ভিন্ন আমেজের উৎসব সাকরাইন

ভিন্ন আমেজের উৎসব সাকরাইন

দেখতে দেখতে চারশ বছর হয়ে গেলো প্রাণের শহর ঢাকার। উত্তরোত্তর শ্রী বৃদ্ধির সাথে কালের আবর্তে হারিয়ে গিয়েছে বহু পুরোনো রীতি-রেওয়াজ। যেমন, বর্তমান চকবাজারকে আমরা চিনি মূলত ইফতারের বাজারের জন্য। বহুকাল আগে চক শুধু ইফতারের বাজারের জন্যই বিখ্যাত ছিলো না, বরং ছিলো উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। তখন, নতুন নিকাহ করা দুলহা রাজা আত্বীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে চকের চারপাশে চক্কর লাগাতেন। সে ছিলো এক দেখার মতো দৃশ্য। যার হালত কিছুটা খারাপ সে পায়ে হেটে মুখে রুমাল চেপে, যার অবস্থা কিছুটা ভালো সে রিকশা অথবা ঘোড়ায় চড়ে আর ফুল বাবুরা চককে প্রদক্ষিন করত জুড়ো গাড়িতে বসে। কথিত যে, একই রেওয়াজ মানা হতো সুন্নতের সময়ও। পূর্বের জৌলুশ হারিয়ে চক এখন শুধুই বিখ্যাত ইফতারের
বাজারের জন্য।

বর্তমানে কল্পকথা মনে হওয়া চকের সে প্রথার মতো হারিয়ে গিয়েছে অনেক কিছুই। এর মধ্যে যে উৎসবটা এখনো বহু প্রতিকুলতার মাঝে টিকে রয়েছে সেটি হচ্ছে সাকরাইন উৎসব। অনেকের কাছেই যা পরিচিত পৌষ সংক্রান্তি নামে। অনেকে আবার এটিকে ঘুড়ি উৎসবও বলে থাকেন। মূলত সংস্কৃতি শব্দ সংক্রান্তি’র ঢাকাইয়া অপভ্রংশের নাম সাকরাইন। পৌষ-মাঘের সন্ধিক্ষনে বিশেষ করে পৌষের শেষদিনটিতে উৎসব মুখর পরিবেশে উৎযাপিত হয় এই সাকরাইন। পুরো ভারতবর্ষজুড়েই সাকরাইন পালিত হলেও পুরান ঢাকায় সাকরাইন রুপ নিয়েছে একটি সার্বজনীন উৎসবে।

ছবি: আহনাফ তাওহিদ।

 

উৎসবের দিনের ভোর থেকে শুরু হয়ে যায় সাকরাইন পালনের প্রস্তুতি। ছাদে ছাদে ঘুড়ি নিয়ে ভীড় জমাতে থাকেন বিভিন্ন বয়সের পুরুষেরা। শুধু ঘুড়িই না; যোগার করা হয় মাইক, সাউন্ড সিস্টেমেরও। নারীরা অন্দরে ব্যাস্ত থাকেন মোয়া-মুড়ি, ভেজানো বাকরখানি তৈরীর কাজে। সময় গড়ানোর সাথে সাথেই সাকরাইনের আমেজ ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। বিকালের আকাশ ছেয়ে যায় নানা নামের, নানা রকমের রঙ্গবেরঙ্গের ঘুড়িতে। যেমন বাহারী তাদের রুপ তেমনি বাহারী সব নাম। চক্ষুদার, ভোয়াদার, চলনদার, পেটিদার, পাংদার, প্রজাপতি, দাপস, চিল, মানুষ, কচ্ছপসহ কত বিচিত্র নামের ঘুড়ি যে সাকরাইনে উড়ে তার হিসেব নেই। সাঝ নামতেই বদলে যায় পুরো পরিবেশ। ঘুড়ির বদলে আকাশ দখল করে নেয় আতশবাজীর আলো। পাল্লা দিয়ে চলে আগুন নিয়ে খেলা। পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ, মুরগীটোলা, কাগজিটোলা, গেন্ডারিয়া, বাংলাবাজার, ধূপখোলা মাঠ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, লক্ষীবাজার, চকবাজার, লালবাগ, সূত্রাপুর সহ আশেপাশের এলাকা যেন সাজে ভিন্ন সাজে। বিভিন্ন সূত্র মতে ১৭৪০ সালের দিকে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি ওড়ানো একটি উৎসবে পরিণত হয়েছিল বলে জানা যায়। আরও জানা যায়, নওয়াব বাড়িতে হতো ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা। দুই বাড়ির ছাদে অথবা কোনো মাঠে দুই দলের মুখোমুখি প্রতিযোগিতা হতো। সাথে থাকত ব্যান্ড দলের বাজনা। প্রতিযোগিতায় যার ঘুড়ি বোকাট্টা হতো তাকে কাধে নিয়ে বাদকদল সহ সবাই সে ব্যাক্তিকে নিয়ে চক্কর দিতো পুরো মহল্লা।

26937235_1507855436001780_77532193_o
ছবি: আহনাফ তাওহিদ।

 

সাকরাইন নিছকই একটি ঘুড়ি উড়ানো উৎসব না বরং পুরান ঢাকার রীতি রেওয়াজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাকরাইনে পুরান ঢাকায় শশুরবাড়ি থেকে জামাইদের জন্য নাটাই এবং, বাহারী ঘুড়ি এবং পিঠার ডালা পাঠানো ছিলো অত্যাবশ্যক। ডালা হিসেবে আসা উপহার সামগ্রী বিলি করা হতো আত্বীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীদের মাঝে। নীরব প্রতিযোগিতা চলতো কার শশুড়বাড়ি থেকে কতবড় ডালা এসেছে তা নিয়ে। চকের সে রেওয়াজের মতো এটিও এখন বিলুপ্তপ্রায়।

তবে, আশার কথা হচ্ছে পুরান ঢাকার এই ঐতিহ্য সম্পর্কে মানুষকে জানানোর জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিচ্ছেন ঢাকার পুরোনো এবং নবীনদের সমন্বয়ে গঠিত কিছু সংগঠন। পুরান ঢাকার উৎসবগুলোর মধ্যে ঈদ মিছিল, জন্মাষ্টমী এবং কৃষ্ণের জন্মযাত্রার মিছিল, এসব স্মৃতি থেকে হারিয়েই গিয়েছে প্রায়। এমন সময় এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

সাকরাইন আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুরান ঢাকা আমাদের শেকড়। নতুন রুপে জন্ম নেয়া ঢাকা যতই ঝা চকচকে হোক না কেন, শেকড়কে থেকে যদি দুরে সরে যাই তাহলে সেটি হবে আত্বঘাতী। কয়টি শহরেরই বা রয়েছে গর্ব করার মতো এমন শতবর্ষী ইতিহাস?