গোল্ডেন গ্লোব ২০১৮-এ ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে ‘সিসিল বি ডিমাইল’ সম্মাননা অর্জন করেন হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী, উপস্থাপক ও একাধারে দানবীর বলে খ্যাত অপরাহ উইনফ্রে। দর্শকের সারি থেকে করতালি ও সশ্রদ্ধ দাঁড়িয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান সবাই। বিনোদনের জগতে অসীম অবদানের জন্য তিনি এই আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। বহুল আলোচিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ’-এ ‘হ্যাশট্যাগ মি-টু’ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে কালো পোশাকে সজ্জিত ওই অনুষ্ঠানে মোট ২৬টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেয়া হলেও সবার নজর কেড়ে নেন অপরাহ উইনফ্রে তার শক্তিশালী বক্তব্যের মাধ্যমে।
স্টেজে উপস্থাপক রিস উইদারস্পুন ডাকার পর পরই অপরাহ উইনফ্রে বুঝতে পারেন ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে ওই পুরস্কার পাওয়াটা আরেক মুহূর্তের ব্যাপার। করতালির মধ্য দিয়ে মঞ্চে উঠে পুরস্কার নিয়ে তিনি কথা শুরু করেন বর্ণবৈষম্য ও যৌন নিপীড়নের বিরূদ্ধে জোরালো আলাপ দিয়ে।
সিডনি পটিয়ারকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে গত রবিবার অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। সিডনি পটিয়ার ১৯৬৪ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা হিসেবে সেরা অভিনেতার জন্য একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পান। আর তার ১৮ বছর পর ১৯৮২ সালে গোল্ডেন গ্লোব-এ ‘সিসিল বি ডিমাইল’ আজীবন সম্মাননা পান।
অপরাহ বলেন, “১৯৬৪ সালে ছোট্ট আমি মিলওকিতে মায়ের ঘরের মেঝেতে বসে সাক্ষী হই ইতিহাসের যখন সিডনি পটিয়ার ‘লাইলিস অফ দি ফিল্ড’-এর জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পান। কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে প্রথম কোনো অভিনেতা এই পুরস্কার নেন। ১৯৮২ সালে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সিডনি ‘সিসিল বি ডিমাইল আজীবন সম্মাননা পান সিডনি। তা এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল। আজ একইভাবে হয়তো কোনো কৃষ্ণাঙ্গ বালিকা আমাকে দেখছে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে এই সম্মাননা গ্রহণ করতে যেমনটা আমি দেখেছিলাম সিডনি পটিয়ারকে”।
অপরাহ উইনফ্রে বলতে থাকেন, “যারা আমাকে বিভিন্ন সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, যাদের জন্য এই পথে আমার সফল অভিযান সম্ভব হয়েছে- তাদের জন্য আমার কাছে এটা একটা সম্মান যে, এই অতুলনীয় সব মানুষের সঙ্গে এই সন্ধ্যায় শরিক হতে পেরেছি। আমি কৃতজ্ঞ ড্যানিস সোয়ানসন-এর কাছে যিনি আমাকে ‘এএম সিকাগো’তে সুযোগ দিয়েছেন। এবং আরো কৃতজ্ঞ কুইন্সি জোন্স-এর কাছে যিনি আমার প্রথম মুভি স্পিলবার্গের ‘কালার পারপল’-এ কাজের সুযোগ করে দেন। আমি আরো ধন্যবাদ দিতে চাই ফরেইন প্রেস অ্যাসোসিয়েশনকে। কারণ আমরা সবাই জানি এখন সংবাদমাধ্যমের সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। কিন্তু আমরা এও জানি, সত্য প্রকাশে সংবাদমাধ্যমের অনবদ্য প্রচেষ্টাই আমাদের দুর্নীতি ও অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করে থাকা থেকে বিরত রাখে।’
নারী সমাজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে উইনফ্রে বলেন, “অনেক নারী যারা বছরের পর বছর নির্যাতন-লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন, তাদের নাম আমরা কখনোই জানব না। আজ তারা গৃহিণী, দিনমজুর, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা ডাক্তার। আবার তারা কেউ আজ বিশ্ব প্রযুক্তি ও রাজনীতির অংশ। হয়ওতা তারাই অলিম্পিকের অ্যাথলিট, মিলিটারিতে সৈন্য।’
নিজের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে অপরাহ বলেন, “যার কথা না বললেই নয় তিনি হলেন রেসি টেইলর। তাকে আমি চিনি এবং সবারই চেনা উচিত। ১৯৪৪ সালে চার্চ থেকে ফেরার সময় এক দল শ্বেতাঙ্গ সৈন্য তাকে গণধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায় রাস্তার পাশে। হুমকি দেয়, কাউকে জানালে খুন করে ফেলবে। কিন্তু ওই খবর এনএএসিপি-এর হাতে চলে যায়। তবে তখন ন্যায়বিচারের কোনো দায় ছিল না। স্বভাবতই বিচার হয়নি সৈন্য দলের যারা রেসিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। রেসি টেইলর ৯৮ বছরের জীবন পেয়েছিলেন। বেঁচে আছি আমরাও ক্ষমতাধর পুরুষের সংস্কৃতিতে। এখনো সেখানে নারীরা এই ক্ষমতাধরদের বিরূদ্ধে কথা বলার সাহস পাননি। তাদের সময় শেষ, তাদের সময় শেষ”।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে গিয়ে উইনফ্রে বলেন, “আমি এমন অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি যারা জীবনের সবচেয়ে নিচু ও কুৎসিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু তাদের কেউই হাল ছাড়েনি। কারণ তারা সব সময় আশা করতেন একদিন আলো এসে সব অন্ধকার দূর করে দিয়ে যাবে। সবাই নতুন দিনের স্বপ্ন দেখতেন। এই মুহূর্তে যারা আমাকে দেখছেন, প্রত্যেক নারীকে বলতে চাই, দিগন্তে নতুন দিনের আভাস দেখা যাচ্ছে। যখন ওই নতুন দিনের সূচনা হবে, তা হবে অনেক চমৎকার সাহসী নারীর হাত ধরে। তাদের অনেকেই এখন এখানে উপস্থিত আছেন। কয়েক চমৎকার পুরুষ যারা লড়ে যাচ্ছেন আমাদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তারা তাকিয়ে আছেন ওই সময়ের দিকে যখন কোনাে নারীকেই আর কখনো বলতে হবে না ‘হ্যাশট্যাগ মি-টু’।”