তৃতীয় ইন্তিফাদা কি শুরু হয়েছে?

ইন্তিফাদার আদ্যপান্ত

তৃতীয় ইন্তিফাদা কি শুরু হয়েছে?

সম্প্রতি তৃতীয় ইন্তিফাদার ঘোষণা দিয়েছেন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া। ২০০৫ সালের পর ১২ বছরে বেশ কয়েকবার তৃতীয় ইন্তিফাদার কথা গণমাধ্যমসহ নানান মহলে আলোচিত হলেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। প্রথম শোনা যায় ২০১০ সালে, এরপর ২০১৪ ও ২০১৫ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালের শেষ দিকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় আলোচিত বিষয় তৃতীয় ইন্তিফাদা।

মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে আজ কয়েক দশক ধরে ইন্তিফাদা একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। ইন্তিফাদা মানে ‘উত্থান’ বা ‘জাগরণ’। ইসরায়েলি অত্যাচার-অপশাসন ও নিজ ভূমি জবরদখলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি আপামর জনতার প্রতিরোধ সংগ্রামকেই ইন্তিফাদা নামে অবহিত করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৬ ডিসেম্বর জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করলে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকার হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া প্রথম ইন্তিফাদা-র ৩০ বছর পূর্তির দিনে আবার ইন্তিফাদার ঘোষণা দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, ‘আগামী ৮ তারিখ হোক আমাদের ক্ষোভ প্রকাশের দিন, আমাদের ইন্তিফাদা শুরুর দিন। এদিনেই সূচনা হোক একটি বিশাল আন্দোলনের যেমনটি হয়েছিল আগে।’

ইসমাইল হানিয়া বলেন, ‘আমি ওই ইন্তিফাদা-কে জেরুজালেম ও পশ্চিমতীরের মানুষের মুক্তির লড়াই হিসেবে অভিহিত করছি। আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে বলতে চাই, জেরুজালেমকে মুক্ত করার জন্য আমাদের জনগণের প্রতিরোধ ও লড়াই যথেষ্ট।’

সর্বপ্রথম ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর ফিলিস্তিনের জাবালি রিফিউজি ক্যাম্পে ইসরায়েলি সেনাদের ট্রাকের আঘাতে চার ফিলিস্তিনি নিহত  হন। হাজারাে বাড়ি ফেরা ফিলিস্তিনি শ্রমিক সেদিন ওই ঘটনার সাক্ষী হয়। ওই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ব্রাদারহুড-এর ফিলিস্তিনি শাখার নেতা শায়েখ আহমেদ ইয়াসিন, আবদুল আজিজ রানতাসির, সালেহ মোস্তফাসহ অন্য নেতারা বিক্ষোভ আয়োজন করলে এতে অংশ নিয়ে ১৭ বছরের কিশোর হাতিম আল সিসি  ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হয় এবং আহত হন অন্তত ১৬ জন। এর সূত্র ধরে বিক্ষোভ প্রতিরোধপূর্ণ মাত্রায় গাজা ও পশ্চিমতীরে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসরায়েলি দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে অংশ নেন তারা।

গত ৯ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্তিফাদা শুরু হয় এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনে হামাস আত্মপ্রকাশ করে। মূলত তাদের প্রচেষ্টাতেই ওই প্রতিবাদ-আন্দোলন বিভিন্নভাবে সাধারণ জনগণের মধ্যে সংগঠিত হতে থাকে। এর মধ্যে নিরস্ত্র প্রতিরোধ, আইন অমান্য, সাধারণ ধর্মঘট, গাজা উপত্যকা ও পশ্চিমতীরে ইসরায়েলি বেসামরিক প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জন, অর্থনৈতিক বয়কট ছিল শুরুর দিকে আন্দোলনের কৌশল। এছাড়া ইসরায়েলি বসতিতে ইসরায়েলি পণ্য প্রত্যাখ্যান, ট্যাক্স দিতে অস্বীকার করা, ইসরায়েলি লাইসেন্সে ফিলিস্তিনি গাড়ি চালানোয় অস্বীকৃতি, দেয়াল লিখন, ব্যারিকেড সৃষ্টির মতো নিরস্ত্র অহিংস আন্দোলন যেমন ছিল তেমন ছিল ফিলিস্তিনি অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত ইসরায়েলি ব্যারাকে ব্যাপক পাথর ও পেট্রলবোমা নিক্ষেপ।

শুরুর দিকে আক্রমণের জন্য কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু ঠিক করা হয়। যেমন- সামরিক যানবাহন, ইসরায়েলি বাস, ইসরায়েলি ব্যাংক। ওই লড়াইয়ের প্রথম দিকে কোনাে ইসরায়েলি বসতিতে আক্রমণ হয়নি বা ইসরায়েলি গাড়িতে পাথর নিক্ষেপ পর্যন্ত হয়নি। তবুও এই ঘটনায় ভীত হয়ে ইসরায়েল পুরো ফিলিস্তিনে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৮০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করে এবং নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের পাথরের বিপরীতে সরাসরি গুলি ছুড়ে ব্যাপক সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হিসাব মতেই প্রথম ১৩ মাসে ৩৩২ ফিলিস্তিনি নিহত হন। এত সংখ্যক শিশু, যুবক ও বেসামরিক জনতাকে হত্যা করার পর হামাস শক্ত জবাব দিতে ‘জবরদস্তি, শক্তি ও আঘাত’  নীতি গ্রহণ করে। ফলে প্রথম বছরে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী ৩১১ ফিলিস্তিনি হত্যা করে, এমনকি ‘সেভ দি চিলড্রেন’-এর মতে, তাদের মধ্যে ৫৩ জনের বয়স ছিল ১৭ বছরের কম।

১৯৮৭ সাল থেকে শুরু হয়ে ওই ইন্তিফাদা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পুরোদমে চলে। অবশ্য এর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয় ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির মাধ্যমে। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বেসরকারি হিসেবে ১ হাজার ৪৮৯ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি দখলদার সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়।

এরপর ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা অ্যারিয়েল শ্যারন জেরুজালেমের পবিত্র ট্যাম্পল অফ মাউন্ট ও আল আকসা সফরে এলে ফিলিস্তিনি জনগণ ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং আল আকসা মসজিদের ভেতরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার সময়ে ইসরায়েলি সেনাদের হাতে ৬-৭ ফিলিস্তিনি নিহত হলে শুরু হয় দ্বিতীয় ইন্তিফাদা। প্রথম থেকেই ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনি জনগণ ওই ইন্তিফাদা-য় অংশগ্রহণ করে। ওই সময় হামাস তার ব্রাদারহুড ঘেঁষা পূর্ব রাজনৈতিক ইশতেহার যা দুনিয়াজুড়ে ‘হামাস চার্টার’ নামে পরিচিত ছিল এটি বদলে নতুন ইশতেহার প্রদান করে। ফলে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে হামাস।

ওই ইন্তিফাদা চলাকালে হামাসের প্রতিষ্ঠাতা অন্ধ শায়েখ আহমেদ ইয়াসিন ২০০৪ সালের ২২ মার্চ  ফজরের নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময় ইসরায়েলি অ্যাপাচি গানশিপ থেকে ছোড়া মিসাইলের আঘাতে দেহরক্ষীসহ নিহত হন। এরপর হামাস-এর দায়িত্বে আসেন আবদুল আজিজ রানতিসি। এর এক মাস পর ১৭ এপ্রিল ইসরায়েলি মিসাইলের আঘাতে তিনিও নিহত হয়। ওই ইন্তেফাদার সময়ই প্রচুর পরিমাণ ‘টার্গেট কিলিং’ সংগঠিত হয়। বিশেষ করে হামাস নেতাদের ওপর এবং ওই ইন্তিফাদায় হামাসের সঙ্গে সঙ্গে ফাতাহ নেতারাও সোচ্চার হন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য মতে, ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চলা ওই ইন্তিফাদায় ইসরায়েলি সেনাদের হাতে তিন হাজার কিংবা এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন যার বেশির ভাগ বেসামরিক। অতঃপর ২০০৫ সালে মিসরের সিনাই উপত্যকার শার্ম আল শেখ নামক স্থানে মিসরীয় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ও জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ-র উস্থিতিতে তৎকালীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করলে ইন্তিফাদার সমাপ্তি হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়।

সর্বশেষ সুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৬ ডিসেম্বর জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করলে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকার হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া প্রথম ইন্তিফাদার ৩০ বছর পূর্তির দিনে আবার ইন্তিফাদার ঘোষণা দেন।

বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে- গাজা, পশ্চিমতীর ও জেরুজালেমের মানুষের মধ্যকার ভৌগােলিক দূরত্ব ও নানান কারণে দানা বাঁধতে পারছে না তৃতীয় ইন্তিফাদা।