গণস্বার্থের গণমাধ্যম দরকার

গণস্বার্থের গণমাধ্যম দরকার

যে কোনো শাসকশ্রেণি শুধু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বা বল প্রয়োগের মাধ্যমেই তার শোষণ-নিপীড়ন টিকিয়ে রাখতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন মতাদর্শগত আধিপত্যও। তা বিদ্যমান সব আধিপত্যবাদী ও বৈষম্যমূলক কাঠামোটি বুদ্ধিবৃত্তিক বৈধতা দান করে। এই মতাদর্শিক আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবেও ভূমিকা পালন করে গণমাধ্যম। আধিপত্য ধারণার সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্ক নিয়ে বহু আলোচনা ইতোমধ্যে হয়েছে।

‘হেজিমনির সাধারণ চর্চাটি বল প্রয়োগ এবং সম্মতির সম্মিলন হিসেবে দেখা হয় যেখানে বল প্রয়োগ ছাড়াই সম্মতির ওপর ভিত্তি করে শক্তি ও সম্মতির মধ্যে পারস্পরিক ভারসাম্য তৈরি করা হয়। বাস্তবিকই এমন প্রচেষ্টা নেয়া হয় যাতে অধিকাংশের সম্মতির ভিত্তিতে বল প্রয়োগ কার্যকর হয়। ওই সম্মতি তৈরি হয় জনমতের প্রতিভূ সংবাদপত্র ও সংঘের মাধ্যমে’- ইতালিয়ান বুদ্ধিজীবী আন্টোনিও গ্রামসি-র এ উক্তির মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের চরিত্রের প্রকৃতির স্বরূপ।
‘সম্মতি উৎপাদন’ প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম নির্ধারণ করে দেয় নাগরিকদের মতাদর্শ, রুচি-অভিরুচি, বোধ-বিশ্বাস। এই আরোপিত মতাদর্শ সমাজে তৈরি করতে পারে রাজনৈতিক ও কালচারাল ফ্যাসিজম। গণমাধ্যম যে সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখে এর সঙ্গে সমাজের সাধারণ বোধ, বিশ্বাস, চেতনা ও জীবন যাপনের তেমন সংযোগ নেই। ফলে গণমাধ্যম যে উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তের কালচার প্রমোট করে এর সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয় প্রান্তিক এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর কালচার ও বিশ্বাসে। এটিকে অরিয়েন্টাল ডিসকোর্স আকারে বর্তমানে পর্যালোচনা করো হয়। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ ‘কাভারিং ইসলাম’-এ এসব দিক নিয়ে দরকারি আলোচনা করেছেন। আমরা সেদিকে আলোচনা না করে সরাসরি সোজাসাপ্টাভাবে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে কথা শুরু করবো।

বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণির কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের নামে যে অপ্রতিনিধিত্বশীল ‘দর্শকের গণতন্ত্র’ অর্থাৎ দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র চালু আছে এটিকে আলাপ-আলোচনা, লেখনী-টকশোর মাধ্যমে আরো প্রতিষ্ঠিত ও মহিমান্বিত করা। এই শ্রেণিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলি, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বলি- এসব মতাদর্শটি আদর্শমান বলে প্রচার করে। শাসকগোষ্ঠীর যে কোনো অগণতান্ত্রিক ও আধিপত্যকামী কার্যকলাপও বৈধতা দেয়। তারা সমাজে ডেভেলপমেন্টাল ডেমক্রেসির পক্ষাবলম্বন করে প্রাণ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধনও জায়েজ করে নেয় উন্নয়নের নামে।

গণমাধ্যমের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি শেষ পর্যন্ত গণবিরোধী হয়ে ওঠে। এটি গণমানুষের ওপর সমাজের এলিট গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের বৈধতা দেয়। গণমাধ্যমের এই ভূমিকার ভিত্তিমূল প্রচলিত গণতন্ত্রের ধারণায় নিহিত আছে বলে মনে করেন নোয়াম চমস্কি। তার মতে, ‘গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদ কিংবা তথ্যের মাধ্যম খোলাখুলি ও স্বাধীন হওয়ার কথা থাকলেও যে গণতান্ত্রিক চর্চা বর্তমানে পরিলক্ষিত হয় এতে দেখা যাচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী শাসনকার্যে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নাকচ করার জন্য সংবাদমাধ্যমটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যেন শাসকশ্রেণির ডেমক্রেটিক ডমিনেশনের ব্যাপারে একটি সম্মতি আদায় করে নেয়া যায়। চমস্কি এই গণতন্ত্রটিকে “দর্শকের গণতন্ত্র” বলে অভিহিত করেন যেখানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব কৌশলে অস্বীকার করে তাদের দর্শকের ভূমিকায় ঠেলে দেয়া হয়। এই গণতন্ত্রের ধারণা অনুসারে সমাজের এলিট শ্রেণিই রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রশাসনিক কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে এবং সাধারণ মানুষের কাজ হচ্ছে শুধু দর্শক হয়ে রাষ্ট্রের সব কাজে সম্মতি জ্ঞাপন করা- অংশ নেয়া নয়। তবে এই শাসন পদ্ধতিটিকে যেহেতু একনায়কতান্ত্রিক বলতে লজ্জা পান তাঁরা সেহেতু সাধারণ মানুষকে নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচনে ভোটদানের কাজে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয় যেন তারা বেছে নিতে পারেন তাদের সব শাসককে। এ সাধারণ জনগণের গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ ওই একবারই। এরপর আবার পুরো শাসকালব্যাপী শাসনকর্ম থেকে শুরু করে জনগণের সঙ্গে জড়িত সব সিদ্ধান্ত অর্থনীতি, রাজনীতি, এমনকি তাদের কালচার- সবই তৈরি করে দিতে চায় শাসকগোষ্ঠী ও তাদের অনুগত মিডিয়া। ফলে এই গণতন্ত্রে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ সুকৌশলে নাকচ করে দেয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠীর কার্যকলাপ ন্যায্য ও বৈধ করে নিতে হয়। ওই বৈধতা আদায় করে নিতে হয় দু’ভাবে-

এক. সাধারণ জনগণকে বশে আনার জন্য সম্মিলিত যে বোধ, বিশ্বাস, চেতনা ও সংস্কৃতি সেটিকে নিষ্ক্রিয় করে। তাদের মতাদর্শ এমনভাবে নির্মাণ করতে হয় যেন ওই মতাদর্শ রাষ্ট্রীয় শাসকরা গ্লোবাল পাওয়ারের শাসন প্রণালির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এ জন্য শাসকরা গণমাধ্যমসহ অনেক মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological state apparatus) ব্যবহার করে যাদের অনুসৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হচ্ছে, ‘সম্মতি তৈরি করে নাও, আদায় করে নাও।’

দুই. সাধারণ জনগণের যে সচেতন অংশ এই সম্মতি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নতজানু হয় না এবং শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক ও গণবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সক্রিয়তা প্রদর্শন করে তাদের যে কোনো তৎপরতা গণমাধ্যমে প্রচারিত মতাদর্শের নিরিখে বিচার করে সেটিকে সমাজের জন্য ক্ষতিকর, পশ্চাৎপদ, রাষ্ট্র বিরোধী, আইন বিরোধী বলে চিহ্নিত করে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। মিডিয়ার এই বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাসের ওপর ভিত্তি করে শাসকগোষ্ঠী সমাজ বিপ্লবের যে কোনো কণ্ঠস্বর অবদমনের জন্য বল প্রয়োগের ন্যায্যতা পায় অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম প্রথমে বল প্রয়োগ ছাড়াই জনগোষ্ঠীর মতাদর্শ নির্মাণ করে সম্মতি আদায়ের চেষ্টা চালায়। এতেও কাজ না হলে গণমাধ্যম পরিবর্তনকামী শ্রেণির ওপর বল প্রয়োগের মতাদর্শিক বৈধতা দান করে। ফলে সমাজে জারি হয় ফ্যাসিবাদী রাজনীতি ও সংস্কৃতির।

গণমাধ্যম বল প্রয়োগ ছাড়াই সম্মতি উৎপাদন করে চলেছে দুই ধরনের শ্রেণির ভূমিকার মধ্য দিয়ে- এক. বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি যারা জনগণের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করে সম্মতি উৎপাদন করে এবং দুই. সাংস্কৃতিক শিল্পীগোষ্ঠী যারা সাংস্কৃতিক আধিপত্য স্থাপন করে সম্মতি উৎপাদন করে। বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণির কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের নামে যে অপ্রতিনিধিত্বশীল ‘দর্শকের গণতন্ত্র’ অর্থাৎ দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র চালু আছে এটিকে আলাপ-আলোচনা, লেখনী-টকশোর মাধ্যমে আরো প্রতিষ্ঠিত ও মহিমান্বিত করা। এই শ্রেণিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলি, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বলি- এসব মতাদর্শটি আদর্শমান বলে প্রচার করে। শাসকগোষ্ঠীর যে কোনো অগণতান্ত্রিক ও আধিপত্যকামী কার্যকলাপও বৈধতা দেয়। তারা সমাজে ডেভেলপমেন্টাল ডেমক্রেসির পক্ষাবলম্বন করে প্রাণ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধনও জায়েজ করে নেয় উন্নয়নের নামে। তারা গ্লোবাল লুণ্ঠনের দেশীয় এজেন্সির সব কাজ জাস্টিফাই করে তথাকথিত উন্নয়ন দর্শনের নামে। তারা নিওলিবারেল পলিসির যৌক্তিক প্রমাণ করে যার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বহুজাতিক করপোরেশনের লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়। এই পলিসি যে সমাজের গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির বিরোধী এ ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

গণমাধ্যম বৈশ্বিক পুঁজিবাদী শোষণের করপোরেট মিডিয়া বা যন্ত্র হিসেবেই কাজ করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার যে আগ্রাসন এর বিরুদ্ধে গণমাধ্যম মোটেই সোচ্চার নয়। উল্টো লিবারেল ডেমক্রেসি, ডেভেলপমেন্টাল পলিসি, মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ বাজার ব্যবস্থা- এসবের পক্ষে মতামত প্রকাশ করে তারা আন্তর্জাতিক এসব সংগঠনের আগ্রাসী তৎপরতা সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালায়। একদিকে গণমাধ্যম বৈশ্বিক পুঁজির সেবাদাস হিসেবে গ্লোবাল লুণ্ঠনের জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক অর্থনীতির পক্ষে সম্মতি তৈরি করে নেয়, অন্যদিকে এই গণমাধ্যম দেশের ভেতরে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি হাজির করে সমাজে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। এটি বাংলাদেশের সব সরকারের সময়েই সত্য যে, গণমাধ্যমের গণমিডিয়া হিসেবে ভূমিকা পালন করতে না দিয়ে এটিকে শাসকশ্রেণির প্রচারযন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। ফলে ওই প্রচাযন্ত্র রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নও অনেক সময় জায়েজ করার জন্য শ্রেণি ঘৃণা ও গোষ্ঠী ঘৃণার জন্ম দেয়।

গণমাধ্যমের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরো ভয়াবহ। বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থেকে জনগণের চিন্তা, বিশ্বাস ও মতাদর্শটি নিয়ন্ত্রণ করে এমন এক সাংস্কৃতিক আদর্শমান তুলে ধরে যা এক কথায় গণবিরোধী। গণমাধ্যমের এই ভূমিকার জন্য দায়ী ‘উন্নয়নের আধুনিকীকরণ তত্ত্ব’ (Modernization theory of development)। বাংলাদেশের মূল ধারার মিডিয়া এ ধারণাই প্রচার করে যে আমাদের সমাজের উন্নয়নের জন্য আধুনিকীকরণ অপরিহার্য এবং এই আধুনিকীকরণ হতে হবে পশ্চিমা সমাজ-সভ্যতার অন্ধ অনুকরণের মধ্য দিয়েই অর্থাৎ পশ্চিমি সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, জীবন পদ্ধতি- এসবই আত্মস্থ করে পশ্চিমের কাছে প্রাচ্যের আত্মিকভাবে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। তবেই সে আধুনিক হতে পারবে এবং প্রাচ্যের ওই পশ্চিমি হয়ে ওঠার মাধ্যমেই তাদের উন্নয়ন সম্ভব। উপনিবেশবাদ ও উত্তর উপনিবেশিক সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ- উভয়ের প্রভাবে বাংলাদেশের করপোরেট গণমাধ্যমে পশ্চিমা আধুনিক ধ্যান-ধারণা ও জীবন বোধ চর্চাই জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গণমাধ্যম কর্তৃক প্রচারিত ওই সংস্কৃতির অনুষঙ্গগুলো হচ্ছে অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, উদারতাবাদ ও কনজিউমারিজম যা নাগরিকদের মধ্যে এমন এক ধরনের জীবন বোধের উন্মেষ ঘটায়। এটি সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই গণমাধ্যম জনগোষ্ঠীর মন-মানসিকতা এমনভাবে পশ্চিমি সমাজ-সভ্যতা, দর্শন অনুযায়ী পরিগঠন করছে যে, পশ্চিমি আধুনিকতার ধারণাবর্জিত লোকায়ত, জাতীয় ও এথিক্যাল যে কোনো সংস্কৃতি এবং জীবন চর্চাটিকে আজ পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার পরিপূরক বলে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। আধুনিকতাই যেহেতু করপোরেট গণমাধ্যমের কাছে ধর্মের নামান্তর সেহেতু ওই মিডিয়া আধুনিকতাবর্জিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মূর্খ, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ মধ্যযুগীয় বলে তাদের চিন্তা-চেতনা বিনাশ করে দিতে উদ্যত। যৌক্তিক আচরণ, নগরায়ন, শিল্পায়ন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বয়ান নিয়ে আধুনিকতার বিকাশ হলেও ওই আধুনিকতাই পরে পশ্চিমি মুল্লুকে অবাধ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Over Individualism), অনিয়ন্ত্রিত উদারতাবাদ (Liberalism), রি-ইফিকেশন (Reification) ও ডিসাবলিমেশন (Desublimation)-এর জন্ম দেয়। ফলে ক্রমেই তৈরি হয় মুক্তবাজার সংস্কৃতি ও ভোগবাদী কনজিউমার কালচার যা পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোটিই বিকশিত ও শক্তিশালী করে। ওই একমাত্রিক মুক্তবাজার সংস্কৃতিতে উদারনৈতিকতাবাদের নামে মানুষের প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনার বল্গাহীন বিকাশ উৎসাহিত করার মাধ্যমে প্রবৃত্তির একান্ত দাসে পরিণত করা হয়। মানুষের প্রথাগত নৈতিকতা ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতার বলয় চূর্ণবিচূর্ণ করে সেটিকে ভোগবাদী ও পুণ্য পূজারি এক সত্ত্বায় রূপান্তরিত করা হয়। ইন্দ্রিয়ের চরম ও পরম সাধনাই সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। আধুনিকতার ধারণা সারা দুনিয়ায় উপনিবেশবাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তা বিশ্বব্যাপী যে একমাত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায় এর ভিত্তিতেই বর্তমানে আমরা এক ধরনের একমাত্রিক সমাজে প্রবেশ করেছি যেখানে সাম্রাজ্যবাদের একটি বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ। তাই এই আধুনিকতার আইডিয়া ধারণ করে পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়। এছাড়া আধুনিকতার তত্ত্ব ধারণ করে একমাত্রিক পুঁজিতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অসম্ভব।

বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থেকে জনগণের চিন্তা, বিশ্বাস আর মতাদর্শটি নিয়ন্ত্রণ করে এমন এক সাংস্কৃতিক আদর্শমান তুলে ধরে যা এক কথায় গণবিরোধী।

গণমাধ্যম বাংলাদেশে কালচারাল ফ্যাসিজমের জন্য সরাসরি দায়ী। এ দেশের করপোরেট গণমাধ্যম গণমানুষের এথিকাল জীবন চর্চা ও আত্মিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জীবন বোধটিকে পশ্চাৎপদ, প্রতিক্রিয়াশীল বলে চিহ্নিত করে যে কালচারাল যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে এর অন্যতম দলিল হচ্ছে গণমাধ্যমে প্রান্তিক গণমানুষের কৃষ্টি-কালচার নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা। এক্ষেত্রে মিডিয়ার ওই কালচারাল ফ্যাসিজমের লক্ষ্যই হচ্ছে এথিকাল সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের প্রতি এক ধরনের কালচারাল ঘৃণা পুনরুৎপাদন করা যেন তার সংস্কৃতির প্রতি মধ্যবিত্তের মধ্যে এক ধরনের ভীতি, অবহেলা ও চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। প্রান্তিক গণমানুষের এথিকস ও সংস্কৃতির প্রতি বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়ার এই কালচারাল কনফ্লিক্ট অনেকটাই পশ্চিমি অরিয়েন্টালিজম প্রভাবিত। আবার দুই দশক ধরে আধুনিকতার নামে বাংলাদেশে পশ্চিমি ভোগবাদী ও বস্তুবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসন যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, তা সুস্পষ্টভাবেই আমাদের আবহমান সংস্কৃতিরও পরিপন্থী। বাঙালি জাতিয়তাবাদ বলি কিংবা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বলি- উভয়ের ধারক-বাহকরা নিজেকে প্রগতিশীল বলে দাবি করলেও তারা আধুনিকতার নামে এই ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিহত না করে উল্টো স্বাগত জানিয়েছেন এবং তা বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। যারা নিজেকে প্রগতিশীল বলে দাবি করেন তারা এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্র কোনো সাংস্কৃতিক কাঠামো দাঁড় করাতে পারেননি বলে হয় পশ্চিমি ওই সংস্কৃতিটিকেই মনে-প্রাণে লালন করেছেন অথবা এটি প্রতিরোধে বক্তব্য-বিবৃতি দিলেও কাউন্টার কালচারের অভাবে অসহায়ভাবে নিষ্ক্রিয় থাকতে বাধ্য হয়েছেন অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সমাজের মুখপাত্র দাবি করলেও প্রচলিত গণমাধ্যম যে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে তা গণবিরোধী। নিয়ন্ত্রিত এই গণমাধ্যমের বিপরীতে দরকার গণমুখপাত্র যারা জনগণের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার তাগিদ অনুভব করবেন এবং পুঁজিতান্ত্রিক একমাত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কাউন্টার কালচারের প্রকাশ মহিমান্বিত করবেন।

এই নিরিখে মিডিয়ার চলতি ভূমিকা পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই আমাদের গণঅর্থে গণমাধ্যম কীভাবে সম্ভব এ তর্ক তুলতে হবে। মুক্ত মিডিয়ার (ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি) ভূমিকার কথাও আমদের বিবেচনায় আনতে হবে। এসবের শক্তি কীভাবে গণচেতনার অনুগামী করে তোলা সম্ভব তাও বিবেচনার বিষয়। এসব বিবেচনা মাথায় রেখে গণমাধ্যম নিয়ে আমাদের ভাবাভাবি আরো এগিয়ে নিতে হবে।