দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মানবমুক্তির সংগ্রামে ধর্ম এক স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ হয়ে আছে আজও। একটি জনপদের নাগরিক অধিকার, সাম্য ও স্বাধীনতার সংগ্রামে তার আধ্যাত্মিকতার কী ভূমিকা থাকবে এ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের শেষ নেই। এই প্রশ্নের মোকাবেলা না করতে পেরে বহু সম্ভাবনাময় জনআন্দোলন প্রত্যাশিত সফলতা না পেয়ে শেষ হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।
অনেকেই ধর্মীয় স্বাধীনতার সঙ্গে মানবমুক্তির লড়াইয়ের যোগসূত্র বুঝতে পারেন না এবং একে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। তবে আপাত অমিমাংসিত এই বিতর্কের বাইরে থাকা সাধারণ জনতা কিন্তু কালে কালে এ বিষয়ে তাদের রায় দিয়েছে বহুবার- বহু আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে। তাদের কাছে ধর্ম কিন্তু স্রেফ ‘ব্যক্তিগত ব্যাপার’ হয়ে নেই।
কেন একটি আযান শেষ করতে ২২ জন মুয়াজ্জিন শহীদ হন
জুলুম বিরোধী লড়াই আর ধর্মীয় স্বাধীনতার আকুতি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপটে আছে তার এক বড় উদাহরণ কাশ্মিরের ১৩ জুলাইয়ের (১৯৩১) ইতিহাস। কাশ্মিরের জনগণের নাগরিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার আদায় তথা আজাদির আন্দোলনে মোটাদাগের একটা শুরুর বিন্দু বলা যায় ১৯৩১ সালের ১৩ জুলাই এবং পরবর্তী ঐ গণআন্দোলনকে।
ঘটনাটি হয়তো বহুজনের জানা, তাও উল্লেখ করছি এই কারণে যে, মজলুমদের স্বৈরতন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ের যে বহু ধরন আছে এই অঞ্চলে তার একটি শোকাবহ, কিন্তু শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত ঐতিহাসিক এই অধ্যায়।
আপাত অমিমাংসিত এই বিতর্কের বাইরে থাকা সাধারণ জনতা কিন্তু কালে কালে এ বিষয়ে তাদের রায় দিয়েছে বহুবার- বহু আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। তাদের কাছে ধর্ম কিন্তু স্রেফ ‘ব্যক্তিগত ব্যাপার’ হয়ে নেই
প্রায় নয় দশক আগের ঐ দিনে শ্রীনগর কারাগারে বিপুল স্থানীয় মুসলমান সমবেত হয়েছিল জনৈক আবদুল কাদিরের বিচার প্রত্যক্ষ করতে। আবদুল কাদিরের বিরুদ্ধে মহারাজা হরি সিংয়ের শাসনের বিরুদ্ধে জনমতকে উস্কে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এই মহারাজার কাছেই একদা কাশ্মিরকে বিক্রি করে দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাত্র ৭৫ লাখ নানকারশাহীর (তখকার পাঞ্জাবের মুদ্রা) বিনিময়ে।
স্থানীয় জনমতের তোয়াক্কা না করে এইরূপ কেনাকাটার ফল ছিল এই যে, কাশ্মিরে হরি সিংয়ের প্রজাদের অবিশ্বাস্য হারে করারোপসহ বহুধরণের নিপীড়নের শিকার হতে হত দশকের পর দশক ধরে- যে প্রজাদের ৮৫ ভাগই ছিলেন মুসলমান। মহারাজার প্রশাসনে অন্তত ১৯৩০ পর্যন্ত মুসলমানদের ঠাঁই ছিল না।
নির্মম ধাঁচের পরাধীনতার এই বোবা বেদনারই পুঞ্জিভূত প্রকাশ ঘটে ১৯৩১ সালে- যখন জম্মুতে ঈদের খুতবায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং সৈনিকদের হাতে কুরআন শরীফের অবমাননা হয়। ধর্মীয় স্বাধীনতার এই অপমানের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী এবং উত্তেজক ভাষণ দেয়ার কারণেই কাশ্মিরী তরুণ আবদুল কাদিরকে আটক ও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
কিন্তু স্থানীয়দের কাছে মুহূর্তে আবদুল কাদির সাহসের প্রতীকে পরিণত হয়ে যান। তাঁরা কাদিরের সমর্থনে কাশ্মির জুড়ে মিছিল শুরু করে। জনরোষ এড়াতে তাই বিচার কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয় শ্রীনগর কারাগারের ভেতর। সেখানেও আগ্রহী জনতার একাংশ উপস্থিত হয় রায় জানতে। ১৩ জুলাই বিচার চলাকালে নামাজের ওয়াক্ত এলে একজন কাশ্মিরী আযান দিতে শুরু করে। এসময় মহারাজার গভর্ণরের নির্দেশে মুয়াজ্জিনকে গুলি করা হলে আরেকজন স্থানীয় মানুষ আযান দিতে দাঁড়িয়ে যান। তাকেও গুলি করা হয়। এরপরের ইতিহাস বিস্ময় আর নির্মমতায় ভরা। একে একে ২২ জন মুসলমান শহীদ হন এক আযান সম্পন্ন করতে যেয়ে। এইরূপ নির্মমতায় সেদিন এবং তৎপরবর্তী দিনগুলো শোকে ও ক্ষোভে কাশ্মির স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রায় দু’সপ্তাহ শ্রীনগরের সঙ্গে রাওলপিন্ডি ও জম্মুর যোগাযোগ বন্ধ থাকে।
একই সঙ্গে এই ঘটনা কাশ্মিরীদের মাঝে রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের যৌক্তিকতা বাড়িয়ে তোলে। এরপরই প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথমে ‘মুসলিম কনফারেন্স’ এবং পরে ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’। তৈরি হয় ‘নয়া কাশ্মির’ মেনিফেস্টো- যাকে বলা যায় দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রসর রাজনৈতিক দলিলগুলোর একটি।
বর্তমানে প্রতিবছর আজাদ কাশ্মির ও ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরে ১৩ জুলাই ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়- কিন্তু মোটা দাগের এই অভিজ্ঞতার পরও ধর্ম ও আজাদির আন্দোলনের সম্পর্ক উপমহাদেশের সমাজ রূপান্তর আন্দোলন কর্মীদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে এমনটি বলা যায় না। কারণ কাশ্মিরের নাগরিকদের আজাদির আন্দোলন আজও উপমহাদেশের ‘মূলধারা’র কমিউনিস্টদের প্রধান এজেন্ডা হয়েছে এমনটি দেখা যায়নি। অথচ কাশ্মিরের ১৯৩১-এর জুলাইয়ের গণআন্দোলন কেবল খুৎবা শোনা বা আযান দেয়ার অধিকারের প্রশ্নে হয়নি- বরং তার গভীরে ছিলে কয়েক যুগের অসাম্য ও বঞ্চনাদগ্ধ জীবনের প্রতিবাদী স্ফূরণ।
বাঙ্গালির ‘মুক্তির যুদ্ধে’ যোগেন মন্ডল ও হরিচাঁদ ঠাকুরদের হিস্যা…
ধর্ম ও আজাদির সংগ্রামের আন্তঃসম্পর্ক খুঁজতে বাংলা অঞ্চল থেকে ভিন্নধর্মীয় উদাহরণও অনেক দেয়া যায়। যেমন, ওড়িষ্যা ও বাংলায় শ্রী চৈতন্য দেবের ভক্তি আন্দোলন যে শুধুই ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না- সামাজিক দিক থেকে এর প্রধান এক লক্ষ্য ছিল, তখনকার সর্বগ্রাসী জাতপাতের অবসান এবং অচ্যুত স্পর্শকাতরতা থেকে আজাদির জন্য জাগরণ- আজও সেই মর্ম আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। নদীয়ার সাধনার ধারা, যা এখন লালন পন্থা নামে পরিচিত -এরও উত্থান ঘটেছিল সমাজের সবচেয়ে নিম্নবর্গের পরিসরের ভিতর থেকেই। সাধারণ মানুষই এই দর্শনের ধারা গড়ে তুলেছিলেন। এর রাজনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোন বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপ শুরু হয়নি। এর শ্রেণী ও জাত-পাতের বিরুদ্ধে যে নিরব সংগ্রাম তা কেবল মাত্র ‘ব্যক্তিগত’ সাধনা বা দেহজ মুক্তির উপায় হিসেবে দেখা হয়। যা এখন বাংলার মধ্যবিত্ত সুশীলদের কাছে ‘বাউলিয়ানা’ হয়ে আছে। তবে এই ধারণাকে কেন্দ্র করে যে ধরণের দায়সারা তত্ত্বায়ন চোখে পড়ে তা কোন নতুন রাজনৈতিক দিশা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে তাও স্বীকার করতে হবে। এটা এখন পরিণত হয়েছে নিরাপদ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু তাই বলে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব মোটেও কমে যায়নি। বাঙ্গালি ‘বিপ্লবী’রা এখানে শ্রেণী সংগ্রাম বা সার্বজনীন হওয়ার সাধনা দেখেন না।
এ অঞ্চলের মজলুমদের এই পিছিয়ে পড়া অবস্থার দায় কিন্তু চিন্তাচর্চায় এগিয়ে থাকার দাবিদার প্রগতিশীলদের। যে মানুষদের নিয়ে তাঁরা রাজনৈতিক লড়াইটা লড়তে চান এখনও তাঁরা সেই মানুষদের ‘পশ্চাৎপদ’ ‘ধর্মতত্ত্ব’-এর পরিসরেই রেখে দিয়েছেন
এমনকি বাঙ্গালির ‘মুক্তির যুদ্ধ’ যে কেবল ১৯৫২ বা ১৯৭১ থেকে শুরু হয়নি এতে যে নদীয়াসহ বাংলার বিভিন্ন জনপদের, নানান জনগোষ্ঠির ভেতর থেকে উঠে আসা খুব সাধারণ কিছু অসাধারণ মানুষদের অবদান আছে তা আমরা ভুলে যেতে বসেছি। যেমন, নিতাই বা বাকেরগঞ্জের যোগেন মন্ডল কিংবা ওড়াকান্দির হরিচাঁদ ভক্ত মতুয়াদের ত্যাগ ও ঐতিহাসিক হিস্যা আছে । এবং আজও তা তার দায় আমরা উপলব্ধি করতে পারি নাই তার প্রমাণ হল, এইসব ত্যাগ এ অঞ্চলের ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে’ ঠাঁই পায়নি। অনেকেই জানেন, বহু বছর ধরে বৃহত্তর ফরিদপুরে মতুয়া মহাসম্মেলন বসে। বহু বছরের পুরানো এই আয়োজনের ঐতিহাসিক মর্মও আমাদের প্রচারমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবী সমাজে সামান্যই মনযোগ পেয়েছে। জীবদ্দশায় হরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর অনুসারীরা অত্র জনপদে ব্রাহ্মণ্যবাদ, জমিদারতন্ত্র ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে অসামান্য লড়াই জারি করেছিলেন বাংলার বিপ্লবী তাত্ত্বিকরা আজও তাতে শ্রেণী রাজনীতির কোন উপাদান খুঁজে পেয়েছেন বলে জানি না।
বস্তুত কাশ্মির বা বাংলার বাইরেও দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে রক্ত-গোত্র-জুলুম-পুরুষতন্ত্র-জাত-পাত বিরোধী সংগ্রামের এমন অনেক ঐতিহ্য আছে যা স্থানীয় অভিজাত চিন্তার কাছে কেবল ধর্ম বা ধর্মীয় আকাঙ্খার প্রকাশ আকারেই হাজির আছে। একে সে আজও মুক্তিতত্ত্ব আকারে দেখতে শেখেনি। ঠিক এ কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার মজলুমরা আজও ধর্মে ধর্মে আলাদা হয়ে আছে- একক ‘রাজনৈতিক কমিউনিটি’ আকারে দাঁড়াতে পারছে না। আর এ অঞ্চলের মজলুমদের এই পিছিয়ে পড়া অবস্থার দায় কিন্তু চিন্তাচর্চায় এগিয়ে থাকার দাবিদার প্রগতিশীলদের। যে মানুষদের নিয়ে তাঁরা রাজনৈতিক লড়াইটা লড়তে চান এখনও তাঁরা সেই মানুষদের ‘পশ্চাৎপদ’ ‘ধর্মতত্ত্ব’-এর পরিসরেই রেখে দিয়েছেন। মতুয়াদের কীর্তন, কাশ্মিরীদের খুৎবা শোনার লড়াই কিংবা অনুরূপ ধাঁচের সংগ্রামগুলো যে পরিপূর্ণ অর্থেই আজাদির লড়াই ছিল এবং আছে সে সত্য আমাদের বৌদ্ধিক উপলব্ধিতে এলেই কেবল আমরা এ অঞ্চলে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে একটা বড় ধাপ এগোতে পারব।
ভাল লেখা
ইতিহাসের উপেক্ষিত অধ্যায়কে খুব সাবলীল ভাবে তুলে ধরেছেন। ধন্যবাদ লেখক কে।
চমৎকার বিশ্লেষণ।