ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভারত সফরের প্রেক্ষিতে নেদারল্যান্ড এর সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা পিটার স্পিটজেন্স এর লেখাটি মিডল ইস্ট আই ডটনেট এর মতামত বিভাগে প্রকাশিত হয়। জবানের পাঠকদের জন্য লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মিনহাজ আমান।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি দুজনের বিশ্বকে দেখার কায়দায় এক অভূতপূর্ব মিল রয়েছে। দুজনের বিশ্ববীক্ষণেই একধরনের একাট্টা জাতীয়তাবাদ লক্ষ্য করা যায়, যার ভিত্তি আবার অতীতের খুব নির্দিষ্ট কিছু পৌরাণিক কাহিনি।
‘১৭ সালের জুলাইয়ে যখন নরেন্দ্র মোদি প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফর করলেন; তিনি কিছুক্ষণের জন্যে আধুনিক ইসরায়েলের জাতির পিতা থিওডোর হার্জলের সমাধিস্থলে হাজির হয়েছিলেন। রীতি অনুসারে সমাধির সামনে একটি পাথর রেখে সম্মানও জানিয়েছেন।
আজ ১৪ই জানুয়ারি রবিবার ভারত সফরে ইসরায়েলের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আসছেন নেতানিয়াহু। তবে তিনি দিল্লীতে জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলে যাবেন বলে মনে হচ্ছে না। এতে অবশ্য দুই দেশের জাতির পিতার প্রতি ভালবাসার কোন কমতি হবে না।
সাভারকার ভারতের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র। তাকে ভারতের থিওডোর হার্জেল বলা অত্যুক্তি নয়। তিনি ভারতের হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের মৌলিক নীতির জনক। যখন গান্ধী ভারতকে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র করার কথা ভাবতে চাইলেন, সাভারকার করতে চাইলেন “হিন্দুস্তান” যেটি নাকি হিন্দুদের আদি ও আসল নিবাস এবং সবসময়ই ছিল।
গান্ধীর সিলসিলা
গান্ধী কখনোই মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদীবাদের প্রতি সমর্থন দেননি। তিনি ১৯৩৮ সালে হরিজন পত্রিকায় ইহুদীদের আলাদা আবাসের দাবির প্রেক্ষিতে লেখেন: “ইহুদীদের প্রতি আমার সমবেদনা রয়েছে। কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে এই সমবেদনা আমার কাছে কখনও বাঁধা হতে পারে না। তাই ইহুদীদের আলাদা আবাসভূমির দাবি আমার কাছে খুব যৌক্তিক মনে হচ্ছে না।”
তিনি যোগ করেন, “তারা এই আবাসভূমি ধর্মীয় দাবিতে চাচ্ছে। অথচ সেই দাবি আদায় করতে তারা বুলেট-বোমার আশ্রয় নিচ্ছে। তারা যদি আসলেই সেরকম কিছু চায়, তাহলে সেটি মধ্যপ্রাচ্যের সবার ইচ্ছার ভিত্তিতে হতে হবে।”
তারপরের বছর চারজন ইহুদী-দূত গান্ধীর সাথে দেখা করে ইহুদীদের বিষয়ে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কি লাভ? গান্ধী পরে ১৯৪৬ সালের দিকে আবার লেখেন: “এখন ইহুদীরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের সাহায্য নিয়ে নগ্ন সন্ত্রাস করছে।”
ভারতের স্বাধীনতা লাভের মাত্র ছয়মাস পর, ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি এক চরমপন্থির গুলিতে নিহত হন গান্ধী। তার মৃত্যুর বেশকিছুদিন পর্যন্ত ভারতের পররাষ্ট্র-নীতি গান্ধীর চিন্তা চেতনার বিপরীতে যায়নি। ফলে ১৯৫০ সালে তারা ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক পুরোদমে প্রতিষ্ঠিত হয় অনেক দেরিতে, ১৯৯২ সালে।
২০০৩ সালের দিকে ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দিল্লী ভ্রমণে আসেন এরিয়েল শ্যারন। ভারতের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্কের সবচেয়ে উষ্ণতম সময়টার শুরু হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি যখন ক্ষমতার সিংহাসনে। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি ৮২ সালের নির্বাচনে পায় মাত্র দুটি সিট। অথচ নয় বছরের মাথায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তারা জয় করে নেয় ১২০টি সিট; সেটি ৯৯সালে বেড়ে হয় ১৮২টি।
তার এই বিরাট-অভূতপুর্ব জনসমর্থনের পিছনে ছিল উগ্র মুসলিম বিরোধিতা। যার বাস্তব রুপ আমরা দেখি যখন ৫০০ বছর পুরানা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়ার দাবি ওঠে; কারণ সেখানে নাকি ছিল রামের জন্মভূমি। তার ধারাবাহিকতায় এক দশক পরে ২০১৪ সালে তারা সমগ্র ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাসিল করে নেয়। মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন; খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাকে শুভকামনা জানিয়েছিলেন নেতানিয়াহু। তাৎক্ষনিকভাবে দুদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্কে এসেছিল আমুল পরিবর্তন। ক্ষমতা গ্রহণের পাঁচ মাসের মাথায়, ইসরায়েলের সাথে তাদের ৬৬২ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সম্পন্ন হয়। ফলে, মোদি যখন নেতানিয়াহুর জাতির পিতার সমাধিস্থলে যান সেটি নেতানিয়াহুর জন্যে আনন্দের হলেও, নেতানিয়াহু গান্ধী মেমোরিয়ালে না গেলে বিরাজমান দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কে কোন হেরফের হবে না। কারণ, মোদি নিজেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত পার্লামেন্টে গান্ধীর প্রতিকৃতি মাড়িয়ে ঠিক ডান পাশের সাভারকারের প্রতিকৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, গান্ধীর পাশে সাভারকারের এই প্রতিকৃতি স্থাপন করেছিল বিজেপি, ২০০৩ সালে।
সাভারকার যখন ভারতের হার্জেল
সাভারকার ভারতের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র। তাকে ভারতের থিওডোর হার্জেল বলা অত্যুক্তি নয়। তিনি ভারতের হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের মৌলিক নীতির জনক। যখন গান্ধী ভারতকে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র করার কথা ভাবতে চাইলেন, সাভারকার করতে চাইলেন “হিন্দুস্তান” যেটি নাকি হিন্দুদের আদি ও আসল নিবাস এবং সবসময়ই ছিল। তার মতে, যারাই ভারতকে তাদের পবিত্র মাতৃভূমি বলে মেনে নিবে, তারা সকলই হিন্দু। ফলে ভারতের বিশ কোটি খৃষ্টান-মুসলিমের জন্যে এই দাবি মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে যেখানে তারা হাজার বছর ধরে এদেশে বসবাস করছে। এমনকি তাজমহলের মত ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে পর্যন্ত “অভারতীয়” বলে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছে কিছু হিন্দু চরমপন্থি।
সাভারকারের সাথে গান্ধীর বিরোধ শুধু বুদ্ধিবৃত্ত্বিক ছিল না। গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে সাভারকারের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল। এমনকি এই হত্যার আগে পর্যন্ত সাভারকারের সাথে তার সপ্তাহে দুবার নিয়ম করে দেখা হত। অনেকেই বলেন; এই হত্যায় গডসে শুধু হাতিয়ার, পেছনের হাতটা আসলে সাভারকারের।
পরে অবশ্য গান্ধীর হত্যার আসামী হিসেবে সাভারকারসহ তার হাজারো হিন্দু জাতীয়তাবাদী কর্মীদের জেলে পুরে দেওয়া হয়, তবে তাদের বিপক্ষে প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয় কতৃপক্ষ। আর নথুরাম গডসে যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক-সংঘের একজন নিবেদিত কর্মী ছিলেন সেটি এখন সবারই জানা। আজকের মোদি এবং কিছু মন্ত্রী পর্যন্ত সেই সংঘের সাথে কিশোর-কাল থেকে জড়িত।
লক্ষ্য যখন অভিন্ন
সাভারকার এবং হার্জেল আসলে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। যেখানে দুজনের প্রচারণাতেই ছিল অতীতের নির্দিষ্ট কিছু পৌরাণিক ঘটনাকে ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা একাট্টা জাতীয়তাবাদ। যার বদৌলতে বর্তমান সময়ে এসে এ দুটি দেশের চিন্তায় এক বিরাট ঐক্য স্থাপন হয়েছে। যার উষ্ণতম উদাহরণ পাওয়া যায় ২০০৩ সালে শ্যারনের আগমন উপলক্ষে বিজেপির শুভ-আগমনী বার্তায়, “তামাম দুনিয়া আজ মেনে নিয়েছে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে সফল। যেহেতু ইসরায়েল আর ভারতের আজ অভিন্ন শত্রু; সন্ত্রাসবাদ। আমাদের তাই তাদের থেকে শিখবার আছে অনেক কিছু”।
এসবের পরে আর বুঝতে বেগ পেতে হয়না যে, ভারতে অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় শুরুতেই আছে ইসরায়েল। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শুরুতে ১৯৯২ সালে মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলারের দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি হলেও ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয় ৪ বিলিয়ন ডলারে। গত বৃহস্পতিবার (১২ই জানুয়ারি), ভারতীয় মিডিয়ার মতে, গাজা অঞ্চলে সফলভাবে পরীক্ষিত প্রায় পাঁচশ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ইসরায়েলি ট্যাংক-বিধ্বংসী মিসাইল কিনতে কথাবার্তা উঠতে পারে। যদি সেটা সফল হয়, তাহলে এই সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সফরে নেতানিয়াহু একাই আসছেন না, তার সফরসঙ্গী হচ্ছেন ১০২ জনের বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি।
আজ ইসরায়েলের ইহুদিবাদী এবং ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা একই আদর্শের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে নেতানিয়াহু হয়ত তার এই “বিশেষ বন্ধুর” সাথে একটি সরল-জুতসই সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে আশাবাদী হতে পারেন। যেখানে আবার ইসরায়েল নিজেই দিন দিন কার্যত বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। কিন্তু ভারত আকারে এবং জাতিসত্ত্বায় খুব জটিল দেশ হওয়ায় তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আরও নানা সমীকরণের মুখোমুখি হতে হয়। যেমন ইরানের সাথে আছে ভারতের বিরাট ব্যবসায়িক চুক্তি তেমনই ভারত চাইছে না তার পাশের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ পাকিস্তানকে কোনও ভাবে উত্তপ্ত করতে। তার ওপর ভারতে আছে সক্রিয় গনতন্ত্র যেখানে ২০ কোটি মুসলিমের ভোট একটি বড় ফ্যাক্টর। যে কারণে বিজেপির মূল ঘাটি হিসাবে পরিচিত গুজরাটেই সর্বশেষ নির্বাচনে হারতে হারতে জিতে আসাই প্রমাণ করে যে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানে নিজেদের একাট্টা রাজত্ব কায়েম হয়ে যাওয়া না। যার ফল আমরা আরও দেখেছি যখন ভারত জাতিসংঘে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী করার প্রশ্নে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিপরীতে নিজের ভোটপ্রদান করল।