১৯৬৪ সালে পিতার ইন্তেকালের পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে সঙ্গীতকে পুরোদস্তুর পেশা হিসেবে বেছে নেন কাওয়াল সম্রাট নুসরাত ফতেহ আলী খান। এত কম বয়সে শুরু করলেও সারা জীবনে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চাচা ওস্তাদ মোবারক আলী খান ও ওস্তাদ সালামত আলী খানের মতো মুরুব্বীদের সান্নিধ্যে থেকে তিনি কাওয়ালী ঘরানায় নিজের সুর ও তালে এক অনন্য ও অসাধারণ জায়গা তৈরি করে নেন।
কাওয়ালীর পাশাপাশি গজলেও সমান পারদর্শিতাই প্রমাণ করে তাঁর কাজের ময়দানে তিনি অল রাউন্ডার। ১৯৯১ সালে যখন এই সাক্ষাৎকার দেন, লাহোরে একটি সঙ্গীত একাডেমী ও রেকর্ডিং স্টুডিও প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গতবছর ২০১৬ সালে এসে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন তাঁর ভাতিজা রাহাত ফতেহ আলী খান। লাহোরে নুসরাত ফতেহ আলী খানের নামেই সঙ্গীত একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও জার্মানি সফর থেকে ফিরে এসে ‘ডন’ এর হেরাল্ডকে এই সাক্ষাৎকারটি দেন নুসরাত ফতেহ আলী খান। সাক্ষাৎকারটি নেন পাকিস্তানি দৈনিক পত্রিকা ‘ডন’ এর সাংবাদিক জামান খান। ১৯৯১ সালের মার্চে ডন এর বিশেষ সাময়িকী হেরাল্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। জবানের জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন ইয়াসির আরাফাত
জামান খান: সদ্য ছয় সপ্তাহের ইউরোপ সফর শেষ করে এলেন। সেখানকার মানুষ আপনার সঙ্গীতে বেশ সাড়া দিয়েছে বলে জানি। ভাষা না জানা সত্ত্বেও আপনার শিল্পের কোন জায়গাটাতে ইউরোপীয়দের আগ্রহের সৃষ্টি হয়?
নুসরাত ফতেহ আলী খান: সফরটা খুবই ভাল ছিল, মানুষজন আমাদের কাজ খুব পছন্দ করেছে। বিশেষ করে জার্মানীর মানুষেরা ব্যাপক সাড়া দিয়েছে। ফুল হাউসে আমরা গেয়েছি। তারা আমাদের ভাষা বোঝে না সত্যি। কিন্তু আমরা আমাদের কাজটাকে এমনভাবে হাজির করি যেখানে সুর ও তালের এমন যুগপৎ উপস্থাপনা থাকে যে ভাষা বোঝার কোন দরকার পড়ে না। আর ইউরোপীয়রা বলে, তারা কথা বা শব্দে আগ্রহী না, তারা শিল্পের মূল্যায়ন করতে চায়।
আপনি কি কখনও পশ্চিমা সঙ্গীতের সুরকে আপনার কাজে ব্যবহারের কোশেশ করেছেন?
নুসরাত: না, তবে আমরা এটা এখনও এক্সপেরিমেন্ট করছি। পাশ্চাত্যে ‘মাস্ত, মাস্ত’ নামে আমাদের যে অ্যালবামটি বেরিয়েছে সেখানে আমাদের কণ্ঠের ব্যাকগ্রাউন্ডে তাদের সুর ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানকার বিখ্যাত সুরকার পিটার গ্যাব্রিয়েল ‘দ্য লাস্ট টেম্পটেশান অব ক্রাইস্ট’ সিনেমায় নেপথ্য-সঙ্গীত হিসেবে আমাদের কণ্ঠ ব্যবহার করেছেন।
রিয়েল ওয়ার্ল্ড’ এর মতো এত বড় কোম্পানী থেকে আপনার অ্য্যালবাম বের হল। পাশ্চাত্যের সঙ্গীতে কাজ করতে আপনার কেমন লেগেছে?
নুসরাত: এটা খুবই ভাল ব্যাপার ছিল। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন দরকার। পাশ্চাত্যের উচিৎ আমাদের সঙ্গীত-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা বোঝার সম্পর্ক তৈরি করা এবং একইসাথে আমাদেরও তাদেরটা জানতে হবে। এ ধরণের যৌথ উদ্যোগে শিল্পীরা জানাশোনার জন্য একে অপরের কাছাকাছি যেতে পারে।
পাশ্চাত্যে আপনার প্রিয় শিল্পী কে বা কারা?
নুসরাত: আমি আসলে ইন্সট্রুমেন্টাল বেশি পছন্দ করি, তবে সেখানে অনেক ভাল শিল্পীও আছেন যেমন মাইকেল জ্যাকসন এবং টিনা টার্নার। বিশেষত টিনা টার্নারকে ভাল লাগে, সে আমার সাথে গান করার অভিপ্রায়ও জানিয়েছে।
এদেরকে ভাল লাগার কারণ কি?
নুসরাত: যারা ইচ্ছেমত সুরের ব্যবহার করতে জানে তাদেরকে ভাল লাগে, আমি নিজেও সুরনির্ভর। আফ্রিকান শিল্পীদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন খুব ভাল গায়। ইউসাফ আলী ফাখরা নামে আমার একজন কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীবন্ধু আছেন, ওর বাড়ি জিম্বাবুয়েতে।
আপনি গাইতে শুরু করেছেন কি শুধুমাত্র শিল্পীদের পরিবারে জন্মেছেন বলে, নাকি কোন দৈব প্রতিভা আছে আপনার?
নুসরাত: শিল্পী পরিবারে জন্ম হলেই যে সে ভাল গাইতে পারবে তা না। কোন কিছুর সর্বোচ্চ মাকামে পৌছাতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। যদি কেউ ভাল একজন শিল্পীর সন্তান হয় তাকে তাহলে আরো বেশি পরিশ্রম করতে হবে কারণ তাকে তার পিতার সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়। আমার পরিবারে অনেকে আছে যারা গান করে না, এমনকি কিভাবে গান করতে হয় জানেও না, কিন্তু গায় এবং তারা বেশ প্রতিভাবান।
আপনার ছোট ভাই ফরখ ফতেহ আলী খানও একজন শিল্পী, ছোটবেলা থেকেই তিনি আপনার সঙ্গে গান করেন, আপনার পূর্ব পুরুষদের অনেকেই শিল্পী। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?
নুসরাত: আমার পূর্ব পুরুষেরা আফগানিস্তানের গজনীতে থাকতেন। মাহমুদ গজনবীর সময়ে তারা শেখ দরবেশ নামে এক সুফিসাধকের সঙ্গে ভারতে চলে আসেন। উনারা জুল্লুন্ধারের বস্তিতে আশ্রয় নেন এবং উনারা সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। আমাদের এই ঘরানা সাহিবদাদ, খালিকদাদ, আত্তারদাদ, জাহাঙ্গীর, মিরদাদ, কালু খান ও এদের মত অনেক মহান সঙ্গীতজ্ঞের জন্ম দিয়েছে। এছাড়াও আমার বাবার সময়কালে ছিলেন বাবা ফতেহ আলী খান এবং ওস্তাদ মোবারক আলী খান। উনারা সেই সময়ের সেরা গায়কও ছিলেন, কাওয়াল হিসেবেও ছিলেন বিখ্যাত।
উনারা বাদ্যযন্ত্রের সবই বাজাতে পারতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অসম্ভব রকম পারদর্শী ছিলেন, যেমন ওস্তাদ বড়ে গুলাম অালী খান, সালামত আলী খান, নাজাকাত আলী খান, ওস্তাদ সাদিক আলী খানসহ উনাদের সময়কার অনেকে। প্রত্যেকে তাঁদের মুরুব্বীদের কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন। পরবর্তীতে এ বংশের তরুণেরা কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের জগতে একটা সুনাম তৈরি করেছেন এবং তা ধরে রেখেছেন।
আপনার পূর্বপুরুষেরাই কি কাওয়ালী ঘরানায় তাঁদের অবস্থান তৈরি করেছিলেন?
নুসরাত: কাওয়াল হিসেবে উনারা বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিলেন, তাঁদের সমতুল্য কেউ ছিল না সেসময়। সঙ্গীতের সত্যিকার পণ্ডিতেরা জানেন উনাদের অবদানের কথা। উনারা মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিতেন। উনাদের হাত ধরেই কাওয়ালী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চার পরিমন্ডলে জায়গা পায়। উনারা খেয়াল ও ধ্রুপদী এ দুটি গানের ধারায় গাইতেন। আমার বাবা ফতেহ আলী ধ্রুপদীতে অার আমার চাচা মুবারক খেয়াল গাইতেন। উনাদের সময়ে কাওয়ালীর এই দুটি ধারাই জনপ্রিয় ছিল।
এর পাশাপাশি উনারা তালাফুজ ও তানজিমের ব্যবহার জানতেন। উনাদের আগে পাঞ্জাবে আর কেউ এর ব্যবহার করেনি। আমার পিতাই প্রথম এটা ব্যবহার করেন। উনাদের লিরিক বাছাই ছিল চমৎকার। এটা পাঞ্জাবের মানুষদের কাছে উনারাই হাজির করেন, যখন পাঞ্জাবের কেউ এসম্পর্কে জানতই না। এর স্বীকৃতি তাদেরই প্রাপ্য।
আপনি সঙ্গীতের তালিম কোথায় নিয়েছিলেন?
নুসরাত: শিশুকালে আমি প্রথম তবলা বাজানো শিখেছিলাম। তাল আমাদের সঙ্গীতে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতো। আমার পিতাও এটি ব্যবহার করতেন। এখনও আমাদের সঙ্গীতে তালের গুরুত্ব ব্যাপক। এরপর আমি রাগ বেদিয়া গাইতে শিখেছিলাম। আমি এর পুরোটা মুখস্ত করেছিলাম।
আপনার প্রিয় রাগ কোনটি?
নুসরাত: আমি বহু রাগ এর তালিম নিয়েছি, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে আয়মান কোলীয়ূন, গুজারি, দেশি তুড়ি, দরবারি, ললিত ভাল লাগে।
দিনের কতটা সময় আপনি রেওয়াজ করে থাকেন?
নুসরাত: শিল্পের চূড়ায় আরোহণ করতে একজন শিল্পী সব সময় রেওয়াজের উপর ভরসা করে। আমরা সেই স্তরে আছি যেখানে মনের জগতে রেওয়াজ করলেই চলে।
এর আগে আমরা দিনে ১০ ঘন্টা করে রেওয়াজ করতাম। এই বাড়ির নিচ তলায় আমার চাচা ওস্তাদ মুবারক আলী খান থাকতেন। সেখানে বৈঠকখানা ছিল, সেখানে আসলে আমাদের সময় জ্ঞান কাজ করত না।
অনেক সময় ভোরে রেওয়াজ শুরু করতাম আর রাত দশটায় উঠতাম। এমনও হত, রাতে বসেছি সকাল দশটার দিকে শেষ করতাম। যখনই আমি সময় পাই, মনে মনে রেওয়াজ করি।
আপনি কি কাওয়ালীর মাধ্যমে আপনার সঙ্গীত জীবন শুরু করেছেন?
নুসরাত: জ্বি, আমি কাওয়ালী দিয়ে শুরু করেছি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে আপনার কাওয়ালী পাকিস্তানের মার্কামারা হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তান বলতেই অনেক দেশে আপনার কাওয়ালীর কথা বলে ওঠে। আপনি কেন গজলের দিকে ঝুঁকে গেলেন?
নুসরাত: আমি আসলে একটা চান্স নিয়ে গজল গাইতে শুরু করি, এটা একেবারেই হঠাৎ করে। একদম শুরু থেকে আমি শাস্ত্রীয় ধারায় গেয়ে আসছি। আমার পিতার ওফাত দিবসে আমি সব সময় শাস্ত্রীয় গাই। টিভি, রেডিও এবং বড় বড় শিল্পীদের সামনে আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেছি। সবাই শাস্ত্র সঙ্গীতে আমার মেধার স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এটা হচ্ছে অল-রাউন্ডারদের যুগ। ক্রিকেটে যেমন ইমরান খান অল-রাউন্ডার হিসেবে সম্মানিত। আমার মতে, অল-রাউন্ডার হওয়া ভাল। যেখানে আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম পেয়েছি সেখানে কেন আমি শুধু কাওয়ালী নিয়ে পড়ে থাকব? সব ধারায় আমাদেরকে মাস্টার হতে হবে।
একজন লোকের যখন ব্যবহারিক জ্ঞান থাকে, শিল্পের ওপর দখল থাকে, ধ্রুপদী কণ্ঠ থাকে, এবং যার কাব্যে দখল রয়েছে এবং সাহিত্যের জ্ঞান রয়েছে তাঁর জন্য গজল গাওয়াটা কোন ব্যাপার না।
আপনি কি মনে করেন, শাস্ত্র সঙ্গীতের শ্রোতাবহর ছোট বলে শিল্পীরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছেড়ে গজলে আগ্রহী হচ্ছেন?
নুসরাত: শাস্ত্রসঙ্গীতের নাম শুনলেই মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কারণ আমরা একে সেইভাবে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছি, এটা শিল্পীদের দোষ। এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে মানুষের শুনে ভাল লাগে, উপভোগ করে। যে শিল্পীর গানে মুন্সিয়ানা রয়েছে, তার জন্য এই কাজটি কোন ঘটনাই না। তার কাজ হচ্ছে তার নিজের কাজটি মানুষের সামনে সহজ করে হাজির করা। সমস্যাটা এমন পর্যায়ে গিয়েছে; শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কথা শুনলে মানুষ টিভি-রেডিও বন্ধ করে দেয়। আমাদের উচিৎ একটা জনপ্রিয় উপায় বের করা যাতে মানুষ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে।
কাওয়ালীতে আমি একটা স্টাইলকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে দাঁড় করিয়েছি। শক্তিশালী সুরের সঙ্গে যে কোন কিছুই ভাল লাগবে, এমনকি যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বোঝে না তার কাছেও ভাল লাগবে। এটা করতে পেরেছি, কারণ এটা আমাদের হৃদয় স্পন্দনের সাথে মিশে আছে। বিশ্বের যে কোন কিছুরই একটা নির্দিষ্ট নিয়ম বা পদ্ধতি রয়েছে। সুর মানুষের হৃদয়ের খুবই কাছের একটি জিনিশ।
ভারত ও পাকিস্তানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে আপনার পছন্দের তালিকায় কারা?
নুসরাত: ভারতে ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান, ওস্তাদ আমির হুসাইন খান সাহেব এবং ওস্তাদ আল্লা রাখা খান। আর পাকিস্তানে ওস্তাদ শওকত আলী খান।
ভারতে কিশোরী আমোঙ্করের মতো মহিলা শাস্ত্রীয় শিল্পী রয়েছেন। তাদের ব্যাপারে আপনার কি মনে হয়?
নুসরাত: এরা অতোটা ক্যালিবার নেই। কিন্তু পারভীন সুলতানাকে আমি পছন্দ করি।
রোশান আরা বেগমের মতো ক্যালিবার-সম্পন্ন কেউ কি ভারতে আছে?
নুসরাত: রোশান আরার মতো শিল্পীরা শতাব্দীতে একবারই জন্ম নেন। বর্তমানের এই প্রজন্ম অতটা পরিশ্রম করে না আবার তাদের মধ্যে একনিষ্ঠতার অভাবও রয়েছে। সীমান্তের অন্য পারে নারী ও পুরুষ কিছু শিল্পী আছেন, যারা খুবই ভাল গাইছেন।
পাকিস্তানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ কেমন দেখেন?
নুসরাত: আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা বাস্তববাদী না। সঙ্গীত নিয়ে পাকিস্তানের মানুষজনের দৃষ্টিভঙ্গি বৈচিত্রময়। এখানে সঙ্গীতের উপর শিক্ষা-দীক্ষার কোন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই।
পাকিস্তানের মানুষের মনে সঙ্গীত নিয়ে নৈতিক সংশয় কাজ করে। যারা শিখতে আসে তাদের মধ্যেও একধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। সত্যটা হচ্ছে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, সুর বা লয়, এর কোনটাই ইসলাম-বিরোধী কিছু নয়। এটা হারাম না। সুর ও সঙ্গীত শুনে কোন মানুষ বিপথে যায় না। আমি তো এতে কোন খারাপ কিছু দেখি না। আমাদের মানুষজন এখনও ভাবে, এটা হালাল বা হারাম কিনা। পাশাপাশি আমাদের সরকারের কথাও বলতে হয়, তারা শিল্পের মর্যাদা প্রদানে উদাসীন।
অন্যদিকে ভারতের সরকার একাডেমি প্রতিষ্ঠান খুলে বসে আছে। মানুষ সেসব প্রতিষ্ঠানে শিল্প চর্চা ও এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। আর আমাদের এখানে মানুষ নিজেদের একান্ত চেষ্টায় শিল্প চর্চা করে, সরকারি-পৃষ্ঠপোষকতা একেবারেই নেই।
আপনার প্রিয় পাকিস্তানি গজল গায়ক কে?
নুসরাত: ফরিদা খানম, গুলাম আলী এবং নুর জেহানকে আমার ভাল লাগে। তাঁরা অত্যন্ত উঁচু মানের গায়ক। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে আমার পছন্দ ওস্তাদ সালামত আলী।
ভারতের সাথে তিন তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। সম্পর্ক সব সময়ই খারাপ ছিল। আপনি তো গান করতে ভারতে যান, সেখানকার মানুষজন কিভাবে নেয়?
নুসরাত: শিল্পীদের কারও সাথে শত্রুতা নেই। শিল্পীরা যুদ্ধ পছন্দ করে না। আর যুদ্ধ তো কোন দেশের জন্য ভাল কিছু না। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যেমন ক্রিকেট ম্যাচে প্রতিযোগিতা হয় তেমনি আমাদের দুই দেশের শিল্পীদেরও সঙ্গীতের মুন্সিয়ানার জায়গা থেকে প্রতিযোগিতা হতে পারে। পারস্পারিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের আয়োজন তো আমরা করি না, তবে আসলে ভারতীয় শিল্পীদের সাথে আমাদের প্রতিযোগিতার ধারাটা বজায় রাখা দরকার। ভারত পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিবেশি দেশ যেখানে সঙ্গীতকে শাস্ত্রীয় আদবের সহিত গাওয়া হয়, চর্চা করা হয়। আমরা একই সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানুষ। একারণে ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে চিন্তার জগতে আমাদের একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব কাজ করে। আমাদের ভাল শিল্পী, গায়ক ও সুরকারদের হয়তো ততোটা জনপ্রিয়তা নেই, তবে একে অপরকে আমরা চিনি।
রাজ কাপুরের আমন্ত্রণে ১৯৮০ সালে আমরা ভারতে গিয়েছিলাম। সবাই অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে আমাদেরকে বরণ করেছিল। পরে অনেক দাওয়াত সত্বেও আমরা আর ভারতে যেতে পারি নি। তবে ক্যাসেটের সুবাদে আমরা এখন ভারতের ঘরে ঘরে পৌছে গিয়েছি।
প্রায় দেড়শ ক্যাসেট বেরিয়েছে আপনার। আপনি সবগুলো থেকে সম্মানীর অর্থ পেয়েছেন?
নুসরাত: এরা শুরুতে ক্যাসেট বের করার সময় টাকা দেয়। কিন্তু শিল্পীদের সুনাম পেতে হলে বা অবস্থান তৈরি করতে অনেক কম টাকায়ও ক্যাসেট করতে রাজি হতে হয়। রেডিও-টিভিওয়ালারাও পর্যাপ্ত পয়সা-কড়ি দেন না। যদিও যাতায়াতে বা দুরে কোথাও গেলে হোটেল খরচেই আমরা এর চেয়ে অনেকগুণ বেশি ব্যয় করি।
সঙ্গীত একাডেমি না থাকার ব্যাপারে আপনি সব সময় বলেন। এদেশে সঙ্গীতের প্রসার প্রচারের আপনার পরিকল্পনায় কি কোন কিছু আছে?
নুসরাত: ফয়সালাবাদে আমি আমার পিতা ফতেহ আলী খান ও চাচা ওস্তাদ মুবারক আলী খানের নামে একটি সঙ্গীত একাডেমি করতে চাই। বিগত ২৬ বছরে, অামার পিতার ওফাত দিবসে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছি। সব বড় বড় শিল্পীরাই সেখানে গান করেন। এবং পুরো অনুষ্ঠানটি নিজেদের খরচে আমরা চালাই যাতে করে এটি বন্ধ হয়ে না যায়। এখান থেকেই আমরা মুরুব্বিদের নামে একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
আপনার সাথের সবাই কি আপনার পরিবারের সদস্য বা আত্মীয় স্বজনদের কেউ?
নুসরাত: জি হ্যা, এরা সবাই আমার ভাইবোন এবং আত্মীয় স্বজন।
সম্প্রতি নূর জেহানের শো ফয়সালাবাদে নিষিদ্ধ হয়েছে, এ ব্যাপারে আপনার মত কি?
নুসরাত: লাহোরে নূর জেহানের শো হতে পারলে ফয়সালাবাদে হতে সমস্যা কোথায়!
সম্প্রতি আদনান সামি খানসহ তরুণদের অনেকে আধুনিক যন্ত্রে বাজাচ্ছেন। আপনি এটাকে কিভাবে দেখেন?
নুসরাত: এটা খুবই ভাল একটা ব্যাপার। সঙ্গীতের প্রতিটি ধারাই চর্চা হওয়া উচিত। এর মাধ্যমে আমার মনে হয় আমরা জনমানুষের আরও নিকটে যেতে পারছি। আদনান সামিকে দেখে তরুণেরা উৎসাহ পাচ্ছে, এটা খুব ভাল।
আপনি কি আপনার সন্তানদেরকে আধুনিক সঙ্গীতের তালিম দেন?
নুসরাত: আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম দেই। তবে যদি কেউ আধুনিক সঙ্গীতের তালিম দিয়ে থাকে তাতে কোন আপত্তির কিছু দেখি না আমি।
সন্তানকে কত বছর বয়স থেকে তালিম দেওয়া শুরু করেছেন অাপনি?
নুসরাত: ১২ বছর বয়স থেকে। আমার বাবা আমাকে ৭ বছর বয়সে তালিম দেওয়া শুরু করেন, এবং আমি ১৩ বছর বয়স থেকে আনুষ্ঠানিক পরিসরে গাইতে শুরু করি।
আপনি কি অন্যদের সন্তানদেরকেও সঙ্গীতের তালিম দেন?
নুসরাত: না, আসলে আগে দেখতে হবে তার মধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেবার মত প্রতিভা আছে কিনা।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলুন।
নুসরাত: আমার মতে, পাকিস্তানে এর ভবিষ্যৎ উজ্জল নয়। শিল্পীরা নিজেরা তাদের সন্তানদেরকে তালিম দিচ্ছেন, তবে সেটা খুবই অপ্রতুল। ভবিষ্যৎ ভাল হবে এমন বলার কোন উপায় নেই।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীরা তাদের সন্তানদেরকে চলতি ধারার সঙ্গীতের কলাকৌশল শেখাচ্ছেন, কারণ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কোন ভবিষ্যৎ নেই। শ্যাম চৌরষি ঘরানাসহ অনেক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবার চলতি ধারার দিকে ধাবিত হচ্ছে।