্রকে ছাপিয়ে ব্রিটেনের নাগরিকদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। প্রায় ছয় কোটি মানুষের দেশ ব্রিটেনের ৯০ লাখই নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করেন বলে ২০১৭ সালে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল কক্স কমিশন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এবার নিঃসঙ্গতা দূরীকরণ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করলো ব্রিটেনের কনজারভেটিভ সরকার।
গত বুধবার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নিঃসঙ্গতাটিকে আধুনিক সময়ে মানুষের সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা হিসেবে উল্লেখ করে তা নির্মূলের মাধ্যমে নাগরিকদের যথাযথ জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে পৃথিবীতে প্রথম ‘নিঃসঙ্গতা দূরীকরণ মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। আততায়ীর হামলায় নিহত ব্রিটিশ এমপি জো কক্স যার নেতৃত্বে মনোঃস্বাস্থ্য বিষয়ে কক্স কমিশন গঠিত হয়েছিল তার একান্ত স্মরণে এবং প্রতি দশজনে একজন মানসিক একাকীত্বে ভুগতে থাকা ব্রিটিশ নাগরিকদের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন থেরেসা মে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক বিবৃতিতে থেরেসা মে বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে আমাদের সমাজ থেকে সব বয়সের নিঃসঙ্গতা দূরীকরণে লড়াই করে যাবো এবং যারা নিজেকে সঙ্গীহীন ভাবেন, সবার কাছে মেলে ধরতে পারছেন না তাদের পাশে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হবে।’
প্রাথমিকভাবে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ট্রেসি ক্রৌচ-কে ওই অভিনব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি ডিমেনশিয়া, উচ্চ রক্তচাপসহ নানান রোগের প্রভাবক হিসেবে কনজারভেটিভ দলের ক্রৌচ কাজ করা আধুনিক সময়ের মহামারী নিঃসঙ্গতা নিয়ন্ত্রণে বদ্ধ পরিকর থাকবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
২০১৭ সালের কক্স কমিশনের রিপোর্টের আগেও নিঃসঙ্গতাটিকে মহামারী হিসেবে চিহ্নিত করে নানান গবেষণা প্রকাশ করে মনোবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্বাস্থ্য বিষয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্স-এর মতে, নিঃসঙ্গতা ঠাÐা-জ্বরসহ যে কোনো সাধারণ শারীরিক সমস্যা গুরুতর রোগে পরিণত করতে পারে। এ ছাড়া যারা পারিবারিকসহ নানান সঙ্গ উপভোগ করে তাদের বেঁচে থাকার হার অন্যদের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেড়ে যায় বলে জানিয়েছে এই বিষয়ে প্রকাশিত বেশ কিছু জার্নাল। দি ল্যান্সেট জার্নাল-এর মতে, একাকীত্বে ভুগতে থাকা ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তির হারও বাকিদের তুলনায় বেশি থাকে। কেননা নিঃসঙ্গ ব্যক্তিরা সামান্য রোগে আক্রান্ত হলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
শুধু তা নয়, একটি অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ‘এইজ ইউকে’র মতে, একটি দিন পুরো সময় নিঃসঙ্গ কাটানোর চেয়ে পুরো দিনে ১৫টি সিগারেট খাওয়া বরং কম ক্ষতিকারক। এ ছাড়া পরিসংখ্যান জানায়, পুরো ব্রিটেনে প্রায় দুই লাখ ব্যক্তি আছেন যারা গত এক মাস কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলেই কাটিয়ে দিয়েছেন। এ ধরনের নিঃসঙ্গতা হৃদযন্ত্রের নানান রোগসহ ডিমেনশিয়া, হতাশা ইত্যাদির কারণ হিসেবে কাজ করে বলে জানান মার্কিন সার্জন ও গবেষক বিবেক মুর্থি তার হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ-এর এক লেখায়।
ব্রিটেনের ওই মহামারী রোধে প্রস্তাবিত এই মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি নিঃসঙ্গতা দূরীকরণে কাজ করবে ওই দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাদের সাহায্য নিয়ে সমাজে নিঃসঙ্গতার প্রভাব ও কারণ চিহ্নিত করে তা সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে মন্ত্রণালয়।
ব্রিটেনে ওই মন্ত্রণালয় মাত্র স্থাপিত হলেও আরব আমিরাতসহ আমাদের পাশের দেশ ভারতে নিঃসঙ্গতা দূরীকরণে নিজস্ব দপ্তর কাজ করে বলে জানা গেছে।