এক বছরের বেশি সময় ধরে আমি নানাজনের বিশেষ করে ওয়াশিংটনের সরকারি কর্মকর্তা, লবিষ্ট, রিপাবলিক ঘরানার নানা বুদ্ধিজীবি-পণ্ডিতসহ কংগ্রেসের রিপাবলিকের সদস্যদের কাছ থেকে শুনছি যে ট্রাম্প নাকি আসলে একজন বদ্ধ উন্মাদ। আমি তাদের কথা বিশ্বাস করতে পারিনি কারণ কোন উন্মাদ-আহাম্মক ব্যক্তি কখনও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারে না। এমনকি জর্জ বুশ পর্যন্ত তার ক্যাম্পেইন এবং হোয়াইট হাউজ চালাতে সবসময় করিৎকর্মা লোকদের নিয়োগ দিতেন। এমনকি ছয় মাস আগে আমেরিকার স্টেট সেক্রেটারি রেক্স টিলারসন ট্রাম্পকে “গাধা” বললে সেটাও আমি আমলে নেইনি। কারণ আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি যেকোন প্রেসিডেন্ট এর সাথে কাজ করা কতটা হতাশাজনক, আরও যারা নানা সময়ে করেছেন তারাও ঠিক একইভাবে তাদের প্রেসিডেন্টকে চিত্রায়িত করে থাকবেন।
এবার তাহলে মাইকেল ওলফ এর ‘ফায়ার এন্ড ফিউরি’ বইটার আলাপে আসি যেখানে ওলফ দুশোরও বেশি লোকের স্বাক্ষাৎকার নিয়েছেন যারা নানাসময়ে ট্রাম্পের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাতে অনেক সিনিয়র কর্মকর্তার নামও ছিল। সেই বইয়ে ট্রাম্পকে ‘নেশাগ্রস্থ’ বলেছিল মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ম্যাকমাস্টার। আর মার্কিন জাতীয় কোষাধ্যক্ষ স্টিভ ম্যানোশিন এবং সাবেক সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান রেইন্স প্রিবাস দুজনই ট্রাম্পকে বলেছিলেন ‘আহাম্মক’।
রুপার্ট মারডক একধাপ এগিয়ে বললেন, ‘পাঁড় আহাম্মক’। ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তাকে আখ্যা দিয়েছেন ‘নিপাট গর্দভ’ হিসেবে। তিনি আরও বলেন, “ট্রাম্প জীবনে কোন বইয়ের এক পৃষ্ঠা পড়ে দেখেন না, এমনকি সামান্য মেমো থেকে গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারনী কাগজপত্র কোনকিছুই না। তিনি দেখা যায় প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নেতাদের সাথে আলোচনা অসম্পূর্ণ রেখেই উঠে চলে যান।” যখন তার নিজের নির্বাচনী ক্যাম্পেইন থেকে ট্রাম্পকে মার্কিন সংবিধান বুঝানোর চেষ্টা করা হল, তিনি সেটার চতুর্থ সংশোধনীর পর আর মনযোগ ধরে রাখতে পারলেন না।
ট্রাম্প অবশ্য নিজেকে বোকা ভাবেন না যে কারণে তিনি পুরনো দিনের ঘটনা স্মরণ করে বলেন, “আমি আইভি লীগ কলেজে পড়তাম, সেখানে আমি খুব ভাল করেছিলাম। আমি খুব বুদ্ধিমান।”
আসলে তিনি হয়ত অতটা মেধাবী ছাত্র ছিলেন না। তার শিক্ষক পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা-প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ট্রাম্পকে তার ‘জীবনে দেখা সবচেয়ে আহাম্মক ছাত্র’ বলেছেন। ট্রাম্পের জীবনী লেখক গোয়েন্ডা ব্লেয়ার যদিও জানিয়েছেন যে ট্রাম্পের বড় ভাইয়ের সাথে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের যোগাযোগের সুবাদে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ট্রাম্প।
“ট্রাম্প জীবনে কোন বইয়ের এক পৃষ্ঠা পড়ে দেখেন না, এমনকি সামান্য মেমো থেকে গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারনী কাগজপত্র কোনকিছুই না। তিনি দেখা যায় প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নেতাদের সাথে আলোচনা অসম্পূর্ণ রেখেই উঠে চলে যান।”
কিন্তু একটু ভাবুন। এভাবে ট্রাম্পকে ছোট করে দেখা হয়ত আমাদের সবার জন্যে বিপজ্জনক হতে পারে। উনি হয়ত বই পড়েন না, কোন যৌক্তিক তর্কের মধ্য দিয়ে যেতে পারেন না অথচ সবার আগ্রহের কেন্দ্রে থাকেন তিনি। অতএব তিনি অতটা বোকা নন। এটা আসলে একধরণের চতুরতা যাকে বলে ‘আবেগপূর্ণ চতুরতা’। এই ধারণাটি গড়ে ওঠে মূলত হ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জন মেয়ার এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিটার স্যালোভের হাত ধরে। এই নামে ১৯৯৬ সালে বই লিখে সেই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করেন ড্যান গোলেম্যান। মেয়ার এবং স্যালোভে মূলত এই আবেগপূর্ণ চতুরতাকে দুটি ব্যাপারের মধ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। সে দুটি হচ্ছে, “নিজেদের আবেগকে বুঝা এবং সেভাবে ব্যবস্থাপনা করা” এবং “অন্যের আবেগকে বুঝে নিজের চাহিদামত প্রভাবিত করা।” ট্রাম্প এ-দুটির প্রথমটি করতে দৃশ্যত ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি নিজে সবার কাছে পাতলা চামড়া-সর্বস্ব, আত্ম-প্রেমী এবং প্রতিহিংসাপরায়ন হিসেবে পরিচিত। রিপাবলিক-পন্থি আন্তর্জাতিক নীতি বিষয়ে অভিজ্ঞ পণ্ডিতরা অবশ্য তাকে বলেন, “তিনি সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করতে পারেন না বা চান না। তিনি কোন বিষয়ে বিরোধীমতকে প্রশ্রয় দেন না। তার আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অভাব আছে, কাজের ক্ষেত্রে তিনি একেবারেই বল্গাহীন। এবং তিনি একদম সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না।”
হ্যা। তবে সেই দুই মনোবিজ্ঞানীর দ্বিতীয় পয়েন্ট মানে অন্যদের আবেগকে প্রভাবিত করার ব্যাপারটি ট্রাম্পের ক্ষেত্রে খাটে। তিনি জানেন মানুষকে কিভাবে নিজের কাজে ব্যবহার করা যায়। অন্যের অন্তরের দুর্বলতাগুলো- ভীতি, চিন্তা, কুসংস্কারসহ যে সকল চাওয়া আছে সেসব সহজে আবিস্কার করার আর সেসব নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার এক অনন্য ক্ষমতা আছে তার। অন্যভাবে বলতে গেলে ট্রাম্প একজন অসাধারণ ধূর্ত লোক। শুরু থেকেই তার ধূর্তামি চলমান ছিল। তিনি হাজার হাজার ছেলে-মেয়েকে তার ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। নিয়মিত ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ব্যাংক থেকে পুনরায় ঋণ নিতে পেরেছিলেন নিজের ‘গুণে’। তিনি তার চতুরতা দিয়ে নানাভাবে কাজ দিতেন কনট্রাক্টরদের, তারপর তাদের আর চিনতেন না। হয়ত তিনি তার এই চতুরতা সবজায়গায় কাজে লাগাতে পারেন নি, পারলে তিনি আরও সফল হতে পারতেন।
১৯৭৬ সালে ট্রাম্প যখন ব্যবসার শুরুর পথটা হাটছিলেন, মূলধন হিসেবে হাতে ছিল বাবার দেয়া বিশ কোটি ডলার। অথচ তিনি এখন কাগজে কলমে ৮ শ’ কোটি ডলারের মালিক। তিনি যদি সেই বিশ কোটি ইনডেক্স ফান্ড করে আবার বিনিয়োগ করতেন, হিসেব বলে এতদিনে তিনি হয়ত ১২শো কোটির মালিক থাকতেন।
তবে সে কিন্তু রাজনীতিতেও তার এই চতুরতা চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও। তিনি মেক্সিকোর জনগণ, মুসলিম, আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক, বারাক ওবামা, হিলারিসহ নানা বিষয়ে “অবাককর”, “মধুর” কথা বলে আমেরিকার ৬২৯৭৯৮৭৯ সংখ্যক নাগরিককে নিজের কথায় বিশ্বাস করতে সফল হয়েছেন তিনি। তিনি তার এই চতুরতা চালিয়ে যাচ্ছেন সর্বময়।
ট্রাম্পের রাজনৈতিক চতুরতা তাই আজ তার বিশাল প্রতিভা। এ এমন এক প্রতিভা যা তার প্রকাশ্য আহাম্মকির সাথে মিলে আমেরিকাসহ সারা দুনিয়ার জন্যে বিপর্যয় ডেকে আনবে।
লেখক: রবার্ট রাইখ, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলের পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক। লেখাটি হাফিংটনপোস্ট এ প্রকাশিত হয়।
খুব ভালো অনুবাদ হয়েছে।
হাফিংটন পোস্টের লিংকটি সংযুক্ত করা যেতে পারতো….