দুই রাইট ভাইয়ের আকাশ জয়ের গল্প সবারই জানা। তাদের হাত ধরে আধুনিক বিমানের দেখা পেয়েছে পৃথিবীবাসী। প্রথম দিকের সেই অদ্ভুত দর্শন কাঠ আর কাপড় এর তৈরী যন্ত্র থেকে শুরু করে আজকের বোয়িং ড্রিমলাইনার; প্রযুক্তির উৎকর্ষে বহু আধুনিকায়ন হয়েছে আকাশ যোগাযোগে। গতি, নিরাপত্তা ও নকশায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। এ পথে হাঁটতে গিয়ে বহু চ্যালেঞ্জ এসেছে নকশাবিদদের সামনে। বিজ্ঞানী ও গবেষকদের যৌথ প্রচেষ্টায় সবসময়ই সমস্যার সমাধান মিলেছে। আজকে বিমানের বিবর্তনের দিকে আমরা তাকাই বিস্ময় ভরা চোখে। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবে নামিয়ে এনেছে মানুষ তাতে বিস্ময় জাগাটাই স্বাভাবিক।
তবে এখানেই থেমে নেই প্রযুক্তি। ভবিষ্যতের বিমান নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এটা আসলেই বলা মুশকিল আজকের দিনের বিমান কি করতে পারে আর কি পারে না। আজকে জানব বিমান নিয়ে ১১টি মজার তথ্য।
বিমানের কোথায় বসলে আপনি নিরাপদ?
বিমানের কোন আসনে বসলে আপনি সবচেয়ে নিরাপদ ভাববেন? কোনদিকে বসলে দূর্ঘটনায় ক্ষতি হবে না? আকাশ পথে দূর্ঘটনার পর বিমানের কোন দিকে সবচেয়ে কম ক্ষতি হয় তা বের করতে একটি গবেষণা করা হয় যার ফলাফল ছিল, বিমানের পেছনের দিকের মাঝখানের আসনগুলো ক্ষতি হওয়ার আশংকা তুলনামুলক কম।
অনেক হিসাব-নিকাশ করেও আসলে বের করা সম্ভব না বিমানেরর কোন অংশ বেশি নিরাপদ বা কোথায় বসলে দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা যাবে। কারণ এই সংখ্যা কখনো ধ্রুবক হবে না। তাই বলা যায় বিমানের কোনো আসনই সম্পূর্ণ নিরাপদ না।
বজ্রপাতের সময় বিমানে কি হয়?
বজ্রপাত আমাদের কাছে নতুন কিছু না। প্রতিনিয়ত আবহাওয়া খারাপ হলে আমরা বজ্রপাত ঘটতে দেখি। কিন্ত যখন আকাশে উড়তে থাকা বিমানে বজ্রপাত আঘাত হানে তখন কি হয়? বিমান চলাকালীন সময় বজ্রপাত আঘাত করে এবং তা প্রায়শই ঘটে থাকে। গবেষণায় দেখা যায় প্রতি ১ হাজার ঘন্টা উড্ডয়নকালে একটি বিমানে অন্তত একবার বজ্রপাত আঘাত করে। কিন্ত ১৯৬৩ সালের পর আজ পর্যন্ত বজ্রপাতের ফলে কোন বিমান ধ্বংস হয় নাই। এক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয় নির্মাণ প্রকৌশলীদের। বিমান নির্মাণ করাই হয় এমন ভাবে যেন বিমান বজ্রপাত মোকাবেলা করতে পারে। নির্মাণ কৌশল এর চমৎকারিতায় বিমানের কোন ক্ষতি সাধন না করেই বজ্রপাতের ইলেকট্রিক চার্জ উড়োজাহাজ এর মধ্য দিয়ে চলে যেতে পারে।
বিমানের ভেতরে শোবার ঘর
বিমান লম্বা সময় ধরে আকাশ পথ অতিক্রম করে। কিন্ত ঠিক কত সময় বিমান একটানা আকাশে থাক? অনেক সময় প্রায় ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত আকাশ পথ পরিক্রমা করতে হয়। কিন্ত একটানা এত লম্বা সময় কাজ করা নিশ্চয়ই সহজ কোনো কাজ না। তাই ক্রু দের কথা ভেবে বোয়িং ৭৭৭ বা ৭৮৭ ড্রিমলাইনার এর মত বিমান গুলো তে ছোট বেডরুম থাকে বিশ্রাম এর জন্যে। সাথে থাকে ওয়াশরুম এবং অনেক ক্ষেত্রে বিনোদনের ব্যবস্থা। কিন্ত আপনি চাইলেই খুজে পাবেন না এই রুমগুলো কারণ এর দরজা গোপন করা থাকে।
বিমানে খাবার এর স্বাদ
বিমানের খাবার সব সময় এমন স্বাদহীন লাগে কেন? ক্যাটারিং পরিবর্তন করলেই কি হয় না? আসলে ক্যাটারিং পরিবর্তন করলেও খুব যে সুবিধা হবে তা না। কারণ বিমানের খাবার এর স্বাদ না লাগার পেছনে দায়ী এর বদ্ধ পরিবেশ! অবাক হলেন? হ্যা বিমানের পরিবেশ এর কারণেই খাবার এর স্বাদ বোঝা যায় না। মিষ্টি খাবার কম মিষ্টি মনে হয় এবং লবণের পরিমাণ বেশি মনে হয়। ২০১৫ সালে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, বিমানের ভেতরের শুষ্ক আবহাওয়ার কারণেই খাবারের স্বাদ নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে যায়। আরও দেখা যায় মিষ্টি খাবারের মিষ্টতা বা খাবার এর লবণ এর স্বাদ নির্ধারণ করা প্রায় ৩০ শতাংশ কঠিন হয়ে যায় বিমানের ভেতরে।
বিমানের টায়ার কতটা মজবুত?
একটি বিমানের টায়ারের ক্ষমতা আশ্চর্যজনক। টায়ারগুলো প্রায় ৩৮ টন ওজন নিতে সক্ষম এবং ১৭০ মাইল প্রতি ঘন্টায় অবতরণ করলেও টায়ারের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নাই। এছাড়া টায়ার গুলো ২০০ পি.এস.আই চাপে ফুলানো হয় যা গাড়ির টায়ারের প্রায় ৬ গুণ বেশি। মজার ব্যাপার হচ্ছে উড়োজাহাজ এর টায়ার পরিবর্তন এর প্রক্রিয়া গাড়ির টায়ার পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মতই। জ্যাক দিয়ে বিমান উঁচু করে টায়ার পরিবর্তন করা হয়।
একটা ইঞ্জিনেই চলতে পারে বিমান
বিমানে দুটি ইঞ্জিন থাকে আমরা জানি, কিন্তু দুইটাই কি একসাথে চলে? হ্যা দুইটা ইঞ্জিনই একসাথে কাজ করে। কিন্তু যেকোন একটা থেমে গেলেও বিমান বন্ধ হয়ে যায় না। ইঞ্জিন থেমে যাওয়ার কথাটা শুনতে ভয়ানক লাগলেও একটা ইঞ্জিন থেমে গেলে তেমন কিছু হয় না। অপর ইঞ্জিনের মাধ্যমে চলতে থাকে। যদিও এক ইঞ্জিনে চলতে থাকলে বিমানের কার্যক্ষমতা কমে যায় কিন্ত এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার জন্য প্রস্তত করেই বিমান নির্মিত হয়। লম্বা দূরত্ব অতিক্রমের ক্ষেত্রে যেমন যেই সকল বিমান সমুদ্র অথবা উত্তর মেরুর মত জনমানুষহীন এলাকা পারি দেয় সেই বিমান গুলোর FAA কর্তৃক এক ইঞ্জিনে চলার মত সার্টিফিকেট (ETOP) প্রয়োজন হয়। যেমন বোয়িং ড্রিমলাইনার বিমান ETOP-330 স্বীকৃত। এর অর্থ এই বিমান এক ইঞ্জিনের মাধ্যমে ৩৩০ মিনিট অর্থাৎ সাড়ে ৫ ঘন্টা পর্যন্ত চলতে পারে।
শুধু তাই না, বেশির ভাগ বিমানই ইঞ্জিন ছাড়াই অনেক পথ যেতে পারে। নির্মাণ কৌশলের কারণে বিমান আকাশে ভেসে থাকতে পারে ইঞ্জিন ছাড়াই। অবাক শোনালেও একটা বোয়িং ৭৪৭ আকাশ পথে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। মাটি থেকে প্রতি ১ হাজার ফুট উচ্চতার জন্যে এই বিমান ২ মাইল পথ গ্লাইড করে অতিক্রম করতে পারে এবং একটা বিমান নিরাপদ এ অবতরণের জন্যে এই সময় যথেষ্ট।
বিমান অবতরণের সময় আলোর ভূমিকা
যারা বিমানে চড়েছেন কখনও কি খেয়াল করেছেন অবতরণের সময় বিমানের ভেতরের আলো কমিয়ে দেয়া হয়? হ্যা অবতরণের সময় আলো কমিয়ে দেয়া হয় এবং এর পেছনে রয়েছে যৌক্তিক কারণ। বিমান অবতরণের সময় দূর্ঘটনাবশত যদি কোনো গণ্ডগোল হয় তাহলে দ্রুত বিমান খালি করার প্রয়োজন পরে। আর ওই সময় বাইরের অন্ধকারের সাথে যেন চোখ সহজে খাপ খাওয়াতে পারে তাই বিমানের ভিতরের আলোও কমিয়ে রাখা হয়। এবং একই কারণে অবতরণের সময় বিমানের জানালার পর্দা উঠিয়ে দেয়া হয় যেন যাত্রীরা জরুরি বিমান খালি করার দরকার হলে দেখতে পারে বিমানের কোন দিক দিয়ে বের হওয়া অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হবে।
অক্সিজেন মাস্ক এর কার্যক্ষমতা মাত্র ১৫ মিনিট
আমরা সবাই তো জানি বিমানে অক্সিজেন মাস্ক থাকে। কিন্ত আসলে অক্সিজেন মাস্ক এর কাজ কি? পুরো যাত্রাই পরে থাকতে হবে না তো এই মুখোশ! জেনে হয়ত অবাক হবেন যে এই অক্সিজেন মাস্কগুলো আপনাকে মাত্র ১৫ মিনিট সময় যাবত অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম। কিন্ত এটা জেনে ভয় পাওয়ার কিছু নাই কারণ এই ১৫ মিনিটই যথেষ্ট। কারণ এগুলো আপনার সামনে নেমে আসবে শুধুমাত্র তখনই যখন একটা বিমান তার উচ্চতা হারায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস এর জন্যে অতিরিক্ত অক্সিজেন দরকার হয়। এমন অবস্থায় পড়লে অক্সিজেন মাস্ক নেমে আসে এবং পাইলট তখন বিমানকে আবার সঠিক উচ্চতায় নিয়ে আসে। আর এই কাজের জন্যে ১৫ মিনিট সময় কখনোই লাগে না।
বিমানের তিন স্তরের জানালার কাজ
বেশির ভাগ বিমানের জানালা তিন স্তর বিশিষ্ট, তার মধ্যে বাইরের স্তরের কাজ অবশ্যই বাইরের পরিবেশ থেকে বিমানের ভিতরে যেন কিছু না আসে এর জন্যে। আর মাঝের স্তরটা রাখা হয় প্ল্যান-বি হিসেবে। কোনো অবস্থায় যদি বাইরের স্তরটা ভেঙে যায় তাহলে মাঝের স্তরটা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিবে। আর এই মাঝের স্তরটা অটুট রাখতেই বিমানের ভিতরের দিকের স্তরটায় ছোট ছোট ছিদ্র থাকে। এই ছিদ্রগুলো মাঝের স্তরের বাতাসের প্রেশার ঠিক রেখে স্তরটা অটুট রাখে।
বিমানে ধুমপানে কড়াকড়ি
বিমানের পরিবেশ ঠিক রাখতে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা এড়াতে কয়েক বছর আগেই FAA কর্তৃক বিমানের অভ্যন্তরে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্ত তা সত্ত্বেও বিমানের বাথরুমে এশট্রে কেন থাকে? বিজনেস ইনসাইডার এর কারণ হিসেবে দেখায়, বিমানের নির্মান প্রকৌশলীগণ উপলদ্ধি করেন ধুমপান না করার নিষেধ থাকলেও এক সময় একজন ধূমপায়ী বিমানের অভ্যন্তরেই হয়ত প্রজ্জ্বলিত সিগারেট মুখে নিয়ে বসবেন। এবং এর থেকে ঘটতে পারে দূর্ঘটনা। তাই কোনো যাত্রী আইন অমান্য করে ধুমপান করলেও তা যেন অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা এড়িয়ে নিরাপদে করে তাই বাথরুমে এই এশট্রের ব্যবস্থা। কিন্ত সাবধান! বাথরুমে ধুমপান করলেও জরিমানা থেকে রেহাই পাবেন না।
বিমান এর পিছনে ধোয়ার লেজ
আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন বিমান যাওয়ার পর একটা ধোয়ার লেজ রেখে যায়। কিন্ত সবাই হয়ত লেজ দেখলেও এর কারণ সম্বন্ধে অবগত না। ধোয়ার মত দেখতে এই লেজটা ঘনীভবন এর কারণে সৃষ্টি হয় আর এর নাম হচ্ছে ‘কনট্রেইল’। বিমানের ইঞ্জিন থেকে পানি গরম হয়ে বাষ্প আকারে বের হয়। আর এই বাতাস যখন বাইরের অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা পরিবেশে এসে পড়ে তখন বাষ্প ঘনীভূত হয়ে এই সাদা ধোয়ার সৃষ্টি করে। এই একই কারণে আমরা শীতের সময় নিঃশ্বাস ছাড়ার ক্ষেত্রে সাদা ধোয়া দেখি।
Well written