মারণব্যাধিও যার কাছে অসহায়

মারণব্যাধিও যার কাছে অসহায়

মারণব্যাধি ক্যানসার যখন শরীরে নিজ অস্তিত্বের জানান দেয় তখন পেশাদার ফুটবলের কঠিন জগতে বিচরণের চিন্তাটা যেন ঠেকে এক নিঠুর প্রহসন। স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তাই যখন নিকষ আঁধারে নিপতিত তখন কে বা চিন্তা করেন ওই আঁধারের রাজ্যে ঢেকে থাকা পথ হেঁটে সবুজের গালিচায় ময়দানি যুদ্ধে ফেরার?
গল্পের মতো শোনালেও এমন অলীক ভাবনা ভাবার মতো মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাদের মধ্যে অন্যতম ফরাসি রক্ষণ তারকা এরিক সিলভাইন আবিদাল। তীব্র ইচ্ছাশক্তির জোরে একবার নয়, দু’বার পরাস্ত করেছেন পরাক্রমশালী ব্যাধি ক্যানসারকে। এতেই থেমে না থেকে ফিরেছেন পেশাদার ফুটবলে। শৈশবের স্বপ্নের দল বার্সার জার্সি গায়ে জিতেছেন আরাধ্য ‘ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ’ শিরোপাও।

কিছু জীবন থাকে যা গল্পও হার মানায়। আবিদাল তেমনই একটি গল্পের স্রষ্টা।স্বদেশি ক্লাব‌ ‘অলিম্পিক লিঁও’ ছেড়ে ২০০৭ সালে পাড়ি জমান স্বপ্নের ক্লাব বার্সেলোনায়। তখন জোসেফ গার্দিওলার অধীন নিজেদের সেরা সময়টা পার করছিল বার্সেলোনা। আগমনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সমর্থকদের মন জয় করে নেয়া আবিদাল হয়ে উঠলেন দুর্জেয় বার্সার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সবাইকে চমকে দেয়া
শিরোপা ‘ষষ্টক’ জয়ী দলের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন আবিদাল। চারদিক যখন আলোর রোশনাইয়ে আলোকিত তখনই আকস্মিক আঘাতে ‘ক্যাম্প ন্যু’র আকাশে নেমে আসে অনাকাক্ষিত আঁধার। নিয়মিত চেকআপে একবার চিকিৎসকরা জানান, আবিদালের শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যানসার। স্তব্ধ আবিদালের পাশে দাঁড়ায় প্রিয় ক্লাব বার্সা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মারফত তার আরোগ্য কামনা করলেন ফুটবল জাহান রাজত্ব করা তারকা কাকা, রোনালদো, গানার্স অধিনায়ক সেস্ক ফেব্রিগাসরা।

সবার অবস্থা দেখে হয়তো আড়ালে মুচকি হেসেছিলেন আবিদাল। সবাই যখন তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের যতিচিহ্ন দেখে ফেলেছে তখনই চমকে দিয়ে মাত্র তিন সপ্তাহ পরই অনুশীলনে যোগ দিলেন তিনি। যার ইচ্ছা শক্তি এত তীব্র অনুশীলনে ফিরতে পারার আনন্দে তিনি তুষ্ট থাকেন কী করে! পুনরায় জায়গা করে নিলেন বার্সার স্কোয়াডে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে দাপিয়ে বেড়ালেন পুরো ৯০ মিনিট। স্যার ফার্গুসনের ইউনাইটেডকে ৩-১ গোলে বিধ্বস্ত করে নিলেন দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপে সেরা হওয়ার স্বাদ। সদ্য ক্যানসার ফেরত সতীর্থের প্রতি সম্মান জানানোর সর্বোত্তম পন্থাটা যেন বেছে নিলেন তৎকালীন বার্সা দলপতি কার্লোস পুয়োল। নিজের হাতে বাহু বন্ধনীটি খুলে পরিয়ে দিলেন প্রিয় সতীর্থের বাহুতে। সারা দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে দেখল শিরোপা হাতে উল্লাসরত আবিদালকে।

গল্পটা এখানেই শেষ নয়, অদম্য আবিদালের সঙ্গে যেন সম্মানের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলো ক্যানসার । সবকিছুই যখন স্বপ্নের মতো চলছে তখন দ্বিতীয়বারের মতো তিনি বাধ্য হলেন শল্যবিদের শরণাপন্ন হতে। এবার আর এত সহজে পার পেলেন না তিনি। বরং প্রয়োজন পড়লো লিভার প্রতিস্থাপনের। তার অসাধারণ প্রত্যাবর্তনে মুগ্ধ সমর্থকরাও বোধ করি কিছুটা চুপসে গিয়েছিলেন। শুভাকাঙ্ক্ষীরাও হয়তো মেনে নিয়েছিলেন অশুভ এই শক্তির কাছে তার পরাজয়। স্বাভাবিক জীবনের সামান্য নিশ্চয়তাটাই ছিল তখন আরাধ্য। বিশ্বের স্ট্রাইকারদের সামনে যিনি চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে নস্যাৎ করতেন গোলের প্রচেষ্টা তাকে ফাঁকি দিয়ে ক্যানসার জিতে যাবে এমনটা আর যেই মানুক, তিনি মানেননি। আরো একবার তার রাফ ট্যাকেলে হার মানলো ক্যানসার। অপারেশনের বছরখানেকের মাথায় পুনরায় ফিরলেন কাতালান শিবিরে। তবে ফিরে আর বেশিদিন থাকেননি, যোগ দিয়েছিলেন স্বদেশি ক্লাব মোনাকো-তে। সেখানে এক মৌসুম থেকে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন গ্রীসের অলিম্পিয়াকোসের হয়ে।

কঠিন ওই সময়ে উদারতার সবচেয়ে বড় নজির রেখেছিলেন আবিদালের বার্সা সতীর্থ ব্রাজিলিয়ান তারকা দানিয়েল আলভেস। ক্যারিয়ারের মায়া ভুলে তাকে দিতে চেয়েছিলেন নিজের লিভার। বন্ধুর ওই উদার প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বিনয়ের সঙ্গেই। চিকিৎসা চলাকালে তার সঙ্গে বার্সার সম্পর্কের অবনতির কথা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ হলেও দু’পক্ষই অস্বীকার করেছে ওই তথ্যের
সত্যতা। তিনি ওইসব খবরের আখ্যা দিয়েছেন ভুল বোঝাবুঝি হিসেবে।

ব্যক্তি জীবনে দুই কন্যার জনক আবিদাল বিয়ে করেন ২০০৭ সালে। পাত্রী সাবেক জিমন্যাস্ট হায়াত কবির। বিয়ের পরই ইসলাম গ্রহণ করেন আবিদাল। বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ারে তার জেতা শিরোপার সংখ্যাও ঈর্ষা জাগানিয়া। লিঁও, বার্সা ও অলিম্পিয়াকোস-এর হয়ে জিতেছেন মোট ১৯টি শিরোপা। অংশ ছিলেন ২০০৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপ রানার্সআপ ফ্রান্স দলেরও।

ক্যানসার নামক বিষ হয়তো বাধাগ্রস্ত করেছে আবিদালের ফুটবল ক্যারিয়ার। কিন্তু অদম্য ইচ্ছা শক্তির কাছে যে ওই মারণব্যাধিও অসহায় এর প্রমাণ রেখে তিনি অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রইবেন সবার কাছে।