তবলিগ জামাত-এর আমির মাওলানা সা’দ কান্ধলভির সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যকে ভ্রান্ত আখ্যা দিয়ে ফতোয়া জারি করেছে ভারতের প্রখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসা। অবশ্য ঐতিহাসিকভাবে ভারতের উত্তর প্রদেশের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা ও তবলিগের দিল্লির মারকাজে নিজামুদ্দিনের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক সব সময়ই বজায় ছিল। তবলিগের দিল্লির কেন্দ্র মারকাজে নিজামুদ্দিনকেই বিশ্ব তবলিগের প্রধান মারকাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বছর দুয়েক হলো বর্তমান মারকাজে নিজামুদ্দিন ও দারুল উলুম দেওবন্দের মধ্যে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বিভিন্ন সময় বয়ানে বলা বক্তব্য প্রত্যাহারের আহŸান জানিয়ে চিঠি দেয় দেওবন্দ। চিঠি চালাচালি এক পর্যায়ে ব্যর্থ হয়। এরপর দারুল উলুম থেকে ফতোয়া প্রদান করা হয়। ওই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেন দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতিয়ে আজম হাবিবুর রহমান খায়রাবাদি। দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নোমানি, শায়খুল হাদিস মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরি, মাওলানা আবদুল খালেক সাম্ভলি, মাওলানা আবদুল খালেক মাদরাজি, মাওলানা নেয়ামত উল্লাহ আজমি প্রমুখ খ্যাতিমান আলেম।
এদিকে মাওলানা সা’দ সম্পর্কে দেওবন্দের অবস্থান জানতে বাংলাদেশ থেকে এ দেশের আলেম ও ঢাকার কাকরাইলে অবস্থিত তবলিগ জামাতের শূরা সদস্য প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে। তারা দেওবন্দ, নিজামুদ্দিন ও গুজরাট সফর করেন। প্রতিনিধি দলের কাছে দেওবন্দ লিখিত বক্তব্য প্রদান করে।
জানা গেছে, দেওবন্দ এখনো মাওলানা সা’দ কান্ধলভির ওপর আস্থাশীল নয়। তাদের ভাষ্য- “মাওলানা সা’দ আজ পর্যন্ত একবারও স্পষ্ট শব্দে রুজু (বক্তব্য প্রত্যাহারপূর্বক একই ধরনের বক্তব্য আর কখনো প্রদান না করার অঙ্গীকার) করেননি। দেওবন্দ তাকে প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করে ঘোষণা দিতে বলেছিল। আজ পর্যন্ত তা তিনি করেননি।” এছাড়া মাওলানা সা’দকে দেওবন্দ থেকে বলা হয়েছিল, নবী হজরত মুসা (আ.) সম্পর্কে ভুল ও অপবাদপূর্ণ বক্তব্য যেভাবে তিনি সর্বসাধারণের মাহফিলে দিয়েছেন তেমনিভাবে সর্বসাধারণের মাহফিলে ওই বক্তব্য প্রত্যাহারের ষোঘণা দেবেন। এমন প্রস্তাবে তিনি সাড়া দেননি।
দেওবন্দের ফতোয়ায় উল্লেখিত ‘ভ্রান্ত’ দাবি করা মাওলানা সা’দ কান্ধলভির ৭টি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা হলো-
১. হজরত মুসা (আ.) নিজ কওম ও জামাতকে ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে চলে গিয়েছিলেন। ফলে বনি ইসরাইলের ৫ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷
২. বর্তমানে মানুষ তওবার ৩টি শর্ত মনে রেখেছে। চতুর্থ শর্ত আজ সবাই ভুলে গেছে। তা হলো ‘খুরুজ’ (তবলিগের কাজে বের হওয়া)।
৩. হেদায়াতের জায়গা একমাত্র মসজিদ। যে প্রতিষ্ঠানগুলোয় দ্বীনি শিক্ষা দেয়া হয়, আল্লাহর কসম- সেগুলোর যদি মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকে তাহলে সেখানেও দ্বীন নেই। দ্বীনি শিক্ষা হবে। কিন্তু দ্বীন হবে না।
৪. পারিশ্রমিক নিয়ে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া মানে ধর্মের সঙ্গে ঠাট্টা করা। জিনা-ব্যভিচারকারীরা দ্বীন শিক্ষা দিয়ে বেতন গ্রহণকারীদের আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
৫. আমার মতে, ‘ক্যামেরা বিশিষ্ট মোবাইল ফোন পকেটে রেখে নামাজ হয় না। যত মুফতির ফতোয়াই সংগ্রহ করুন না কেন, মোবাইল ফোন থেকে কোরআন শোনা, কোরআন পড়ার মধ্য দিয়ে কোরআনকে অপমান করা হয়। এতে গোনাহ হবে। কোনো সাওয়াব মিলবে না।’ যেসব উলামা এ ব্যাপারে বৈধতার ফতোয়া দেয় তারা উলামায়ে সু (বর্জনীয় আলেম)। তাদের মন ও মগজ ইহুদি-খ্রিস্টানদের দ্বারা প্রভাবিত। তারা সম্পূর্ণ জাহেল উলামা। আমার মতে, “তাদের অন্তরে আল্লাহর কালামের কোনো মহব্বত নেই। আামি এ কথা এ জন্য বলছি যে, আমার থেকে বড় এক আলেম বলেছেন, ‘এমন বলায় কোনো সমস্যা নেই।’ আমি বলেছি, সে আলেমের হৃদয়ে কোরআনের বিন্দু মাত্র ভালোবাসা নেই- যদিও তার পুরো বুখারি শরিফ মুখস্থ থাকুক না কেন। বুখারি তো কত অমুসলিমেরও মুখস্থ থাকে।”
৬. প্রত্যেক মুসলমানের ওপর কোরআনকে বুঝে পড়া ওয়াজিব, ওয়াজিব, ওয়াজিব। যে ব্যক্তি এ ওয়াজিব ত্যাগ করবে তার ‘ওয়াজিব তরকে’র গোনাহ হবে৷
৭. আশ্চর্য! আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘আপনার এসলাহি সম্পর্ক কার সঙ্গে?’ তারা কেন এটা বলে না, আমার সম্পর্ক এই কাজের সঙ্গে, দাওয়াত ও তবলিগের সঙ্গে! আমি ওই ব্যক্তিদের নিয়ে বড়ই চিন্তিত যারা বলে, তবলিগের ‘ছয় নম্বর’ পুরো দ্বীন নয়!